সেই ভুলে ভরা গল্প

সারাদিন কেবল হি হি খিক খিক করি তো, মাঝেমধ্যে ভুলেই যাই, মন খারাপ বলে একটা ব্যাপার আছে। ছোটখাট মন খারাপ না, ভয়াবহ ধরনের মন খারাপ। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সামনে যখন থাকি তখন তো এই কথাগুলো খুব বেশি ওঠে না। তাই তাদেরকে বলাও হয় না...একটা ছোট্ট দুঃখের গল্প। দুঃখগুলো তো ছোট-ছোটই! কিন্তু সমস্যা হল, ছোট মরিচের ঝাল বেশি।

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। পিচ্চি! তখনও এরকমই ছিলাম। দিনরাত খিক খিক করতাম। আর ব্লগিং করতাম। প্রথম-আলো ব্লগে। ঐ ব্লগে সব ছিল বিশাল বড়-বড় ভাইয়া আপু। মানে, আমার কাছে তখন এই ২০-২৫ বছরের মানুষকেই তো অনেক বড় মনে হত। এই বিশাল-বিশাল মানুষের মাঝে আমরা কয়েকজন পিচ্চি ছিলাম। আমি, আমার আপু, রূপ পিচ্চি, এ্যালানা পিচ্চি, ত্বাসিন পিচ্চি। আমরা বেশি ছোট ছিলাম দেখে বড় ভাইয়া-আপুগুলো দিনরাত আমাদের আদর করত!

সুরভী আপু ছিল। একেকটা কথা বলত, ছন্দে ছন্দে। আমি অআই ছদ্মনামে লিখতাম। তো, আপু এসে আমাকে বলে, অ-আ-ই, পদ্য লিখি, ই-আ-অ, হয় না পদ্য! আমি তখন ছোট মানুষ, এটা শুনেই হেসে কুটিকুটি!! লুকিয়ে লুকিয়ে একদিন ব্লগিং করছিলাম, নাজলা আপা হুংকার দিল, আমার আম্মুকে বলে দিবে! আর দেবুদা! সৈকত ভাই!! আমি একেকটা পোস্ট দেই, তারা এসে মন্তব্য করে ভাসিয়ে দেয়, তখন আমার কাছে কথাগুলো এমন কিছু মনে হত না, ওনাদের কথাগুলো স্বাভাবিক কথা বলেই মনে হত...কিন্তু এখন পড়তে গেলে বুঝি, কী আবেগ দিয়ে তারা একেকটা কথা বলত...চোখে পানি চলে আসে প্রায়।

কী যন্ত্রণা!

রূপ মেয়েটার কথা আলাদা করে বলি। এই মেয়েটার কারণেই নস্টালজিক হয়ে গেছি হঠাৎ করে। সত্যি বলতে কী, এই অবস্থা যে আমার একার— এমন কিন্তু না...রূপ যেই কথাগুলো বলেছিল আমাদের...সেই পাঁচ-ছয় বছর আগের কথাগুলো...সবাইকেই ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল...আমাদের চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল...অদ্ভুত...খুবই অদ্ভুত...। ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ে কীভাবে এতটা আবেগ দিয়ে লিখেছিল কে জানে।

সেই ভুলে ভরা গল্প।

আহারে...। ইথার ভাইয়া একেকটা কবিতা লিখত, আমি হাঁ হয়ে পড়তাম। “তাকে ভালোবাসার আগে আমার ধরে নিতে হয়েছিল, আমার একটি মন আছে।”—এই কথা পড়ে তো আমি হাসতে হাসতে শেষ! কিংবা এরশাদ ভাই। পুরো ব্লগকে অদ্ভুত এক মায়ায় বেঁধে রাখতেন। অথবা আমার আপু। কাজকর্ম নেই, দিনরাত শুধু পুনপুন পিনপিন। তমাপু! কী আদরটাই না করতেন আমাদেরকে। মুন্না ভাই! মুন্না ভাই আর দেবুদা মিলে হাসাতে হাসাতে...

হঠাৎ কী যেন হল, কয়েক বছর আগে, আমি দেখলাম আস্তে আস্তে সব ভাইয়া-আপু ব্লগ থেকে চলে যাচ্ছে। ঠিক আছে সমস্যা নেই, আমি তাদের সাথে অন্যভাবে যোগাযোগ করি! কাউকে ফেসবুকে এ্যাড করলাম। কারো সাথে ব্লগেই মেসেজে যোগাযোগ হতে থাকল। আগের মত কেউই আর ব্লগিং করতাম না, কিন্তু আমি অসম্ভব সুখী ছিলাম, আমি এতগুলো চমৎকার ভাইয়া-আপু পেয়েছি।

কিন্তু ঐ যে বললাম। ছোট্ট একটা দুঃখ। একদিন প্রথম-আলোর মানুষজনের কী মনে হল— তারা ঠিক করল ব্লগটা বন্ধ করে দিবে। সেটাও অত বড় সমস্যা না, কিন্তু কিছু মানুষ ছিল, যাদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল ঐ ব্লগটাই। আমি গাধা তো, তাদের ফোন নাম্বারটাও নিয়ে রাখি নি। ব্লগ বন্ধ করে দিবে জানলে হয়তো নিতাম আরকি। যাই হোক, ব্লগটা একদিন দুম করে বন্ধ হয়ে গেল, আর সেই সাথে কয়েকটা অসাধারণ কয়েকটা মানুষ হারিয়ে গেল। সুরভী আপু। রূপ। ত্বাসিন।

সুরভী আপু!
রূপ!
ত্বাসিন!

তারা মারা গেছে আসলে। মারা যাওয়া অর্থ তো এটাই— আমি তাদেরকে আর পাচ্ছি না। ব্লগ বন্ধ করে দেয়ার পর তো সেইটাই হয়েছে, gone forever!

মানুষগুলা যে মারা গেছে সেটা বুঝতে আমার খানিকটা সময় লেগেছে। একটা সময় বুঝতে পেরেছি, কিন্তু এরপর হাসবো না কাঁদবো, সেটা এখনো উদ্ধার করতে পারি নি।

এটাও বুঝতে পারছি না, ভুল বললাম কিনা। হয়তো ভুলই। কারণ আমি যেটা বলেছি সেটা আমি নিজেও বিশ্বাস করি না! আমার বিশ্বাস, মানুষগুলার সাথে আমার একদিন দুম করে দেখা হয়ে যাবে। কার সাথে কীভাবে দেখা হবে সেটাও আমি বলতে পারি। তমাপুর সাথে দেখা হবে বাসের মধ্যে। আমি দৌঁড়িয়ে একটা বাসে উঠবো, উঠে দেখবো তমাপু উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি চিৎকার দিবো, আপুউউ আপনি আমাকে চিনেন নাই?? দেবুদার সাথে দেখা হবে মুদির দোকানে। আমি কিছু একটা কিনতে যাবো, উনিও কিছু একটা কিনতে আসবে। আমাকে দেখে একটু মুচকি হাসবে, এরপর মেঘস্বরে ডাক দিবে, এই ব্যাটা এইদিকে আয়! আমি ভুরু কুঁচকে এক মুহূর্ত দেখবো, এরপর হি হি করে হাসতে হাসতে বলব, দেবুদা!! তারপর কোলাকুলি শুরু হবে। কিন্তু এই কোলাকুলি তিনবারে থামবে না, অন্তত তিনশোবার চলবে! উমম...রূপের সাথে দেখা হবে সায়েন্স ফেয়ারে। আমি জিজ্ঞেস করব আপু তোর নাম কী, সে বলবে রূপ। আমি চোখ কপালে তুলে বলব, ময়মনসিংহ থেকে আসচিশ? সে আরো আশ্চর্য হয়ে বলবে, খাইসে আপনি ক্যামনে জানেন?! তারপর আমি তাকে ঝাড়ি দিবো অনেক্ষণ। ইথার ভাইয়াকে দেখবো রাস্তার পাশে। রিকশা সাঁই করে চলে যাবে, আমি এক মুহূর্তের জন্য ভাববো, আরে এইটা ইথার ভাইয়া না?

শান্তা পরিবারের কল্পনার মত লাগছে।

আহারে, মানুষগুলো মরে যায় কেন?