রিটার্ন জার্নি: আইসিইউ টু দিনাজপুর

ওরা ঠাট্টা করে নিজেদের DMC বলে ডাকে।

দিনাজপুর ম্যাথ ক্লাব।

দিনাজপুরে যাওয়ার আগেরদিন আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম। রুদ্রর সাথে হাটখোলায় গিয়ে গোটাদশেক থার্মো কিনলাম, এরপর যখন ক্যাম্পাসে ফিরছি, তখন মনে হল নওরীণটাকে ফোন দিই, অনেকদিন চেহারা দেখা হয় না। ফোন দিলাম, নওরীণ চেঁচামেচি করে বলল, হলের সামনে আয়!

আমি যখন ওদের হলের দিকে আগাচ্ছি, তখন আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমছে। ঠিক যেই মুহূর্তে আমি হলের ভাস্কর্যটার পাশে দাঁড়ালাম, তখনই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো, তুমুল বৃষ্টি, আর সেই বৃষ্টির মধ্যে একটা আইসক্রিমের দোকানের ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে নওরীণ বলল, আব্বু একসিডেন্ট করসে।

Period.

একসিডেন্টের খবরটা কে দিয়েছিল? চাচী সম্ভবত, আমার ঠিক মনে নেই। উনি বিস্তারিত বলে নি, একসিডেন্টটা কতটা সিরিয়াস, নওরীণ তখনও বোঝেও নি।

আমরা এসব বলি না, অন্তত ফোনে, সিরিয়াস একসিডেন্টের পরেও বলি, একটু আঘাত, অল্প একটু কষ্ট, আসছি, ঢাকায়, এ্যাম্বুলেন্স, না সিরিয়াস না— আমরা এভাবে বলি….

জানি না কেন। হয়তো কষ্টের ব্যাপারটা নিজের কাছেই লুকাতে চাই।

অথবা, হয়তো ওপাশের মানুষটাকে শান্ত রাখতে চাই— যতটা বেশি সময় সম্ভব।

এরপর, সবকিছু কেমন যেন দ্রুত ঘটতে শুরু করল। আমি ভিজে চুপসে বাসায় ফিরলাম, ব্যাগ খুলে ঘরময় পুরো ব্যাগের জিনিস শুকাতে দিলাম, শিবলী ভাই একসময় ফোন দিল, আংকেলের আঘাতটা ব্রেইনে, আইসিইউ-তে, অপারেশন করা যাচ্ছে না, আমরা সিএমএইচে গেলাম, জুনায়েদ ভাই আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, বাস্তবতা মেনে নেয়ার জন্য রেডি হও, একটা ছোট ঘর, অন্ধ কেবিন আলোয় আঁধার গোলা, ফোনে তনু আপুর তীব্র কন্ঠ, কী বলতেসিশ তুই— অসম্ভব দ্রুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল যেন।

এরপরেও মানুষ দৌঁড়ায়। অক্ষম, নিরুপায় হয়ে, আইনস্টাইন না ছাই কে যেন বলতেন, জীবন হচ্ছে একটা সাইকেল, সবসময় চালিয়ে যেতে হয়, আমরা অমন সাইকেল চালানোর চেষ্টা করি, যখন আমার সিএমএইচে বসে থাকার কথা— তখন আমি, রুদ্র, মীম ভাই বসে ছিলাম গাবতলীতে, একটা বাস এসে আমাদের দিনাজপুর নিয়ে যাবে— এই আশায়।

অন্য কেউ, অন্য অনেকে সিএমএইচে। অন্য আশায়, অন্য আশঙ্কায়।

ফ্ল্যাশব্যাক— একসময় ভাবতাম, দিনাজপুরে জোম্বি কম, অন্তত ঢাকার চেয়ে কম— ঢাকার রাস্তাঘাটে অসংখ্য মৃত মানুষ হেঁটে বেড়ায়।

এগেইন ফ্ল্যাশব্যাক— জুনায়েদ ভাই দিনাজপুরে যাওয়ার কয়েকদিন আগে একটা কথা বলেছিল।

সময় লাগে, ঘটনাগুলো বুঝতে সময় লাগে। টাঙ্গাইল থেকে ফেরার পর একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম, অথৈয়ের কথাগুলো শুনে। আমিও ভাবছিলাম, আবির ভাইও একই কথা ভাবছিল— আমরা এতটা ভালোবাসা হয়তো ডিজার্ভও করি না। আমাদের এসব কথা শুনে জুনায়েদ ভাই বলল, এই ভালোবাসাগুলো দুইদিনে, চারবেলায় তৈরি হয় নি।

সময় লাগে, অর্বাচীনের ঘটনাগুলো বুঝতে একটু সময় লাগে। দিনাজপুর অনেক কথা বলল, এবং আশ্চর্য— তারা শুধু মুখ দিয়েই বলল না, তারা চোখ দিয়েও বলল। তারা চোখমুখ দিয়ে, এমনকি পুরো সত্তা দিয়ে কথা বলল।

আমরা বসে ছিলাম, ম্যাথ ক্লাবের ছোট্ট রুমটাতে।

বাংলা স্কুলের মাঠে।

সামনের রাস্তাটায়।

আমি শুধু শুনলাম, এদিকে আনাস, নিলয় থেকে শুরু করে ওদিকে মীম ভাই— সবাই অসংখ্য শব্দ উচ্চারণ করল।

এরপর….

এরপর, এর মাঝেই, আমার মনে হল, একটু একটু যেন বুঝতে পারছি। টাঙ্গাইলের শেষদিন অথৈ, লীনা কেন এতখানি চুপ ছিল— সেটা একটু স্পষ্ট হল। দিনাজপুরে পুরো দুইদিন ধরে রাহাত, আরাফাত কী বলে নি— সেটাও স্পষ্ট হল।

আমরা দুই চোখ, চার চোখ দিয়ে অনেক কম দেখি, অনেক কম। আমার ধারণা, যত মানুষ হাসপাতালে আইসিইউ-তে ভর্তি থাকে, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের আত্মা অসুস্থ হয়ে আইসিইউ-তে থাকে। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, কী টাঙ্গাইল, কী দিনাজপুর— সবার একই গল্প, আমার কল্পনার চেয়েও বেশি মানুষ আইসিইউ-তে, আমি জানি না আমি কী করব।

তবু, জীবনানন্দ বলে গিয়েছিলেন, তবু তো প্যাঁচা জাগে….

আমার মনে হল, এবার আরও অনেক বেশি দেখতে পাচ্ছি, আরও অনেকখানি গভীরে। আমি দিনাজপুরকে নিয়ে বসলাম, আমি টাঙ্গাইলকে ফোন দিলাম। আমি জানি না আমি কী বলব, নিতান্তই সাধারণ ঘরে জন্ম নেয়া সাধারণ একটা মানুষ, ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোন ক্ষমতা খুব একটা নেই, তবু কথা বললাম, যা মনে এলো, বলে ফেললাম। আর এর দুই-চারদিন পর ফিডব্যাক আসা শুরু করল। আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে, কলব্যাক।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ছেলেমেয়েগুলো এই যাত্রায় বেঁচে যাবে।

দিনাজপুরের প্রোগ্রাম শেষে আমি ঠাকুরগাঁও যাচ্ছিলাম, দাদুকে দেখতে। বুড়ি চাঁদটা সেদিন আকাশে ছিল, একটা অন্ধকার হাইওয়ে, আর হাইওয়ের আকাশে, পাশের খেতগুলোতে, চারদিকে জোছনা, এমনকি বাতাসে যে কুয়াশা— সেই কুয়াশাতেও জোছনা ঠিকরে পড়ছে, এগুলোকে বোধহয় কবিরা জোছনার সমুদ্র নামে ডাকেন— আমি এত অক্ষম, আমার ওটা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা নেই।

কাজেই আমি শুধু দেখি। আর ঘ্রাণ নেই। জোছনায় ভাসা হাইওয়েতে গ্রামের পোড়া কাঠের ঘ্রাণ নেই। খেতের সদ্য কাটা ফসলের ঘ্রাণ নেই।

আর ভাবি। তারাশঙ্করের মত। জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবনে।

রাত এগারোটার দিকে দাদুবাড়ি পৌঁছালাম।

আর রাত সোয়া দুটোয় শিউলী জানালো, নওরীণের আব্বু মারা গেছেন।