দুর্বোধ্য

হুশ করে গাড়িটা বেরিয়ে গেল! আমার গায়ে একরাশ কাদাপানি ছিটকে দিয়ে। আমি অবশ্য এমনিতেও ভিজে গেছি। আমার বয়সী একটা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় একা একা হাঁটছে—এটা খুব একটা স্বাভাবিক দৃশ্য না। কাজেই লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। আমি ভাব করছি, যেন তাদের তাকানোতে আমার কিছু এসে যায় না। আসলে এসে যায়, ছাতা নিয়ে বের হওয়া উচিত ছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়েই অবশ্য ছাতার কথা মনে পড়েছিল। জুন মাসের আকাশের উপরে খুব একটা ভরসা করা যায় না। তবু, ফিরে গিয়ে আবার ছাতাটা আনতে ইচ্ছে হল না। যেই বাড়িতে আজ ভোরবেলা একটা মানুষ মারা গেছে—সেখানে ফিরে যেতে ইচ্ছে না করলে নিশ্চয়ই দোষ দেয়া যায় না? 

আমার নাম রিচি। আর আজ ভোরবেলায় যেই মানুষটা মারা গেছেন, তিনি আমার আম্মু। তেমন কোন বিশেষভাবে ঘটনাটা ঘটে নি, এমনিই মারা গেছেন। গতকাল রাতে বেশ ভালো ছিলেন। খাওয়ার পর আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে যখন চাচা কাহিনী পড়ছিলাম, তখন আম্মু রান্নাঘরে কাজ করতে করতে গুনগুন করে একটা গান গাচ্ছিলেন। খুব চেনা একটা সুর, তখন অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি নি।

মনে পড়ল সকালবেলা। নাস্তা করছিলাম, রাফাত হঠাৎ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মু মারা গেছে আপু, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ল, গতকাল রাতে আম্মু যেই গানটা গাইছিলেন সেটা হেমন্তের একটা গান। “শোন, কোন একদিন আকাশ-বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়”—এই গানটা। যেই মানুষটা গতকাল রাতেও গুনগুন করে এই গানটা গাইছিল, তার আজ ভোরবেলা মারা যাওয়ার কথা না। 

এখন বাজে বিকেল পাঁচটা, সকাল থেকে শুরু করে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আমি কী করেছি—আমি নিজেও জানি না। মাথার ভেতরে অসংখ্য চিন্তা এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন একটা গানে যেন ছিল, thoughts meander like a restless wind inside a letterbox. একটা চিঠির বাক্সে প্রবল বাতাস বইতে শুরু করলে চিঠিগুলো যেমন বাক্সের মধ্যে এলোমেলো উড়তে থাকে, সেরকম মাথার ভেতরে চিন্তাগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। ব্রেইনের পুরো ক্ষমতাটা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে চিন্তাগুলোকে সামলাতে, বর্তমানে কী ঘটছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। 

আচ্ছা, বোঝার চেষ্টা করি। আমি দাঁড়িয়ে আছি শহীদ মিনারের সামনে। আমাদের বাসা সেন্ট্রাল রোড, সেখান থেকে শহীদ মিনার হেঁটে আসতে বেশিক্ষণ লাগে না, কাজেই আমি মোটামুটি ঘন্টাখানেক ধরে হেঁটেছি। এবং ঘন্টাখানেক ধরে বৃষ্টিতে ভিজেছি। এটা অবশ্য একদিক দিয়ে খুব ভালো হয়েছে। আমার চোখেমুখে পানি দেখে সবাই ভাবছে এটা বৃষ্টির পানি। খুব আশ্চর্য, আজ সারাটা সকাল, সারাটা দুপুর আমি কাঁদি নি। খুব কম মানুষই জানে, আমার আম্মুর মতই আমিও অসম্ভব শক্ত একটা মেয়ে। দুপুরে চাচা যখন সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিল, তখন ভেঙে পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু এই বিকেলবেলা, চারশো বছরের পুরনো শহরটার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সারাদিনের চেপে রাখা কান্নাটা বের হয়ে এল। 

আচ্ছা, কাঁদছি কেন? বাবা-মায়ের ব্যাপারে যেহেতু স্টিভ জব্‌সের দর্শনটা বিশ্বাস করি—আমার তো কাঁদার কথা না! 

আম্মুর সাথে শেষদিকে আমার খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না। ছোটবেলায় কিন্তু এমন হত না। স্কুলে পড়ার সময় প্রায়ই আম্মুর সাথে ঘুমোতে যেতাম। আম্মুর গা ঘেঁষে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। আস্তে আস্তে কীভাবে যেন দূরত্বটা তৈরি হয়ে গেল। আম্মু যেদিন প্রচণ্ড ক্রোধে আমার ছবি আঁকার খাতাটা ছিঁড়ে ফেললেন, আর বললেন, রোজ বিকেলে তুমি ছবি আঁকতে যাও নাকি গাঁজা টানতে যাও আমি জানি—সেদিন থেকে আম্মুর সামনে আমি আর সহজ হতে পারি নি। নোবেলকে যখন এই কথা বলেছিলাম, ছেলেটা খুব আশ্চর্য হয়েছিল, তোর আম্মু তোকে এই কথা বলসে? দিস ইজ জাস্ট ইম্পসিবল, এ্যান্ড প্লিজ, আমাকে এই ধরনের উলটোপালটা কথা আর শুনাবি না। 

নোবেল এই কথা বলার পর আমি চুপ করে ছিলাম। আসলেই তো, দিস ইজ জাস্ট ইম্পসিবল। হিসাবের সমীকরণ অনুসারে এটা সম্ভব না। 

এজন্যই আমি হিসাব মেলাতে পারি না। 

কী অদ্ভুত, নোবেলের কথা মনে পড়তেই দেখি ছেলেটা হেঁটে হেঁটে আসছে। ভুলেই গিয়েছিলাম, শহীদ মিনারের ওপাশেই তো ওদের ক্যাম্পাস। ক্লাসশেষে হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই এদিকে চলে আসে ছেলেটা। ওকে দেখার সাথে সাথেই আমি ঠিক করলাম, আম্মুর কথাটা জানাবো না। কী হবে জেনে? 

নোবেল কাছাকাছি চলে আসার পর আমি খুশিখুশি গলায় ডাকার চেষ্টা করলাম, এই দাঁড়া! 

ছেলেটা বোকার মত চারদিকে তাকালো। এরপর আমাকে দেখে গম্ভীর হয়ে গেল, তোর সাথে আমার কথা নাই। 

—কেন? 

—গত এক সপ্তাহ তুই আমার সাথে কথা বলিস নাই! এভাবে ভিজছিস কেন? মনে রঙ লাগসে বেশি? 

আমি হাসার চেষ্টা করলাম। গলা দিয়ে কান্নার মত একটা শব্দ বের হয়ে এল। ছেলেটা সেটা খেয়াল পর্যন্ত করল না। আমার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, চা খাবি? উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, চল খাই। 

শহীদ মিনার থেকে দু কাপ চা নিলাম। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দোয়েল চত্বরের দিকে আগাচ্ছি, তখন আরেক দফা বৃষ্টি নেমেছে। আগের মত মুষলধারে না, টিপটিপ করে। নোবেল মাথা নিচু করে গুনগুন করে কী একটা গান গাইছিল, পাশের মানুষটা কাঁদছে না হাসছে—সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর এই স্বভাবটা বড় বিরক্ত লাগে আমার, হাঁটতে শুরু করার কিছুক্ষণের মাঝেই চুপ হয়ে যায়। অন্যদিন হলে খুব করে বকে দিতাম। আজ কিছু বলতে ইচ্ছে হল না। 

আচ্ছা, মারা যাওয়ার পর কি মানুষ সবকিছু দেখতে পায়? আম্মু যদি দেখতেন, আমি বৃষ্টি মাথায় করে একটা ছেলের সাথে হেঁটে বেড়াচ্ছি, তাহলে কী বলতেন? খুব একটা খুশী হতেন না। সেদিন ধ্রুবর জন্মদিনে যাওয়া নিয়ে কী কাণ্ডটাই না করলেন! ধ্রুব কে? তার জন্মদিনে তোমাকে দাওয়াত করবে কেন? আর তুমিই বা যেতে চাচ্ছো কোন সাহসে? তুমি কোথাও যাবে না, চুপ করে বসে থাকো। আর একবারও যাওয়ার কথা বলবে না। 

অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা হল, এই আম্মুই পালটে যেতেন, আমি যখন জ্বরে পড়তাম। কলেজে পড়ার সময় যখন টাইফয়েড হল, আম্মু দিনরাত মাথার কাছে বসে থাকলেন। আব্বু এসে যখন বললেন, তুমি ঘুমাতে যাও, আমি রিচির পাশে বসে আছি—তখনও আম্মু গেলেন না, আমার পাশে বসেই থাকলেন। একটু পরপরই বলতেন, কষ্ট হচ্ছে রে মা? এই তো সেরে গেল। জলপট্টি দিবো? খাওয়ায় দেই এখন? 

আমি চুপ করে শুনতাম। খুব বলতে ইচ্ছে হত, হ্যাঁ আম্মু, খাইয়ে দাও। 

বলতে পারতাম না। আম্মুকে যেমন কোনদিন ‘তুমি’ করে ডাকতে পারি নি, তেমনই বড় হওয়ার পর আবেগের কথাগুলোও বলতে পারি নি। 

বেশিক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। হিসাব মেলাতে পারছি না। আমার ধারণা আমি আম্মুকে ভালোবাসতাম না, কিন্তু ভালো না বাসলে এভাবে বারবার কেঁদে ফেলছি কেন সেটাও বুঝতে পারছি না।

সন্ধ্যে নামছে। নামুক। গাঢ় করে রাত্রি নামুক। অন্ধকারে ঢেকে যাক সবকিছু। আমার ভেতরে কী চলছে সেটা নিজেই যখন বুঝতে পারছি না, অন্যরা বোঝার চেষ্টা করে লাভ নেই।

—রিচি
জুন, ২০১৬