শিউলী

অনেকদিন বাদে অমলকান্তি ছেলেটার কথা মনে পড়লো।

আচ্ছা ঐ প্রসঙ্গ নাহয় থাক। আম্মুর কথা বলি। ব্যাপারটা আমার নিজের কাছে চমৎকার লাগছে, আম্মুকে নিয়ে কথা বলতে গেলে সেখানে অবধারিতভবেই রবিবাবু চলে আসে। এসে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে, মাঝেমধ্যে তার দাঁড়িগোঁফের আড়ালে মুচকি হাসিও দেখা যায়।

আমি তো আধাপাগল, আর আম্মু ছিল সিকিপাগল। এই অল্প একটু। রংপুরে যখন মেডিকেল কলেজে পড়তো, পড়তে পড়তে হতাশ হয়ে আম্মু কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে যেত। গিয়ে নানাভাইকে বলতো, আব্বা আমাকে দিয়ে আর পড়া হবে না। নানাভাইয়ের অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মত চেহারা, সে হাসি আটকানোর চেষ্টা করতে করতে নির্বিকার মুখে বলতো, আচ্ছা সমস্যা নাই। আম্মু দুইদিন বাসায় বসে থাকতো, এরপর আবার কাঁদতে কাঁদতে মেডিকেলে ফিরে যেত, গিয়ে খালামণিদের সাথে (মানে, আম্মুর বান্ধবীদের সাথে) ঝগড়া করত, আমি বাসায় গেলাম আর তোরা সব পড়া পড়ে ফেললি!!

নানাভাই ছিল জেলা স্কুলের শিক্ষক। হয়তো এই কারণেই, আম্মুর অসম্ভব চমৎকার একটা অভ্যাস ছিল— দিনরাত বই পড়া। মানিক-শরৎ থেকে শুরু করে আরো অনেকের বই, সবাইকে আমি চিনিও না। নানাভাই কিনে দিতো, আম্মু খালি পড়তো। একসময় বেচারা যখন বড় হল, তখন নিজেই কিনে কিনে পড়া শুরু করলো।

এরপর যেটা হল, রঙ্গমঞ্চে আমি আবির্ভূত হলাম! আম্মু দেখলো একটা নতুন পিচ্চি পৃথিবীতে এসেছে, একেও আলো দেখানো দরকার। এই ভেবে আম্মু আলো দেখালো। সে এমনই আলো, আমার চোখ রীতিমত ধাঁধিয়ে গেল। প্রথমে অ-আ-ক-খ, এরপর সোজা রবীন্দ্রনাথ! আহা, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, আম্মু আমাকে সঞ্চয়িতা থেকে পড়ে শোনাচ্ছে, আমি চোখ বড় বড় করে শুনছি। মাঝেমধ্যে আম্মু সুর দিয়ে শোনাতো, সেই সুরটাও মনে পড়ে। খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে। একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে।

অথবা, সেই কবিতাটা। আমি আর আম্মু ইচ্ছে করেই কথাগুলো ওলটপালট করে দিতাম— “মাথায় লাঠি, হাতে ঝাঁকড়া চুল, কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল!” এরপর দুইজনই হেসে কুটিকুটি হতাম।

আমি মাঝেমধ্যেই ভাবি, আমার বয়সী যারা আছি, আমরা বড় ভালো একটা সময়ে জন্মেছি, আরেকটু দেরি হলেই ফসকে যেত! আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, আমাদের বেশিরভাগের হাতেই মোবাইল ফোন ছিল না। ইন্টারনেটও না। আমরা তো আর রাত জেগে ফেসবুকে বসে থাকতে পারতাম না, রাত চারটা পর্যন্ত ‘তাহার’ সাথে গল্পও করতে পারতাম না। তাই আমরা যেটা করতাম, একটা বই হাতের কাছে টেনে নিয়ে পড়তাম। তিন গোয়েন্দা, জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে আংকেল টমস কেবিন, হ্যারি পটার, রুশ উপকথাগুলো, এবং অবশ্যই, রবিবাবু! আহা, এখনকার পিচ্চিরা কি সেই আনন্দ পায়?? হয়তো পায়। হয়তো পায় না। আমি জানি না। গভীর রাতে কিশোর পাশার সাথে কিংবা হাকারবিনের সাথে এ্যাডভেঞ্চারে বের হওয়ার যেই আনন্দটা আমরা পেতাম, সেটার সাথে হয়তো আর কোনো কিছুরই তুলনা হয় না!

আম্মুর একটা পুরনো বই খুঁজে পেলাম কয়েকদিন আগে। সুনীলের পূর্ব-পশ্চিম। প্রায় তিরিশ বছর আগের বই। পড়তে শুরু করার পর ভালো লেগে গেল। একসময় একটা ধাক্কাও খেলাম, পিকলু বলছে, “সুন্দর তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে, অরুণবরণ পারিজাত লয়ে হাতে।” আমার খুব প্রিয় একটা কবিতা, পিকলুর কথাটা শুনে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু ধাক্কাটা সেই জন্য না। ধাক্কাটা এজন্য যে, আম্মু নিজেও সেটা পড়েছে এবং ঠিক সেই কথাটাই দাগিয়ে রেখেছে। অনেকদিন আগে দাগানো, কালি ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু তাও বোঝা যায়।

আহা, আম্মুও কি আমার মতই ক্লাসের পড়ার ফাঁকে এই বইটা পড়ছিল?

আমি একটু করে বড় হচ্ছি, আর আম্মুর সমান হচ্ছি। আম্মু আজকাল আমাকে হঠাৎ হঠাৎ ভাইয়া ডেকে ফেলে! তার নাকি নোবেল বলতে গেলে সোহেল নামটা মনে হয়, আর সোহেল মামাকে যেহেতু ভাইয়া বলে ডাকে, তাই মুখ দিয়ে ভাইয়া ডাকটা বেরিয়ে আসে। “বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ভাইয়া ছাতা নিয়ে যা!”

আমি অবশ্য ইচ্ছে করেই আম্মুকে বড় আপা ডেকে ফেলি। আমি তার ভাইয়া হলে সে আমার বড় আপা, সহজ হিসাব। আম্মু শুধু হাসে, সহজ হিসাবটা এখনও ধরতে পারছে না।

ওমর-আহমাদ-উচ্ছ্বাসরা আশেপাশেই আছে, আমাদের পাগল-সমিতির মানুষজনের আর যাই হোক, বই পড়া নিয়ে ভাব নেয়ার সুযোগ নেই। তবু আমার মনে হয়, আম্মুর চমৎকার অভ্যাসগুলো থেকে যেগুলো পেয়েছি, তার মধ্যে একটা হচ্ছে বই পড়া। এবং আরো পার্থিব চিন্তাভাবনা করলে, একগাদা বই! আমার ঘরের ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা বুকশেলফ জুড়ে বই, অনেকগুলোই আম্মুর ছোটবেলায় কেনা, এসব দেখে আমি মনটন ভালো করি মাঝেমধ্যে।

সেই বুকশেলফটা আলো করে রবিবাবু আছে, ঝাঁকড়া চুলের ঐ মানুষটা আছে, বিভূতিভূষণ - তারাশঙ্কর - শীর্ষেন্দু - জহির রায়হান - মুজতবা আলী - জাফর ইকবাল - হুমায়ূন আহমেদরা আছে, এবং আম্মুর পুরনো বইগুলোর মধ্যে যেন আম্মু নিজেও ছড়িয়ে আছে।

আমার ছোট্ট, নিতান্ত ছোট্ট ঘরটায় আমি সবাইকে আটকে রেখেছি।