এবং আমাদের শেষ ম্যাচটি (যেটা আর দশটা ম্যাচের মতই সাধারণ!)

দীপ্ত দৌঁড়াচ্ছে, সর্বশক্তি দিয়ে, যতটা সম্ভব, যত দ্রুত সম্ভব সে দৌঁড়াচ্ছে, নিজের পুরো চেতনা সে তার দুই পায়ের বিক্ষেপের মাঝে কেন্দ্রীভূত করে, ঐ তো সামনেই তার লক্ষ্য, ঐ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই জয় তার সুনিশ্চিত, কিন্তু সে পারে না সেখানে পৌঁছাতে, দীপ্ত ব্যার্থ হয়, তার আগেই বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসে একটা ছেলে, সেই ছেলের হাতের মুঠোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা রক্তরাঙা টেনিস বলটা দীপ্তর চোখে পড়ে না, কিন্তু দীপ্ত জানে, ভালমতই জানে, তার ব্যার্থতাকে পরিপূর্ণতা দান করবে এই টেনিস বলটা, ভেঙে দেবে অদূরে থাকা স্ট্যাম্প, উল্লাসে মেতে উঠবে শাফিউল, রেদোয়ান, ফজলে, মোশফিকুর, সৃষ্টি, নাহিয়ান, স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীরতায় নিজের আবেগটুকু আটকে রাখতে ব্যার্থ হবে টিমের ক্যাপ্টেন আজোয়াদ, সে নিজেও তার দলের বাকি ছয়জনের আনন্দে যোগ দিবে, আর দীপ্তের দল মুষড়ে পড়বে হতাশায়, আশাভঙ্গের বেদনা তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করবে, সেই ক্ষতে কিছুটা সোডিয়াম ক্লোরাইড ছিটিয়ে দেবে বিজয়ী দলের উল্লাস, দীপ্ত নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, কিন্তু সে আর কিছুই করতে পারবে না, কিছুই না !!

শেষের আগে :
দুপুরের প্রচন্ড উত্তাপকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে স্কুলের বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে জড়ো হয়েছে কয়েকটা ছেলে। বাস্কেটবল খেলতে নয় অবশ্য, ক্রিকেট খেলার জন্য। স্যারদের চোখ এড়িয়ে (স্পেশালি সুলতান স্যার) ক্রিকেট খেলার জন্য এই বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের মত ভাল জায়গা আর হয় না ! প্রতিদিনের মত সেদিনও তুমুল চেঁচামেচি চলছিল সেখানে। এই সায়েম, তুই রানটা নিলি না কেন? easy single রে ভাই। আরে আশ্চর্য ! রান নিতে গিয়ে আমি এখন আউট হব নাকি? এরপর শেষের দিকে পিটাবে কে? আরে মুশফিক এই সহজ ক্যাচটা আবার তুই মিস করলি ক্যান। হাশেমি হাশেমি বলটা এইদিকে দে...এইদিকে এইদিকে তাড়াতাড়ি!!! ঐ ফয়সাল আরেকটু জোরে বল কর!! না, বাউন্সার দিবি না। 

......খেলা গড়িয়ে চলে। শেষ পর্যন্ত রান আর বলের সমীকরণটা যখন ৬ বলে ৭ রানে এসে দাঁড়ায়, তখন টিম ক্যাপ্টেন মুশফিকের মন নেচে ওঠে, সে ভাবে, আর চিন্তা কি, সায়েম আর দীপ্ত স্ট্রাইকে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে আছে চার চারটা উইকেট, এই সময় ৬ বলে ৭ রান তোলা কোন ব্যাপার? বিপক্ষের দলনেতা আজোয়াদ এগিয়ে আসে, বল তুলে দেয় নাহিয়ানের হাতে। পারবি? নাহিয়ানকে জিজ্ঞেস করে সে। নাহিয়ান হাসে। আরে বেটা, সায়েম ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে, সে সাতটা রান তুলতে পারবে না এক ওভারে? ম্যাচ তো আমরা হারেই গেসি, হাসতে হাসতে আজোয়াদকে বলে সে। কিন্তু আজোয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে সেই হাসি নিষ্প্রভ হতে হতে একসময় বিলীন হয়ে যায়, দুপুরের তীব্র রোদের প্রখরতা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, সেই প্রখরতায় আজোয়াদের চোখ দুটোও যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে, আমরা হারিনি এখনও, নাহিয়ানকে বলে সে। নাহিয়ান সহসা উপলব্ধি করে সেই কথাটা, তার স্মৃতিতে থাকা কিছু ঘটনা আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, হারার আগে যে হেরে যেতে নেই- এই কথাটা তো আজোয়াদই প্রমাণ করে দিয়েছিল, সেদিনও এমনই ঝিমঝিম দুপুর ছিল, শেষ ওভার, জেতার জন্য মাত্র দুই রান দরকার, সুপার হিটার জেনিন, যে আমাদের ক্রিস গেইল, ২০-২৫ বলে ৬২ রান করে স্ট্রাইকে দাঁড়িয়ে আছে, বল করছে আজোয়াদ, সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে, জেনিন তিন বলে দুইটা রান করতে পারবে না- এই কথাটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো তাই হল, পরপর তিনটা বল করল আজোয়াদ, একটা রানও হল না, হারার নিশ্চিত সমীকরণটা পাল্টে গেল অবিশ্বাস্য এক জয়ে, সেই জয় আজ এতদিন পর নাহিয়ানের মানসপটে আবার আকৃতি পেল, সেই আকৃতি রূপ নিল অদ্ভুত এক অনুপ্রেরণায়। নাহিয়ান মাথা ঝাঁকাল, বলল, চেষ্টা করি তাহলে!! আজোয়াদ বলে, হুম, চেষ্টা তো করবিই। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বল ফ্যাল ! নাহিয়ান বল করে, এক রান হয়, আবার বল করে, ডট বল, আবার বল ছুটে যায়, সায়েম ডাউন দা উইকেটে এসে খেলে, বল উড়ে চলে যায় তার গন্তব্যে, গন্তব্য তো একটাই, মাঠের সীমানার অন্য পার!! কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে পারার আগেই কোথা থেকে মোশফিকুর ছুটে চলে আসে, দুরন্ত গতিতে এসে বলটা লুফে নেয় সে, আর এরপর, মাঠের মাঝে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়, সাতটা ছেলের আনন্দের চিৎকার তো বিস্ফোরণই ঘটাবে!! চার বলে যখন ছয় রান লাগে তখন সায়েমের আউট হওয়াটা আনন্দ বৈ দুঃখের খবর তো নয় ! কিছুক্ষণ পর ওভারের চতুর্থ বলটা ব্যাটসম্যানের দিকে ছুটে যায়, আর বলটাকে বিপরীত দিকে ফেরত পাঠিয়ে দুটি সুনিশ্চিত রানের জন্য ব্যাটসম্যান দৌঁড়ায়। ভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য- এই সুনিশ্চিত রানকেই প্রথমে অনিশ্চিত, এবং শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ করে দিতে উল্কার বেগে ছুটে আসে আজোয়াদের ছোঁড়া বল, ফলাফল- কিপার ব্যাটসম্যান ফয়সাল গোল্ডেন ডাক!! শেষ পর্যন্ত, ইনিংসের শেষ বলটা করার জন্য যখন বোলার রেডি হল, আর শেষ বলটা খেলার জন্য অপর উইকেটে দাঁড়াল ব্যাটসম্যান দীপ্ত, তখন তাদের দরকার মাত্র চারটা রান। দুই দলে সাত-সাত চোদ্দটা ছেলের বুকে একটা শিহরণ বয়ে যায়। জয়ের উন্মাদনা কিংবা পরাজয়ের বেদনা বহন করার জন্য তারা মনে মনে প্রস্তুত হয়। বল করা হয়, বাতাসে একটা একরঙা রঙধনু সৃষ্টি করে বলটা ছুটে যায় দীপ্তর দিকে, দীপ্ত চোখ পিটপিট করে, ব্যাটসম্যান দীপ্তর একসময়ের সুনাম, যা এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে ব্যার্থতার আড়ালে, তা একটু হলেও ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনায় তার চোখ মুখ জ্বলে ওঠে, চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, সে যেন অনন্তকাল ধরে বলটা তার দিকে আসতে দেখে, আকাঙ্ক্ষার সাথে ভবিষ্যতকে মেলানোর লক্ষ্যে সে তার ব্যাট দিয়ে বলটাকে সজোরে আঘাত করে, বল চলে যায় অফসাইডে, যেখানে একটা ফিল্ডারও নেই দাঁড়িয়ে, তাই অনন্ত সম্ভাবনায় দীপ্ত রান নিতে পারে, একটি রান, দুটি রান, আহ, তৃতীয় রানটা নিলেই ম্যাচটা অন্তত ড্র করা যাবে, সেই লক্ষ্যেই দীপ্ত দৌঁড়ায়, সর্বশক্তি দিয়ে, যতটা সম্ভব, যত দ্রুত সম্ভব সে দৌঁড়ায়, নিজের পুরো চেতনা সে তার দুই পায়ের বিক্ষেপের মাঝে কেন্দ্রীভূত করে, ঐ তো সামনেই তার লক্ষ্য, ঐ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই জয় তার সুনিশ্চিত, কিন্তু সে পারে না সেখানে পৌঁছাতে, দীপ্ত ব্যার্থ হয়, তার আগেই বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসে একটা ছেলে, সেই ছেলের হাতের মুঠোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা রক্তরাঙা টেনিস বলটা দীপ্তর চোখে পড়ে না, কিন্তু দীপ্ত জানে, ভালমতই জানে, তার ব্যার্থতাকে পরিপূর্ণতা দান করবে এই টেনিস বলটা, ভেঙে দেবে অদূরে থাকা স্ট্যাম্প, উল্লাসে মেতে উঠবে শাফিউল, রেদোয়ান, ফজলে, মোশফিকুর, সৃষ্টি, নাহিয়ান, স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীরতায় নিজের আবেগটুকু আটকে রাখতে ব্যার্থ হবে টিমের ক্যাপ্টেন আজোয়াদ, সে নিজেও তার দলের বাকি ছয়জনের আনন্দে যোগ দিবে, আর দীপ্তের দল মুষড়ে পড়বে হতাশায়, আশাভঙ্গের বেদনা তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করবে, সেই ক্ষতে কিছুটা সোডিয়াম ক্লোরাইড ছিটিয়ে দেবে বিজয়ী দলের উল্লাস, দীপ্ত নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, কিন্তু সে আর কিছুই করতে পারবে না, কিছুই না !!

শেষের শেষে :
আমার এই লেখাটা অবশ্য অনেকের কাছেই একেবারে তুচ্ছ একটা লেখা। :D কিন্তু “আমাদের” কাছে না। কারণ, খুব সম্ভবত এটাই শেষ ম্যাচ- যেটা আমরা সবাই মিলে একসাথে খেলতে পারলাম। আর নিঃসন্দেহে, এটা আমাদের খেলা সেরা ম্যাচগুলোর মধ্যে একটা!! কী ঘটেনি এই ম্যাচে!! এক রানের জয় তো আছেই, এর উপর শাফিউলের আরেকটা অসাধারণ ইনিংস (যার শেষ বলে বিশাল একটা ছয় ছিল!), সৃষ্টির একের পর এক ক্যাচ ধরা (আর শাফিউলের সাথে সেই পার্টনারশিপটা!), আজোয়াদের সুপার-স্পিরিট (আর শেষ ওভারের ঐ “মামা থ্রো”টা!), এক ওভারে হাশেমির দুই দুইটা উইকেট নেয়া, রেডিও শুনতে শুনতে রাফির ফিল্ডিং মিস করা, মুশফিকের চিরচেনা ক্যাপ্টেন্সি ছাড়াও আরও কত কি!! যেই সায়েম আমার এক ওভারে চারটা ছয় মারে, সেই সায়েমেই আমার দুই বল খেলে আউট হয়ে গেল- এটাই বা কম আশ্চর্যের কি!! :P :D

আমরা এই কয়েকজন আসলে ক্রিকেটপাগল!! যখন খেলি আমরা, মনেই হয় না যে এটা একটা “খেলা”, আমাদের কাছে তখন এটা জীবনমরণ একটা ব্যাপার! এই লেখাটা পড়লে নিশ্চয়ই বুঝবেন ক্রিকেটের সাথে আমাদের আবেগটুকু কীভাবে জড়িয়ে আছে!! গত সাড়ে আট বছর ধরে একসাথে খেলতে থাকা আমরা হয়তো আর কখনই একসাথে এভাবে খেলতে পারব না, কিন্তু হৃদয়ে থেকে যাবে ছোট ছোট সেই মূহুর্তগুলো......বাস্কেটবল গ্রাউন্ড, কোপা সামসু ব্যাট, আমাদের ঝগড়া, খেলার সময় নজরুল স্যার চলে আসলে পালিয়ে যাওয়া, ক্লান্ত হয়ে গেলে কাছে পানি আছে সেটা খোঁজ করা, দল ভাগাভাগি করার সময় সায়েম আর জেনিনকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করা, জয়ের হাসি, পরাজয়ের কান্না......

সায়েম! আজোয়াদ! শাফিউল! মুশফিক! এহসান! রেদোয়ান! জেনিন! ফজলে! দীপ্ত! নাহিদ! সৃষ্টি! হাশেমি! রাফি! ফয়সাল! মোশফিকুর! মেসাল! শাওন! আর...ক্রিকেট!!

Cheers.