আধবুড়ো

অরিত্র জেগে উঠলো একশো হাজার বছর পরে। 

কোথা থেকে যেন একটা হালকা বাতাস আসছে। বাতাসের ঘ্রাণ নিলেই বলে দেয়া যায়, রাত্তির এতক্ষণে মেঘে ঢেকে গেছে। এই যেন বৃষ্টি নামবে, তবু নামবে না। তবু শহরের মানুষগুলো একটু দৌড়াবে—যদি বৃষ্টি নামে? 

অরিত্র ছটফট করে উঠলো। কোথাও যাওয়ার কথা—কিন্তু কোথায়? 

পাশের ঘরে কে যেন কাকে ধর্মকথা শুনিয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না, কেমন যেন ছন্দে ছন্দে ভেসে ভেসে আসছে। কেমন একটা ঘুম ঘুম ছন্দ। ইচ্ছে হয়, আরও একবার ঘুমিয়ে পড়ি। বৃষ্টির নিচে শুয়ে একশো বছরের একটা ঘুম। অন্নপূর্ণা দেবীর নোটের মত বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছুটে আসবে, চার হাতে চার মুদ্রা করে নাচবে। অরিত্র ঘুমের মাঝে তার স্পর্শ শুনবে, অরিত্র স্বপ্নের মাঝে তার শব্দ দেখবে। 

তবু, ঘুমানোর তো কথা না, কোথাও যাওয়ার কথা। 

কিন্তু কোথায়? 

হঠাৎ বিছানায় ফোনটা বেজে উঠতেই অরিত্র একেবারে ধড়মড় করে উঠে বসলো। মা ফোন দিচ্ছে নিশ্চয়ই। ফোন ধরলে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে, একশো হাজার বছর একটা মানুষকে কেন ঘুমিয়ে থাকতে হয়? 

অরিত্র তো এর উত্তর জানে না। তবু একটা আদিম ভালোবাসার কারণে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। 

‘হ্যালো, আম্মু!’ 

‘তুমি ঘুমিয়ে ছিলে?’ 

‘হুম!’ 

‘এই সন্ধ্যাবেলা ঘুমাচ্ছো কেন আব্বু?’ 

‘জানি না আম্মু। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি—সেটাও জানি না।’ 

কথা বলতে বলতে অরিত্র টের পেলো, ঘুমের ঘোরটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। কোথায় ছিল এই গন্ধ এতক্ষণ? অরিত্রর ইচ্ছে হল, কথা থামিয়ে দু মিনিট বুক ভরে কেবল নিশ্বাস নেয়। 

‘অরিত্র?’ 

‘শুনছি মা—’ 

‘বাসায় ফিরবে আজ?’ 

‘ফিরতেই তো চাই, কিন্তু রাত নামছে যে!’ 

‘সেটাও কথা। সকালে চলে এসো তাহলে, কেমন?’ 

সকালে? নিশ্চয়ই, অরিত্র নিশ্চয়ই সকালে ফিরবে। ফিরবো বললেই ফেরা যায় না, তবু ফিরবে। 

তবু, ইচ্ছে কি করে না রাত্তিরেই ফিরতে? সেই পুরনো ঘর, সেই পুরনো চাদরে গা এলিয়ে দিতে? 

তবু—যদিও লজ্জা লাগে মাকে বলতে—ইচ্ছে কি করে না আম্মুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যেতে? যেন এই রাত্রির শেষে ভোর আছে! ঘুমটা ভাঙলেই ঝলমলে আলো দেখা যাবে, রেডিওতে বাজবে হেমন্তের গান, আম্মু পনিটেল চুলে টুং টাং শব্দে ঘরের কাজ সামলাবে। ঘরময় আলো আর গানের মত ছড়িয়ে থাকবে মা। অরিত্র প্রাণ ভরে শ্বাস নিবে, সেই নিশ্বাসের সাথে একটু করে আলো, একটু গান, একটু আম্মু ভেতরে যাবে। 

ঘুম ভাঙার পর হালকা জ্বর-জ্বর লাগছে। এই জ্বরে জ্বর নামবে না, কেবল প্লাবন ঘটিয়ে আসবে একটা মেলানকোলিয়া। 

ইচ্ছে করবে, গভীর সুস্বাদু নরম একটা অন্ধকারে ডুবে যেতে। 

রুমমেট দুজন আজ রাতে ফিরবে না। অরিত্র একাই ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে। এক কোণে, কাঁথার নিচে জড় হয়ে। 

খুব ভূতের ভয় লাগতো ছোটবেলা। অরিত্রর জানালার পাশে থাকতো আগুনমুখো ভূত, খাটের নিচে হাত বাড়িয়ে থাকতো ব্রহ্মদৈত্য। ঘরের বাতি নিভিয়ে ভয়ে অস্থির হয়ে যেতো সে। 

অরিত্র কাঁথার নিচে ঢুকে পড়তো। যেন কেউ জড়িয়ে আছে, ভয়টা কেটে যেতো। 

কেন ভালো লাগে কাঁথার নিচে অমন ছোট হয়ে থাকতে? 

আদিম একটা অনুভূতি কাজ করে হয়তো। মাতৃগর্ভের খানিকটা স্মৃতি থেকে যায় হয়তো কোথাও। মনে হয়, আম্মুর ভেতর জড়সড় হয়ে শুয়ে আছি। রক্তের স্রোতের সাথে বার্তা আসছে, ভয় নেই, ভয় নেই। 

অরিত্রর ইচ্ছে করে জন্ম-আদিম সেই মাভৈঃ ডাক শুনতে। 

সদ্য সন্ধ্যা পেরোনো এই রেশিওনাল রাত্তিরে কেবল শোনা যায় হলের এলোমেলো কণ্ঠ। 

গর্জন করে কাছেই কোথাও বাজ পড়লো। প্রায় সাথে সাথেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। এই লোডশেডিং শেড বসিয়ে যাবে একের পর এক। প্রথমে নৈঃশব্দের শেড, এরপর রিমঝিম বৃষ্টির শেড, শেষরাতে তন্দ্রাচ্ছন্নতার শেড। 

অরিত্র কাঁথাটা আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে বসে। 

আজ রাতজুড়ে বজ্রপাত হোক ইন্দ্র, আজ বৃষ্টিজুড়ে স্বপ্নপাত হোক। সেই স্বপ্নলোকে দিশেহারা হয়ে থাকুক হলের সবকটা প্রাণী। 

“আমার খারাপ লাগলো, আজ আমার একটুও ঘুম হবে না। আম্মার ঘরে কী যেনো ফেলে এসেছি।” 

আমার ইচ্ছে করে ঘুমিয়ে পড়তে। 

মা কি জানে, একশো বছর হয়, আমি ঘুমাই না?