কীর্তনখোলা


১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, রাত ১১ টা

এই মুহূর্তে আমি বরিশালের গ্র্যান্ড পার্ক হোটেলের একটা বিছানায় পদ্মাসন গেড়ে বসে আছি। সারা ঘরে হলুদ আলো, যতটুকু আলো থাকলে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়, অথচ একটুও চোখে লাগে না—ঠিক ততটুকুই আলো। যেহেতু জীবনানন্দের শহরে বসে আছি, কাজেই তার একটা কথা বলে ফেলা যায়, কথাটা আমার বারবার বলতে হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন কারণে।

এইসব ভালো লাগে।

আজ দুপুরে এই শহরে নেমেছি। লঞ্চে করে। আমি একা না, আমার সাথে পরিবারের বাকি তিনজন, সত্যি বলতে কী— সব মিলিয়ে প্রায় একশোজন, আব্বু-আম্মুর অফিসের একটা প্রোগ্রাম, বুড়ো-বুড়ো রাগী-রাগী চেহারার ডাক্তাররা তাদের পরিবার নিয়ে বেড়াতে চলে এসেছে। সবাই মিলে বড় হইচই করছে, ডাক্তারদের আনন্দের উপলক্ষগুলো হয়তো এভাবেই আসে, কালেভদ্রে। আমি যেহেতু পাগল, আমি তাদের সাথে ঠিক নিজেকে মেলাতে পারি না। দূরে দূরে থাকি, একটু একা। লঞ্চে আসার সময় ছাদে উঠে নদী দেখছিলাম। লঞ্চ পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে, আহা, কী চমৎকার একেকটা নদী, আর কী অপূর্ব একেকটা নাম, বুড়িগঙ্গা থেকে ধলেশ্বরী, তার সাথে শীতলক্ষ্যা এসে মিশলো, সেই নদী গিয়ে পড়লো মেঘনায়, মেঘনা নদী থেকে কীভাবে যেন কীর্তনখোলা নদীতে চলে আসলাম।

আজ তেমন কোনো কাজ ছিলো না, খুব ইচ্ছা ছিলো বিকালে হাঁটবো। এদিকে একটুখানি হাঁটলে মেডিকেল কলেজ, সেখানে গিয়ে কয়েকজনকে চমকে দেয়া যায়। আবার ওদিকে অনেকখানি রাস্তা পার হলে ব্রজমোহন কলেজ, আলতাফ মাহমুদের ব্রজমোহন, জীবনানন্দের স্মৃতি জড়ানো ব্রজমোহন, বনলতা সেনের শ্রীমুখ কি একটুও চোখে ভাসবে না আমার সেখানে গেলে? বের হওয়া হল না বিকালে। কেবল দুই একটা জায়গায় ঘুরে এলেই তো আর শহর দেখা হয়ে যায় না। শহর দেখতে হয় মাসের পর মাস ধরে। শহর দেখতে হয় টঙের চায়ের স্বাদে, রিকশার সিটে, মসজিদের ভেতরে। আর মানুষগুলো মধ্য দিয়ে, শহরে জীবিত মানুষ চড়ে বেড়ায়, মৃত মানুষও। আমি প্রায়ই বলতে পারি কে কে মৃত।

রাতে বের হয়েছিলাম। শহরের কতটুকুই বা দেখলাম, কিন্তু যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে এই শহরের দুটো রূপ আছে। ঝুমুর দলের বসনের মত। তার এক রূপ দেহোপজীবীনি— সে সারি সারি দোকান, রিকশা, বাইক, কালো ধোঁয়ায় ঢাকা। আর অন্য রূপটা শান্ত, নম্র। ফাঁকা রাস্তা। মাঝেমধ্যে দু-একটা রিকশা যাচ্ছে। আর রাস্তাগুলো স্ট্রিটল্যাম্পের আলোয় ভাসছে। আলোগুলো অবশ্য সব সাদা। হলুদ আলো হলে নির্ঘাৎ প্রেমে পড়ে যেতাম।


১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, দুপুর ১২ টা

শরীর একটু খারাপ। জ্বর এসে উঁকি মারছে। তবু সকালে বের হয়েছিলাম বাইরে, আপুর সাথে। জ্বরের ঘোরে একটু হাঁটলাম এদিক-ওদিক। ছোট শহর, মানুষজন খুব বেশি না। কিছু জায়গা এত বেশি ফাঁকা থাকে, রীতিমত চেরনোবিল বলে মনে হয়, পার্ক আছে, পার্কে খেলনাগুলো আছে, মানুষ নেই, রাস্তাগুলো ফাঁকা পড়ে আছে, মানুষ নেই, একটা মৃত শহর। আবার একটু হাঁটলেই বিভ্রম কেটে যায়, কোথায় চেরনোবিল, রাস্তায় অটো চলছে, রিকশা, সাইকেল, আর মানুষগুলো ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে, ব্রাউনিয়ান, কে কোথায় যায়, কে কী চায় কে জানে!

আমি ক্লান্ত, লিখতেও কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে। হাঁটতেও ক্লান্ত লাগছিল, পরে আমি আর আপু একটা রিকশা নিয়ে ব্রজমোহন কলেজে গিয়েছিলাম। যেটাকে মানুষজন বিএম কলেজ নামে ডাকে। জীবনানন্দের স্মৃতিধন্য ব্রজমোহন কলেজ। তেমন কোনো আহামরি আবেগ আমার মধ্যে আসে নি, ওগো জীবনবাবু তুমি কই গেলা গো— এই জাতীয় কান্নাকাটিও করি নি, কিন্তু প্রথমবারের মত ব্রজমোহনে হেঁটে বেশ ভালো লাগছে। জীবনে অনেক কিছুই পেলাম আসলে, যেই রাস্তায় হুমায়ূন আহমেদ হাঁটতেন, নোভা আপুরা চেঁচামেচি করত, সেই রাস্তার ধারে আমরা দুপুরে খাই। যেই কলেজের মাটিতে জীবনানন্দ ঘুরে বেড়াতেন, সেখানে আমিও একবার হেঁটে আসলাম, এই অনুভূতিটা চমৎকার!

মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়বো। একটু পরে আবার জুম্মার নামাজ আছে। জ্বরটা চলেই আসবে কিনা বুঝতে পারছি না। বরিশালে গাড়ি কম....কিন্তু অনেক পুকুর, অনেক....পুকুরে শাপলা....হিজল গাছ চিনি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস, ঐ গাছগুলো হিজল....আর আজ সম্ভবত দ্বাদশী....ঘুম....

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, রাত ৯ টা

And at last, I broke free! খুব ইচ্ছা করছিল একা হেঁটে বেড়াতে। বরিশালে আসার পর প্রথম সুযোগটা পেলাম সবার চোখ এড়িয়ে পালানোর, এবং আমি পালিয়ে গেলাম! আর দেখলাম, চোখ মেলে দেখলাম। রাতের বরিশাল আসলেই “দেখার মত”। না, দেখার মত বলতে এই না যে, এখানে অনেক দর্শনীয় জায়গা আছে, টিকিট কেটে মানুষজন দেখতে আসবে। তবে যারা পাগল, যারা অকারণেই রাস্তায় হাঁটে, যারা স্ট্রিটল্যাম্প ভালোবাসে, যারা হাঁ করে নক্ষত্র দেখে, তাদের জন্য আসলে শহরটা খারাপ না। ভুল বললাম, তাদের জন্য আসলে শহরটা ভালোই, বেশ ভালো, একদম দেখার মত!

বেল্‌স পার্কে বেশ কিছুক্ষণ হেঁটেছি। আবছা আলো-অন্ধকারে গান গেতে গেতে হাঁটার একটা আনন্দ আছে। আকাশে ধ্যাবড়া একটা চাঁদ, পার্ককে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা সারি সারি আলো, নক্ষত্রগুলো তো বহু আগেই মারা গেছে। এর মাঝেও সাত বোন জেগে আছে, যথেষ্ট মজা লাগলো দেখে। এসব অবশ্য সবসময়ই দেখি, কিন্তু আজকে যেই জিনিসটা দেখলাম, সেটা খুব বেশি মানুষ দেখে না। পার্কের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের দিকে চলে গিয়েছিলাম, তখন পূর্ব আকাশে, একেবারে দিগন্তের কাছাকাছি তাকিয়ে দেখি, বৃহস্পতি এত্ত বড় হয়ে জ্বলছে! দিগন্তে অসম্ভব লাইট পলিউশন থাকে, সেখানে এতটা স্পর্ধা নিয়ে কারো জ্বলজ্বল করার কথা না। আমি মুগ্ধ হলাম, এবং কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, পূর্বদিকে আসলেই লাইট পলিউশন নেই! বেল্‌স পার্কের খুব কাছেই কীর্তনখোলা নদী, বেশ বড়সড় নদীই বলা যায়, আহা, সেই নদীর উপরের আকাশ, সুলেখা কালির চেয়েও কালো, আমার বিশ্বাস, শেষরাতে সেখানে আকাশগঙ্গা জেগে উঠবে। (সত্যি বলতে কী, হোটেলের যেই ঘরে বসে আমি লিখছি, সেখান থেকেও নদীর ওপরের আকাশটা দেখা যায়। কিন্তু এইসব হোটেল, দে ওয়ান্ট গ্লোরিয়াস সানশাইন অলসো এ্যাট নাইট, হাজারটা আলো জ্বালিয়ে রাখে তারা, এই আলোয় গঙ্গাবুড়িকে দেখতে পাওয়ার কথা না।)

তবে একটা ব্যাপারে বেশ মন খারাপ হল, এই শহরের রাস্তা সাদা আলোয় মোড়ানো। কেবল পার্কের ওদিকে হলদে আলোয় ঢাকা ছোট্ট একটু রাস্তা আছে, বাকি সব জায়গায় দেখি সাদা আলো ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসছে। জ্বরের ঘোরে কিনা জানি না, কিন্তু এই মুহূর্তে সাদা আলোর ব্যাপারটা আমার কাছে পরাবাস্তব লাগছে। লাশকাটা ঘরে সাদা আলো রাখলে রাখুক, কিন্তু এত চমৎকার রাস্তার ধারে না।

আপু সকালে বলছিল, বরিশাল শহরটা কখনো কখনো ঠাকুরগাঁওয়ের মতন। আমারও প্রথমে একই ভ্রান্তি হয়েছিল, এখন আর হচ্ছে না। আমি জানি, এই শহর আমাদের উত্তরবঙ্গের না। কিছু পার্থক্য আসলে থাকে, চট করে চোখে পড়ে না। বরিশালের এদিকে ওদিকে অসংখ্য পুকুর। একটু পরপর রাস্তার ধারে পোড়োবাড়ি। (এবং শহরের গিফট শপে ঢুকলেই কিউব দেখা যায় না!) আমাদের উত্তরবঙ্গে একটা বৈরাগ্যভাব আছে। ধুলো, ক্ষেত, বেওয়ারিশ গরু-ছাগল। আর বরিশাল জলের দেশ, দুপুরের তীব্র রোদের মাঝেও এই শহরকে ভেজা মনে হয়।

পরিশিষ্ট

বরিশাল কেমন শহর? এর উত্তর দেয়ার ক্ষমতা আসলে আমার নেই, কারণ আমি পুরো শহরটা ঘুরি নি। সেই যে নিতাই বলে গেল, জীবন এত ছোট কেনে এই ভুবনে। জীবন আসলে অনেক বেশি ছোট। আমার তো “যে মূর্তি নয়নে জাগে সবই আমার ভালো লাগে”—টাইপ অবস্থা, কাজেই এই শহরটার একেবারে প্রেমে না পড়লেও, শহরটাকে ভালোবেসেছি। কিছু জায়গা আছে, যেখানে দ্বিতীয়বার ফিরতে ইচ্ছা করে। বরিশাল এমন একটা শহর।

আমার ধারণা, এই জীবনেই আমার আরও কয়েকবার মৃত্যু এবং জন্ম হবে, এবং আমি এই শহরে আবার ফিরে আসবো। শঙ্খচিল হয়ে, ভোরের কাক হয়ে।