পোস্টগুলি

2018 থেকে পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে

সন্ধ্যাপ্রদীপ

ছবি
সেঁজুতি কোথায়, কে জানে। আমি জানি না।  মেয়েটা কেমন আছে, সেটাই বা কে জানে! আমি জানি না।  শেষ কবে বেচারার সাথে ঠিকমত কথা বলেছি মনে পড়ে না। তবে প্রথম যেদিন বলেছিলাম, বেশ মনে আছে সেই কথা। অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলাম বাচ্চাটার ওপর। মনে হচ্ছিল, এমন নেকু নেকু বাচ্চাদের সাথে কাজ করা বড় মুশকিল। পরে জেনেছি, এই বিরক্তিটা ছিল দ্বিপাক্ষিক। সেঁজুতিও ভেবেছিল, এইসব আঁতেল-টাইপ ভাইদের সাথে কাজ করবো কীভাবে!  অনেক পরে, আমাদের যখন এই বিষয়টা নিয়ে কথা হয়, তদ্দিনে আমরা একটু করে বুড়ো হয়েছি, বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ঋদ্ধও হয়েছি, এবং আমরা গেছি অলৌকিক কিছু প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, ফলে দ্বিপাক্ষিক বিরক্তির কথা শুনে আমি হেসে ফেলি, এবং সেঁজুতি হাসে তার ত্রিগুণ, হেসে কুটিকুটি হওয়ার আগ পর্যন্ত সে থামতে চায় না!  আমার মনে পড়ে না, যেই মেয়েটার ওপর আমি অত্যন্ত বিরক্ত ছিলাম, সে কীভাবে অত দ্রুত আমার ডান হাত হয়ে উঠেছিল। হিসেব কষে এসব বের করা যায় না, আমি বারবার বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু এই বিভ্রান্তির মাঝেও আমার বারবার মনে পড়ে সেইদিনের কথা, যে রাতে সেঁজুতি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একটা ঘোরের জগতে চলে যায়। আমি তাকে মেইল দি

নন হোমোজিনিটি ও আমাদের শহীদুল জহির

ছবি
কিছুদিন আগে নন-হোমোজিনিটি নামটা প্রস্তাব করতে গিয়ে লিখসিলাম, এ পর্যন্ত যত বইপত্র পড়সি সবই হোমোজিনিয়াস ধরনের। এবং আশ্চর্য এই যে, এই কথাটুকু লেখার পরদিনই আবিষ্কার করলাম আমি আসলে নন-হোমোজিনিয়াস লেখা পড়সি, এবং সেটা খোদ শহীদুল জহিরের উপন্যাসে!  শহীদুল মানুষটা মারা গেসেন অনেকটা অসময়েই, এবং লিখসেন সেই তুলনায় আরও সামান্য। বেঁচে থাকতে মোটে তিনটা উপন্যাস প্রকাশ করসিলেন, চতুর্থটা বের হয় উনি মারা যাবার পর।  আমি দেখার চেষ্টা করসি তার এই চার উপন্যাসে নন-হোমোজিনিটি কীভাবে ধীরে ধীরে প্রবেশ করসে, কিংবা আদৌ করসে কিনা।  ১. জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮)  এটা শহীদুলের লেখা প্রথম উপন্যাস। শাহাদুজ্জামান একবার জিজ্ঞেস করসিলেন তাকে, এত সুন্দর একটা উপন্যাসের এমন কাট্টাখোট্টা নাম কেন। শহীদুল এমন একটা উত্তর দিসিলেন—উপন্যাসটা যখন লেখা হয়, তখন দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি অত্যন্ত বিষণ্ন ও হতাশ ছিলেন, কাজেই উপন্যাসের নাম নিয়ে কাব্য করার মানসিকতা ছিল না।  এটা কেবল প্রথম উপন্যাসই না, এটা প্রথম কোনো লেখা—যেখানে আমরা শহীদুলকে শহীদুল হয়ে উঠতে দেখি। এর আগে লেখা গল্পগুলো সুন্দর ছিল, কিন্তু শহীদু

বাংলা গদ্যসাহিত্যে নন-হোমোজিনিটি

ছবি
হোমোজিনিয়াস কী  “নোবেল, দয়া করে ওদের হাত-পা ধরে একটা জিনিসই বলবি, লেখাগুলো যেন হোমোজিনিয়াস হয়!”  ইবরাহিম ভাই এই কথাটা বলসিল, বেশ অনেকদিন আগে। যেহেতু হোমোজিনিয়াস লেখার জন্য সে হাত-পা পর্যন্ত ধরতে বলসে—কাজেই বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা একটু গুরুত্বপূর্ণই হবে।  হোমোজিনিয়াস শব্দটা অনেক অর্থই বোঝাতে পারে। তবে সহজ করে বললে বলা যায়, লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একইরকম হলে সেই লেখাটা হল হোমোজিনিয়াস লেখা।  একইরকম মানে কী!  এটার অর্থ বেশ ব্যাপক। যেমন,  আমি এই লেখায় করসি, গেসি, খাইসি -র মত শব্দ ব্যবহার করতেসি, অর্থাৎ আমি লিখতেসি কথ্যভাষায়। শেষ পর্যন্ত যদি আমি কথ্যভাষাতেই লিখতে থাকি—তাহলে এই লেখার শুরু থেকে শেষ একইরকম , অর্থাৎ হোমোজিনিয়াস।  আরেকটা উদাহরণ দেই—  ইংরেজি S-এর মত উচ্চারণ বোঝাতে আমরা ছ এবং স —দুটোই লিখি। আকিব লেখে ছ , আমার পছন্দ স । ফলে ওর আর আমার সংলাপগুলো হয় এমন— আকিব: ভাই আমার কাজ শেষ হইছে, ক্যাম্পাসে আসতেছি। কী করতেছেন? আমি: কিছু করতেসি না, একটু আগে পরীক্ষায় বাঁশ খাইসি। চলে আয়। আমি যেহেতু এই লেখায় আমার পছন্দমত করসি, গেসি, খাইসি বানানে লেখা শুরু করসি

আমাদের Die Verwandlung-এর ইতিহাস

ছবি
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের লোকেরা সেই ভোরের কথা স্মরণ করে, যেদিন সকালে প্রথম রিকশার ক্রিরিং ক্রিরিং বেল শুনবার আগেই তারা কুত্তার ডাক শুনতে পায়, এবং পৃথিবীর সকল কুত্তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে তারা আবারও পাশ ফিরে শোয় এবং ঘুমিয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে ভোরবেলা কুত্তার এই ডাক এবং এর বিপরীতে নাজিমউদ্দিন রোডের লোকের প্রতিক্রিয়া যথাক্রমে নাজিমউদ্দিন রোডের লোক এবং কুত্তার কাছে স্বাভাবিকতম ঘটনা বলে মনে হয়, ফলে রাস্তা বরাবর কার্জন হলের দিকে কুত্তা দৌড়াতে থাকে, লেজ গুটিয়ে, জিহ্বা বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে শহীদুল্লাহ হলের গেটে এসে খানিকক্ষণ বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, পা দিয়ে কান চুলকায়, এবং পরমুহূর্তেই ভেতরে ঢুকে পড়ে, পুকুরঘাটে যেতে যেতে তার গতি ধীর হয়ে আসে, কেননা এই সময়ে তার গত রাতের কথা মনে পড়ে, এবং ভোরবেলা উঠে আরিফুজ্জামান আরিফ নিজেকে বাদামি রঙের কুত্তা হিসেবে আবিষ্কার করে।  সেই সকালে যারা শহীদুল্লাহ হলের পুকুরঘাটে আরিফুজ্জামানকে বসে লেজ নাড়াতে দেখে তারা বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যায়, এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলে, এমনটা যে ঘটবে তারা আগ

ইমপ্রেশন: স্বপ্ন (শ্রবণা ২৫:১)

ছবি
এবং তার মনে হয়, সে যেন স্বপ্নের মাঝে সন্ধ্যা দ্যাখে। বাসার বারান্দায় দাঁড়ায়ে সে ঘন নীল সন্ধ্যা নেমে আসতে দ্যাখে, বিষণ্ন সেই সন্ধ্যায় টুপুরটাপুর বৃষ্টি নামতেও দ্যাখে। হয়তো পাশের বাসার জানালা দিয়ে আসা হলুদ আলো সেই নীল সন্ধ্যার বিপরীতে তার মনে এক ধরনের চিত্রময়তার জন্ম দেয়, এবং তার মনে হয়, যেন পাশের বাসায় কেউ একজন মরে গেছে।  এবং মৃত মানুষটার পরিচয়ও সে তৎক্ষণাৎ জানতে পারে। ফলে তার ভেতরে এক গভীর হাহাকার জন্ম নেয়, কান্নায় রীতিমত কাঁপতে কাঁপতে সে জেগে ওঠে।  অথবা এর সবই হয়তো মিথ্যা—বস্তুত সে কখনই জেগে ওঠে নাই—কেননা কান্নার ভেতরে জাগরণটাও হয়তো স্বপ্নের অংশ। সুতরাং সে স্বপ্নের গভীর থেকে গভীরে ডুবতে শুরু করে, এবং সে বুঝতে পারে, এই নীল সন্ধ্যায় পাশের বাসার হলুদ আলোর ভেতরে কেউ মরে গেছে, এবং সেখানে যেতে চাইলে এই বৃষ্টির মাঝে বাসার পিচ্ছিল দেয়াল বেয়ে উঠতে হবে।  অদ্ভুত—জেগে ওঠার পর সে ভাবে—সিঁড়ি-সিঁড়ি বাসায় কেন তারে দেয়াল বেয়ে উঠতে হবে?  কখনো ধুলাময় গ্রিল ধরে ঝুলে, কখনো শ্যাওলাময় সানশেডে পা হড়কাতে-হড়কাতে, কালিঝুলমাখা নব্বই দশকের সরকারি কলোনির নোনা দেয়াল বেয়ে ওঠার কাজটা বাস্তবে যেমন অস

কাকচক্ষু বুড়িগঙ্গা

ছবি
আমার মাঝেমধ্যে সমুদ্রে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে।  আমি বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই। অন্ধকার ঘরে বসে, রৌদ্রোজ্জ্বল রাজপথে দাঁড়িয়ে, দুঃখতম দুঃখের ভেতরে আমি প্রবল বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই।  এবং আমার ইচ্ছে করে সমুদ্রে ডুবে যেতে। সমুদ্রের গভীর, সুস্বাদু অন্ধকারে এক ঘাস হয়ে জন্মাতে।  আমি রক্তের কথা শুনি। আমি রক্ত দেখি। একসময় আমি অন্ধ হয়ে যাই, পুরো পৃথিবীর গায়ে লেগে থাকা ছোপ ছোপ রক্ত আমাকে অন্ধ করে দেয়, আমি চিৎকার করে চোখ থেকে রক্ত মোছার চেষ্টা করি।  আমি গাড়লদের রাস্তার ড্রেনের পাশে বসে মাথার খুলিটা খুলে ফেলতে দেখি। ড্রেন থেকে আবর্জনা তুলে তুলে মাথায় ভরতে দেখি। আমি দেখি তাদের হা হা করে মানুষের দিকে তেড়ে যাইতে, মানুষের বাচ্চার দিকে তেড়ে যাইতে। আমি দেখি তাদের মানুষ চাবায়ে খায়ে ফেলতে, আমি শুনি তাদের—  না, এরপর আমি আর শুনতেও পারি না, কেননা আমার মনে হয় আমার সারা গায়ে কালি লেগে গেসে।  স্কুলব্যাগ ঘাড়ে একটা পিচ্চিকে দেখলে আমার অথৈয়ের কথা মনে পড়ে, কিংবা কে জানে, হয়তো ফারহার কথাই মনে হয়, কিংবা হতে পারে সেটা রাহাত, হয়তো সৌমিক। ফলে বছরের একেকটা সময় পত্রিকা খুলে আমি আতঙ্কে অধীর হয়ে যাই, ঘরে-ব

ঢাকার মানভাষা, ঢাকার ভাষা এবং ঢাকার অপমানভাষা

ছবি
এক.  তনু আপু এক সকালে দারুণ উৎসাহ নিয়ে আমাকে ঝাড়ি দিচ্ছিলেন।  আমি তখন কচি নধর শিশু, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। কলেজ-জীবনে চোখে ভারী চশমা এঁটে কেবল কাগজপত্রই ঘেঁটে গিয়েছিলাম, সুতরাং আমার সত্যিকারের পৃথিবী দেখার শুরুটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে। বেশ কাদা-কাদা একটা মাটির তাল ছিলাম, মানুষ যা বলতো সব কেবল কানভরে না, প্রাণভরেও গ্রহণ করতাম!  তো, সেই সকালে তনু আপু বলছিলেন, আমি যেন ‘করসি-গেসি’-জাতীয় অপ্রমিত-ভাষায় না লিখি—কেননা অরিত্রদের মত ছোট মানুষেরা আমাদের দেখেই ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, এবং ওদের সামনে একটা সুন্দর আদর্শ দাঁড় করানো উচিত।  আদর্শ দাঁড় করানোর ব্যাপারটা আপু এত সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, পরবর্তীতে আমার বহু মানুষকে কথাটা বলতে হয়েছে।  কিন্তু, আদর্শ আসলে কী?  ছোট পরিসরে, কেবল ভাষার আদর্শের কথাই যদি ভাবি, মানভাষায় না লিখলেই কি বাংলা অশুদ্ধ হয়ে যায়?  দুই.  আমার তা মনে হয় না।  বাংলা ভাষার প্রমিত রূপটা আমরা পাইসি তুলনামূলকভাবে দেরিতে—ব্রিটিশ আমলে। কলকাতা বাংলার রাজধানী হবার পর সবাই যখন সেখানে জড় হতে শুরু করলো—তখন সবার বোঝার মত একটা প্রমিতভাষা (বা মান

এলোকথন (আষাঢ়া ২৫:২)

ছবি
শেষবিকেলে, সন্ধ্যে নামার আগে আগে রাস্তায় হাঁটছিলাম। এক চাচাকে বাসে তুলে দিয়ে ঘরমুখো হতেই আবিষ্কার করলাম, বিকেলটা অসম্ভব সুন্দর। এই বাতাসে যতখানি জল ধরার কথা তার চাইতে ইকটুউ বেশি আছে, সুতরাং এদিক-ওদিক জলের কণা হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে এর-ওর গায়ে পড়ছে। মানুষজন এতে বিরক্ত হচ্ছে না, বরং বেশ আরামই পাচ্ছে মনে হয়।  বিকেলে স্নান করে বেরিয়েছিলাম, হয়তো একারণেই পবিত্র একটা অনুভূতি হচ্ছিল। বাসার ঢিলেঢালা জামা পড়ে বেরিয়ে পড়ায় ফুরফুরে একটা ভাব কাজ করছিল। আপনমনেই এলাকার রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। চমৎকার কিছু ফাঁকা রাস্তা আছে আমাদের এদিকে—খেয়াল করিনি আগে। কী মিষ্টি গন্ধ তার ফুটপাথে, মধ্যিখানে, প্রতিটা মোড়ে!  আমি বোধহয় পাগল—কেননা আমার রাস্তা ভালো লাগে। রাস্তার এক কোণে চায়ের দোকানে বসে থাকা প্রৌঢ় লোকটাকে দেখে আমার মনে বিচিত্র কিছু বোধ কাজ করে। কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিজেকে জনশূন্য অন্য কোনো রাস্তায় আবিষ্কার করে আমি বিস্মিত হই। কখনো দু হাত পেছনে জড় করে, কখনো এক হাতে বই ধরে, কখনো অন্য হাতে হাত ধরে হাঁটতে গিয়ে আমার নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে হয়।  ফলে এইসব মুহূর্তের ঝোড়ো হাওয়ায় একের প

এলোকথন (আষাঢ়া ২৫:১)

ছবি
আমি জানি, এইসব এলোকথন একদিন ছাই হয়ে উড়ে যাবে, আর সেই ছাই থেকে জন্মাবে আরো এক রাশ ছাই। ছাইয়ের ধুলা, আমার প্রতিটা দীর্ঘনিশ্বাসের ধুলা, চোখের অজান্তে ভেতরে ঢুকে যাওয়া ধুলা—সকল ধুলা উড়ে বেড়াবে ধুলাময় এই শহরের আকাশে। দেহহীন মাথাগুলো গোলটেবিলের দশপাশে জড় হয়ে ভাবতে বসবে এ থেকে মুক্তি কোথায়, অন্যদিকে মাথাহীন দেহগুলো ধুলারে মেরে মেরে কাদা করে দিতে থাকবে, প্যাঁচপেঁচে সেই কাদায় ডুবে দেহরা চিৎকার করবে, প্যাঁচপেঁচে সেই কাদায় না-ডুবে মাথারা চিৎকার করবে, ফলে নিশ্চিতভাবেই তারা কাদা-সমস্যায় আক্রান্ত হবে।  কেননা এইসব এলোকথন একদিন ছাই হয়ে উড়ে যাবে, আর কে না জানে, ছাই থেকে কেবল ফিনিক্সই জন্মায় না, কখনো জন্মায় কেবল আরেক রাশ ছাই।  তখন সেক্রেটারিয়েটে কার্পেট বিছানো অফিসে বসে দেহহীন মাথার মনে পড়বে, বস্তুত ছাই থেকে ফিনিক্স জন্মায় না, ফিনিক্সই খানিকক্ষণের জন্যে ছাই হয়ে যায়। এবং ক্রমান্বয়ে সে মাথা তুলে উঁকি দেয়, পাখা তুলে ঝাপটা দেয়, একসময় উড়ে যায়, পেছনে পড়ে থাকে তার ছাইটুকু।  সেক্রেটারিয়েটের সুগন্ধ-কফিতে চুমুকের পর চুমুক দিয়ে দেহহীন মাথা হিসাব মিলাতে থাকবে, কিন্তু ধুলোময় শহরে উজ্জ্বল ডানা মেলে উড়তে

ভাষা এবং বোধ

ছবি
বোধ শব্দটা ব্যাখ্যা করিতে গিয়া আমরা সচরাচর জীবনবাবুকেই স্মরণ করিয়া থাকি। তিনি প্রসঙ্গটা তুলিয়াছিলেন এইভাবে—  আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে  স্বপ্ন নয়,—কোন্‌ এক বোধ কাজ করে!  স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,  হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!  অর্থাৎ প্রায়শই আমরা কিছু অনুভূতির দ্বারা তাড়িত হই—যাহাদিগকে আমরা আমাদের প্রচলিত ধারণা (স্বপ্ন, শান্তি, হয়তো ভালোবাসা) দিয়া সংজ্ঞায়িত করিতে পারি না। সেক্ষেত্রে আমরা বোধ শব্দটার আশ্রয় লই। অদ্য সন্ধ্যায় আমার অভ্যন্তরে এক ধরনের বোধ জন্ম নিয়াছে—এই কথাটার অর্থ হইল, অদ্য সন্ধ্যায় এমন কোনো অনুভূতি আমাকে তাড়িত করিয়াছে—যাহার সহিত আমার পূর্বপরিচয় ছিল না, কিংবা থাকিলেও উহাকে আমি ভাষার দ্বারা ব্যাখ্যা করিতে পারিতেছি না।  ইহা বোধের খুব গুরুত্বপূর্ণ একখানা বৈশিষ্ট্য—সচরাচর বোধের এই অনুভূতিগুলো অপার্থিব হইয়া থাকে, এবং আমরা ইহাকে সরাসরি ভাষার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করিতে পারি না।  উল্লেখ্য, অকারণ-দুঃখ, যাহাকে ইংরেজিতে ডাকা হয় melancholia —তাহার সহিত ইহার স্পষ্ট পার্থক্য রইয়াছে। সব মেলানকোলিয়াই বোধের জন্ম দেয় না, এবং প্রায়শই বোধের পেছনে যেই কারণ কার্যকর

আবু তালেবের উপাখ্যান

ছবি
আমরা পেছন ফিরে তাকাবো, এবং কে জানে, হয়তো ২৩ এপ্রিল, ১৬৮২-তেই আমাদের দৃষ্টি পড়বে।  আমরা দেখবো, বুড়িগঙ্গার পাড়ে বড়সড় কোনো অশ্বত্থ গাছের নিচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ধরে নিবো, তার নাম লাল মিয়া।  এপ্রিলের ঐ দিনটাতে হয়তো খুব একটা গরম থাকবে না। কারণ বিক্রমপুরের উপকণ্ঠে ঢাকা নামের এলাকাটাকে হয়তো আমরা জঙ্গলাকীর্ণই দেখবো, সে হয়তো অজস্র আমের মুকুলের ঘ্রাণে আর বুড়িগঙ্গার বয়ে আনা শীতল বাতাসে লাল মিয়ার পরানডা জুড়ায়ে দিবে।  তবু আমরা লাল মিয়াকে ঘামতে দেখবো। অকারণেই বারবার ধুতির খুঁট তুলে মুখ মুছতে দেখবো।  কাজেই আমরা অনুমান করবো, লাল মিয়া বড্ড চিন্তা করে। হ্যায় কী জানি ভাইবা ভাইবা চোখমুখ ঘামায়া ফালায়।  এবং আমরা ১৬৮২ সালের কোনো এক দিনে, হয়তো ১৫ মেই হবে সেটা, সেই দিনটার দিকে যখন দৃষ্টিপাত করবো, তখন বুড়িগঙ্গার তীরের অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লাল মিয়ার দিকে আমাদের দৃষ্টি পড়বে, এবং আমরা অকারণেই তাকে ঘামতে দেখবো। আমরা কৌতূহলী হয়ে তার দিকে একটু এগিয়ে যাবো। আমরা বিড়বিড় করে তাকে বলতে শুনবো,  আবু তালেবের বাড়িত যামু  শাগ-ডাইল আর বিনুন খামু।  সুতরাং আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়বো

শায়েস্তা খাঁয়ের দুর্গ এবং আমাদের বোধ

ছবি
এক.  শায়েস্তা খাঁয়ের নামের সাথে যে কথাটা রীতিমত চুইংগামের মত লেগে আছে সেটা হল, তাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেতো। ব্যাপারটা খুবই কৌতুককর—বেচারা শায়েস্তা খাঁ ঢাকার জন্য এত কিছু করে গেলেন—সব বাদ দিয়ে আমরা মনে রাখলাম কেবল চালের দরের জন্য!  গতকাল লালবাগ দুর্গে ঢুকে এ কথাটা বারবার মনে পড়ছিলো। ঢাকার প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনও কোনোমতে টিকে আছে—তার একটা এই দুর্গ। এবং এর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে যার নাম তিনি হলেন মির্জা আবু তালিব ওরফে রুকুন-উস-সুলতান আমির-উল-উমেরা নওয়াব শায়েস্তা খাঁ বাহাদুর।  দুই.  শায়েস্তা খাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিলো শাস্তি হিসেবে। তখন সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসন চলছে। শায়েস্তার কোনো এক কাজে ক্রুদ্ধ হয়ে সম্রাট তাঁকে ঢাকায় বদলি করে দেন। ব্যাপাটা মোটামুটি অনুমান করা যায়, ১৬৬৪ সালে ঢাকার তেমন কোনো আহামরি অবস্থা ছিলো না, রাজধানীর মর্যাদা পাওয়ার পরেও। ঢাকা ছিলোই বা কতটুকু—বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ছোট্ট একটু জায়গা নিয়ে কিছু মানুষ থাকতো। সরকারি কর্মকর্তাকে পাড়াগাঁয়ে বদলি করে দিলে যেমন হয়—শায়েস্তাও নিশ্চয়ই অমন একটা অনুভূতি নিয়েই ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু এসে মুখ

এলোকথন (চিত্রা ২৪:২)

ছবি
আমি আজকাল লিখতে পারি না।  এতে আশ্চর্য হবার তেমন কিছু নেই। সত্যিকারের লেখক লিখবে, ভণ্ডরা লিখবে না—এটাই স্বাভাবিক। পুরো স্বাভাবিকতার মাঝে একমাত্র সমস্যা হল, আমার লিখতে না পারলে খারাপ লাগে। আর কিছু না হোক, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে আমার ডায়েরি লিখতে হয়। এলোকথন শিরোনামে এলোমেলো কথাবার্তা লিখতে হয়। কখনো হালকা গল্প, কখনো ভারী গল্প বানাতে হয়। তবেই আমি শান্ত থাকি। রাত্রিবেলা ঘুমোতে পারি, সারাদিন শরীরটা ঝরঝরে থাকে।  ক’মাস হল, এর কোনোটাই ঠিকমত হচ্ছে না। খ্যাপার মত দিনরাত বই পড়ছি, শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি, আড্ডা দিচ্ছি—কিছুই কাজ করছে না। ঘুরছি শহরের বাইরেও। কেবল গত তিন মাসে যত ঘুরেছি—সারা জীবন অতখানি ঘুরেছি কিনা সন্দেহ আছে। কখনো মন ভালো করছি, হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছি, আবার তীব্র বিষাদে আক্রান্ত হয়ে চুপ করেও বসে থাকছি।  কাজ হচ্ছে না কিছুতেই।  অর্থাৎ আমি লিখতে পারছি না। অথচ এ ব্যাপারটা এখন সবচেয়ে বেশি ঘটার কথা। এই গত বছরেও, প্রতিটা নতুন বোধের সাথে কিছু না কিছু লিখে ফেলতাম—বাচ্চাদের মত করে হলেও। সে হিসেবে গত তিন মাসে যতখানি ঘাত-অভিঘাত পার করেছি—ওতে তো লিখে কূল পাবার কথা না!  আচ

এলোকথন (চিত্রা ২৪:১)

ছবি
চৈত্রের প্রাকমুহূর্তটা সময়ে সময়ে খুব নির্মম হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো আমরা শহরের চেনা পথটা ধরে হাঁটি, হয়তো প্রেসক্লাবের সামনের একটা বাসে ঝুলতে থাকি, কিংবা ব্যস্ততম রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করি, এবং ঠিক তখনই চৈত্রের বাতাস এসে একটা ঝাপ্টা দিয়ে যায়।  কখনো মুহূর্তের জন্য, কখনো দীর্ঘক্ষণের জন্য।  এতে কিছু এসে যায় না, কারণ বাতাসের প্রথম স্পর্শেই আমরা আনমনা হয়ে যাই। পুরো পৃথিবীটা জলরঙে আঁকা একটা ছবির মত মনে হয়। আফ্রেমভের উজ্জ্বল রঙ না, তোহফার দুঃখ-মেশানো হালকা রঙ।  হাতে থাকা বইটাতে চোখ বোলানোর চেষ্টা করি। শব্দগুলো আমাদের চোখ পর্যন্ত আসে, মর্মে পৌঁছে না। হেডফোনজুড়ে হ্যারিসন অলৌকিক কিছু কথা আওড়াতে থাকে। শব্দগুলো আমাদের কান পর্যন্ত আসে, মর্মে পৌঁছে না।  অর্থাৎ আমরা একটু আনমনা হয়ে যাই।  এবং এইসব মুহূর্তে আমার অনিকের কথা মনে পড়ে। কলেজ-পরবর্তী জীবনে তার প্রতি আমার নির্বিকারত্বের কথা আমার মনে পড়ে।  এবং অমন নির্বিকারত্ব সন্দেহাতীতভাবে ছিল একটা পাপ। এই পাপের প্রতিফল কীভাবে আসবে—সে কথাও আমার ভাবতে ইচ্ছে করে।  যদিও ভয় লাগে। ইচ্ছে করে, ছুটে যাই।  জানি, যাবার জায়গা