So, so you think you can tell

এক.

জগদীশ বসু ক্যাম্প, এক, দুই, ছাড়াছাড়া, মানুষ ধরে ধরে বলা— নাহ, এভাবে আর হচ্ছে না। সবকিছু লিখে ফেলতে পারলে ভালো হত।

অথৈ বলেছিল, ক্যাম্প থেকে ফেরার পর সে নাকি ক্যাম্পের স-অ-ব গল্প শুনবে!

অন্তত পিচ্চিটার জন্য হলেও তো আমাকে লেখা লাগবে।

সন্ধ্যার একটু পর চুপ করে বসে ছিলাম। বাইরের বাতাসটা মোটামুটি অবিশ্বাস্য লাগছিল। বাতাসে শীত-শীত ভাব নাহয় থাকতে পারে, কিন্তু এতখানি নস্টালজিয়া কীভাবে থাকে আমি জানি না।

এমন সময় নদী ফোন দিল।

আজকাল কী যেন মনে হয়, কারো সাথে কথা বলার সময় টুংটাং করে বাজাতে ইচ্ছে করে। নদীর বকবক শুনতে শুনতে wish you were here তোলার চেষ্টা করছিলাম। আমি টুংটাং করতেই পিচ্চিটা ওপাশ থেকে মোটামুটি চেঁচিয়ে উঠলো, ভাইয়া ভাইয়া, এইটা so you think you can tell না??

আর ঠিক এই কথাতেই আমার হিল্লোলকে মনে পড়ে গেল।

হিল্লোল রায়, দিনাজপুর, এবং আরো অনেক কথা।

আমি দিনাজপুরের মাটিতে শেষবার যখন দাঁড়িয়েছিলাম, সেবারও উপন্যাসটা একইভাবে আগাচ্ছিল। আমার মনে আছে, সোহান আর পুণ্য (অথবা মীমও হতে পারে) যখন আমাকে বলল, ভাইয়া ভালো থেকো, বাসায় যাচ্ছি— ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, আমি ওদেরকে চিনি, অনাদি অনন্তকাল ধরে ওরা আমার ভাইবোন হয়ে ছিল। একটা অন্ধকার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমি ওদেরকে অবিশ্বাস্যরকম স্পষ্ট করে দেখলাম, ঝলমলে দিনের আলোতেও মানুষকে এতটা স্পষ্ট দেখা যায় না।

এসব মুহূর্তে আমি হতভম্ব হয়ে যাই।

পুরো দিনাজপুরের কাছে নিজেকে বেচে দিয়ে ঠাকুরগাঁও ফেরার চেষ্টা করছিলাম, আমার দাদুবাড়ি। টানা দুইদিন ক্যাম্প করে ক্লান্ত অবস্থায়। একটা ভুতুড়ে ভটভটির পেছনে বসে ফিরছিলাম। অন্ধকার, পেছনে আলো নেই। সেটা বড় সমস্যা না, ফাঁকা হাইওয়ে জুড়ে চাঁদটা নির্লজ্জের মত জোছনা ছড়াচ্ছিল। আর আমি নির্বোধের মত হাঁ করে জোছনা দেখছিলাম।

এমন সময় রাস্তার পাশে একটা বাড়ির দিকে চোখ পড়ল। সাদাসিধে একটা কুঁড়ে, আর তার উঠোনে তিনজন মানুষ বসে গল্প করছে। চাঁদের আলোয়। বিশাল খেতের মাঝে একলা একটা বাড়ি, সেই বাড়ির উঠোনে তিনজন মানুষ, ওরা ছেলেও না, মেয়েও না, ওরা সব কিছুরই উর্ধ্বে, ওদের পৃথিবীতে সাড়ে পাঁচশো মানুষের হইচই নেই, নেদারল্যান্ড, কফি, প্রতিদিন মিরপুর রোডের প্যাঁ পোঁ— এসব কিছুই নেই, শুধু ওরা সত্য, ঐ উঠোনটা সত্য, আর এই চাঁদটা সত্য।

আমি ঠিক এই সত্যটাই চেয়েছিলাম।

রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে, “বন্ধুবর, দক্ষিণে বেঁধেছি নীড়, চুকেছে লোকের ভীড়, বকুনির বিড়বিড় গেছে থেমেথুমে।” আমারও মনে হয়, বকুনির বিড়বিড় থেমেথুমে গেলে মন্দ হত না। অল্প কিছু মানুষকে পাশে নিয়ে চাঁদের আলোয় বসে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।

অল্প কিছু মানুষ—এই কথাটা বললেই আমার ক্যাম্প শব্দটা মনে পড়ে যায়। প্রায়ই।

আমার জন্ম এমন একটা ক্যাম্পে।

দুই.

আচ্ছা, এবারের গল্প সাদিয়াকে দিয়ে শুরু করা যায়। সাদিয়া, সংক্ষেপে, আমার স্কুলজীবনের একটা মেয়ে ভার্শন। আমি যেমন ছিলাম, শান্তশিষ্ট, মুখচোরা। মানুষজনের সামনে কথা বলতে প্রচণ্ড দ্বিধায় ভোগে। একসাথে দুজনের বেশি মানুষ দেখলেই খেই হারিয়ে ফেলে। তাই আমি বেচারাকে আলাদা করে ডেকে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। আমি যেহেতু একটা সময় এই সমস্যাটার মধ্য দিয়ে গেছি— সত্যি বলতে কী, এখনো আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সামনে এই সমস্যাটায় ভুগি, কাজেই আমি জানি এটা কেমন।

পিচ্চিটার সাথে কথা বলতে গিয়ে অসম্ভব মজা পেয়ে গেলাম। আমি কথা বলি, সে চুপ করে থাকে। চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে— যেন মেঝেতে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন জিনিস রয়েছে। আমি টানা বকবক করতেই থাকলাম। অনেক্ষণ বকবক শোনার পর পিচ্চিটা আস্তে করে আমার দিকে একবার তাকাল।

তারপর….দুম করে স্রোতের মত একগাদা কথা বলে ফেলল!

যেই পিচ্চিটা সারা ক্যাম্পে চুপ করে ছিল সে দুম করে একগাদা কথা বলে ফেলল— এটা আমার জীবনের সবচেয়ে মজার ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা!

আমার ধারণা, সাদিয়ার গল্পটা মাত্র শুরু হল। এবং আরও অনেকের ধারণা, সাদিয়া এবারের ক্যাম্পের অথৈ।

অথৈ অনেকদূর গেছে, সাদিয়া কতদূর যাবে জানি না। কেউই কারো মত না।

সাদিয়া আমাকে যেই কিটক্যাট দিয়েছিল সেটা যেই লেজবিশিষ্ট বাঁদরটা ভর্তা বানিয়ে ফেলেছে তার নাম রিয়া। রিয়া থাকে “ম্যামানছিং” –এ, এই ম্যা-এর উচ্চারণ করতে হয় ছাগলের ম্যা ডাকের মত করে। রিয়া গত জন্মে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট হিসেবে পৃথিবীতে এসেছিল, তাই সে ম্যা উচ্চারণ করতে বড় ভালোবাসে।

এবং সে মানুষজনের সাথে বকবক করতে ভালোবাসে। মেয়েটা কালেভদ্রে ফোন দেয়। খুব একটা জরুরী কারণে না অবশ্য! এমনিই একটু বকবক করে। একসময় কথা শেষ হয়ে যায়, আমি ভাবি, এইবেলা ফোনটা রেখে দেই। ঠিক সেই মুহূর্তেই সে নতুন কোন টপিক খুঁজে বের করে আরও একটু বকবক করে। ভাইয়া ভাইয়া আমি ঢাকায় গেলে তোমরা আসবা? ভাইয়া আমি না, পদ্মর সাথে কথা বলে সেন্টি খেয়ে বসে আছি! ভাইয়া, আকিব হাতিটা বলতেসে, সে রাস্তা চিনে না।

অসম্ভব মজা লাগে আমার। ক্যাম্পের যেই কয়জন পিচ্চিকে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি— রিয়া মেয়েটা তাদের একজন।

আরিফও একজন।

অবশ্য আরিফের সাথে আমার পরিচয় বছরখানেক আগে। গত জগদীশ বসু ক্যাম্পে। তখন ভাবতাম, আরিফ একটা নার্ড, চমৎকার ফিজিক্স বোঝে, আর দিনরাত গবেষণা করে। কাজেই এই ক্যাম্পে যখন আরিফকে আরেকটু ভালোমত চিনলাম, তখন একটা ধাক্কা খেলাম। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, আরিফও একটা ঘোড়া।

মহীনের ঘোড়া।

এবং হয়তো একারণেই, সে এখনো উড়ছে, আমি যেমন এই গাছ থেকে ঐ গাছ— সব গাছে উড়ে বেড়াচ্ছি, ফিরবো ঘরে কোথায় এমন ঘর— আরিফও তেমনই এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে উড়ছে, ফিরবে ঘরে কোথায় এমন ঘর।

খুব সম্ভবত ক্যাম্পের দ্বিতীয় রাত ছিল সেটা, আরিফের সাথে বকবক করতে করতে পুরো রাতটা শেষ করে ফেলেছিলাম। জানি না, আমার পৃথিবীতে আরেকজন শাওন, আরেকজন এ্যানি, আরেকজন ভাইয়া-অলিন্দর জন্ম হল কিনা।

এবং আমি জানি না এই মানুষগুলো শেষ পর্যন্ত জীবনে কী পায়।

হয়তো সবই পায়।

হয়তো কিছুই পায় না।

ওদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যথেষ্ট কঠিন একটা কাজ— ওরা এখনো বাসা বাঁধে নি।

কাজেই মোটামুটি সহজ কাজ হল, যারা বাসা বেঁধেছে তাদের সম্পর্কে বলা। যেমন....আকিব!

আকিবের ভেতরে যাই থাক, খোলসটা যথেষ্ট সুখী একটা ছেলের। সারাক্ষণ হাসছে, বাঁদরামো করছে, বন্ধুদের খেপিয়ে মারছে। আমার তো মাঝেমধ্যে দুশ্চিন্তাই হয়— আকিবের পচানি খেতে খেতে বাকি ছেলেমেয়েগুলো পাগল হয়ে যায় কিনা! ক্যাম্পের শেষ রাতে এই ছেলেটা রাত তিনটা পর্যন্ত আর্টসেল শুনতে শুনতে এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছে। এরপর রাত তিনটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত সে যা করেছে, সেটা না দেখলে বোঝানো কঠিন। হাসতে হাসতে আক্ষরিক অর্থেই একেকজন গড়াগড়ি দিয়েছি আমরা!

এবারের ক্যাম্পে গতবারের বিশাল মাঠ, পুকুর, গাছ, মায়া ধরানো করিডোর— কিছুই ছিল না। কাজেই ক্যাম্পের গল্পগুলোর একটা বড় অংশের জন্ম হয়েছে সিঁড়িতে। এবং এই সিঁড়ির গল্পগুলোর আগে-পরে আকিবের কিছু বড় ভূমিকা আছে, কিন্তু এগুলো সবাইকে বলা যাবে না। কিছু কথা অবশ্যই অফ দা রেকর্ড রাখতে হবে, হাজার হোক এটা জগদীশ বসু ক্যাম্প!

আকিবের আপুর সাথে কয়েকদিন আগে আমাদের পরিচয় হয়েছে, এর ফলে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নামের সন্ধান পেয়েছি। আকিবের বিরুদ্ধে এসব নাম প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা মাঝেমাঝেই পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করি।

অবশ্য সবার আনন্দই যে পৈশাচিক, তা নয়। কারও কারও আনন্দ বৈড়ালিক। যেমন রাহাত। এই পিচ্চিটার বিড়াল হিসেবে জন্ম নেয়ার কথা ছিল, ভুলে মানুষে হয়ে চলে এসেছে। কাজেই মানুষের মত হাত-পা থাকলেও তার মধ্যে বিড়ালভাব প্রবল। এই বিড়ালটার অন্যতম কাজ হল সারাক্ষণ ম্যাঁও ম্যাঁও করতে করতে মানুষের কানে তালা লাগিয়ে দেয়া। ক্যাম্পের দিতীয় রাতে আমরা কয়েকজন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রাত পৌনে তিনটার দিকে বিড়ালটা এসে দেখে, আমরা তখনও ঘুমাই নি। তখন সে করুণ মুখ করে ম্যাঁও করল, ভাইয়া আমি কি এখানে আসতে পারি? আমরা হাসতে হাসতে বললাম, আয়! এরপর সে ঘরে ঢুকে বিছানায় জাঁকিয়ে বসল, এবং কিছুক্ষণের মাঝেই পুরো আড্ডার নেতৃত্ব নিয়ে নিল! রাতের আড্ডার বাকি অংশটুকু আমাদের ম্যাঁও শুনতে শুনতে কেটেছে, শেষে আমি ম্যাঁওয়ের পাশেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।

আর রাহাত যদি বিড়াল হয়, পদ্ম হল কাঠবিড়ালী। কাঠবিড়ালী, কাঠবিড়ালী, পেয়ারা তুমি খাও? পদ্মকে কখনো পেয়ারা খেতে দেখি নি, কিন্তু আমার ধারণা, সে শুধু পেয়ারা না, পৃথিবীর সবকিছুই খায়। তার হাতে যখন পেনসিল থাকে, সে পেনসিল খায়, খাতা থাকলে খাতা খায়, এমনকি যদি কিছুই না থাকে, তাহলে গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডটা মুখে নিয়ে খেতে থাকে। পিচ্চিটা যতখানি আগ্রহ নিয়ে আইডি কার্ড খায়— অত আগ্রহ নিয়ে অবশ্য সকালের নাস্তা খায় না। আমরা অনেক চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হয়েছিলাম, তখন তনু আপু কীভাবে যেন পদ্মকে নাস্তা খাইয়ে দিল! (সেটা দেখে আমার মনে পড়ে গেল, গত ক্যাম্পে নাসিদকেও তনু আপু এভাবেই খাইয়ে দিত।)

ক্যাম্পে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল পদ্মর গাল ধরে টানাটানি করা। ক্যাম্পের চারদিন আমি আগ্রহের সাথে এই দায়িত্ব পালন করেছি।

আন্টি (পদ্মর আম্মু) আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। ৯২ ব্যাচ, আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে। আমি বুয়েটের শুনে পদ্মর নানু যখন আমাকে বললেন, জানো, তোমার “আপুও” কিন্তু বুয়েটে ছিল, তখন আমি আর আন্টি— দুজনেই হেসে ফেলেছিলাম। আন্টি হাসতে হাসতেই বললেন, আপুর বয়স আর নেই আমার!

ক্যাম্পশেষে উনি আমাকে একটা ছোট্ট মেসেজ লিখেছিলেন, মেসেজটার শেষ দুটো লাইন ছিল অনেকটা এরকম— “When you are free, you should come, we would be really happy. Specially Padmo will be delighted to have a big brother to fight/talk/play/learn with.”

এটা আমার ক্ষুদ্র জীবনে শোনা সুন্দরতম কথাগুলোর মধ্যে একটা।

পদ্ম পিচ্চিটা মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নেয়। বেশ মজা লাগে আমার। সেদিন বিকেলে মিরপুর রোডে জ্যামে আটকা পড়ে ছিলাম। তখন পিচ্চি ফোন দিল। সেটা দেখেই আমার মন ভালো হয়ে গেল, বাস থেকে নেমে পড়লাম, লালমাটিয়ার ফাঁকা রাস্তাগুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পদ্মর বকবক শুনলাম এবং বকা খেলাম। “ভাইয়া তুমি কেন ফেসবুক বন্ধ করে দিলা? আমি তো লেখাগুলো আর পড়তে পারছি না!”

এত মিষ্টি করে আমাকে খুব কম মানুষই বকে!

তিন.

শীত আসার আগে আগে অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে আমার, অনেক।

গত বছর এই সময়টাতে ফুপী আইসিইউতে ছিল, টানা তিন মাস।

গত বছরও এমনই হচ্ছিল, আমরা জগদীশ বসু ক্যাম্প করে ফিরলাম, এবং দিনদুয়েক সবাই হাসলাম, খুব হাসলাম। এদিক-ওদিক, পুরো শহরটা নিজের মনে করে ইচ্ছেমত ঘুরলাম। ক্যাফেতে বসে বকবক করতে করতে মুজতবা আলী হওয়ার চেষ্টা করলাম। অনেক রাত পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরিতে অকারণ আড্ডা দিলাম।

এরপর একদিন, প্রদীপটা অনেক বেশি জ্বলে উঠলো। সেন্ট যোসেফে টানা তিনটা সেশন নিলাম আমরা, হাসতে হাসতে। এরপর হাসতে হাসতে ক্যাম্পাসে গেলাম। বৃষ্টিতে ভিজলাম। কয়েকটা কাঠগোলাপ আমার হাতে আসলো, সেগুলো নিয়ে শহীদ মিনারের রাস্তায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

এরপর বাসার ফিরলাম। আম্মু জানাল, ফুপী অসুস্থ।

অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে আমার।

গত বছর এই সময়টা একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। ফুপী, আইজেএসও ক্যাম্প, পিংক ফ্লয়েড, টার্ম প্রজেক্ট— সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। দাদু হয়তো আইসিইউতে ফুপীকে দেখতে গেছে, আর আমি হাসপাতালে সিঁড়িতে বসে রেজনিক-হ্যালিডে পড়ছি, কানে Us and Them গুঁজে। আইজেএসও ক্যাম্পে পিচ্চিরা প্রবলেম সলভ করছে, আমি এক পাশে বসে টার্ম প্রজেক্টের কোড করছি, আর ভাবছি ফুপীকে আর কতদিন কষ্ট পেতে হবে। রাতে খুব একটা ঘুমাতে ইচ্ছে করত না, খুব দ্রুত উঠে যেতাম। মানুষকে চাঁদে পায়, আমাকে আইজেএসও পেয়েছিল, রাতদিন খাটাখাটনি করার চেষ্টা করতাম।

আর হাঁটতাম। অনেক হাঁটতাম। অনেক রাতে আইজেএসও ক্যাম্প শেষ করে পিচ্চিগুলোকে বিদায় দিতাম। এরপর এক কাপ চা খেয়ে রাতের ঢাকা শহরে হাঁটা শুরু করতাম। তখনও ঢাকার রাস্তায় যথেষ্ট সোডিয়াম আলো ছিল, সেই আলো-আঁধারের রাস্তা, হালকা শীত, রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ শিউলী ফুলের ঘ্রাণ— সবকিছু আমাকে পাগল করে দিত।

সাড়ে তিন.

শীত শেষ হওয়ার আগেই সবকিছু কলাপ্‌স করা শুরু করল।

সেবার টার্ম প্রজেক্টে সি প্লাস প্লাস দিয়ে কাজ করে অসাধারণ আনন্দ পেয়েছিলাম। এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রজেক্ট আর আইজেএসও টিম নিয়ে কাজ করার কারণে অসম্ভব ক্লান্ত লাগছিল। আমার মনে আছে, সিদ্ধার্থ স্যার যখন আমার প্রজেক্টের জাজমেন্ট করতে আসলেন, তখন আমি ল্যাপটপের উপর মাথা রেখে আরাম করে ঘুমাচ্ছি। আমার ঘুম ভাঙলো স্যারের ডাকে।

প্রজেক্ট সাবমিট করলাম।

ওদিকে আইজেএসও টিম দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে গেল।

ভার্সিটিতে ক্লাস শেষ হয়ে পিএল শুরু হল।

এবং ফুপী এক রাতে চুপ করে মারা গেল।

চার.

নিলয়কে আমি বেশ কয়েকবার করে আবিষ্কার করেছি, প্রতিবারই একটা করে ছোটখাট ধাক্কা খেয়েছি বলা যায়।

ক্যাম্পের শেষ রাতে আমরা প্রায় কেউই ঘুমাই নি, কাজেই ক্যাম্প শেষ হওয়ার পর সবাই মোটামুটি জোম্বি অবস্থায় ছিলাম। সেই জোম্বি অবস্থাতেই ঘুরছিলাম এই শহরে। সন্ধ্যের দিকে রবীন্দ্র সরোবরে আমরা চারজন ঝিম ধরে বসে ছিলাম। আমার হাতে আরিফের ডায়েরি, উল্টেপাল্টে দেখছি। আমার ডান পাশে নিলয় বসে মৃদু গলায় কথা বলছে। অন্য পাশে হিল্লোল চুপ করে ধানমণ্ডি লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আরিফ উকুলেলে হাতে নিয়ে হালকা টুংটাং করছে।

সন্ধ্যেটা কোন এক কারণে সুন্দর ছিল।

সরোবর থেকে যখন ফিরছি, তখন ধানমণ্ডির রাস্তাগুলোয় সোডিয়াম আলো জ্বলতে শুরু করেছে। রিকশায় একটু একটু করে আগাচ্ছে, আর নিলয় একটু করে কথা বলছে। শুনতে শুনতে আমার মনে হল, এই গল্পগুলো আমি আগেও শুনেছি, ঠিক দিনাজপুরের কাছ থেকেই।

গল্প শুনে ধাক্কা খেলেও, খুব একটা আশ্চর্য হই না আমি, পিচ্চিগুলো পূর্বসূরিদের মত হবে— এটাই স্বাভাবিক।

আমি আর নিলয় বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রিকশায় বসে থাকলাম। আমি মোটামুটি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ছেলেটা কী ভাবছে। একসময় সে বলল, ভাইয়া, কালকে দুপুরে হঠাৎ আবিষ্কার করব, মানুষগুলা নাই।

দ্যাট ওয়াজ আ গুড পয়েন্ট।

আমি যেমন বুঝি, নিলয়ও বোঝে আমাদের মানুষগুলোর মর্ম।

হিল্লোলও বোঝে অবশ্য। একদিন রাত দশটার দিকে আমি আর আবির ভাই আমতলীতে বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় হিল্লোল ফোন দিল। কোন দরকারে না, তার নাকি হঠাৎ করে মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে!

হিল্লোল শান্তশিষ্ট একটা ছেলে, একটু লাজুক। মোটামুটি অসাধারণ গিটার বাজায়, যদি মুখে সেটা স্বীকার করতে চায় না। গভীর রাতে সে একা একা বাসার ছাদে চলে যায়। সবাই যখন ঘুমিয়ে যায়, তখন সে ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন নক্ষত্রকে তার গিটার বাজিয়ে শোনায়।

এবং ছেলেটা ফ্লয়েডেড। দীর্ঘ একটা ইনট্রো শোনার পর সে আমার সাথে গলা মেলায়, so, so you think you can tell! এরকম দুই-একটা ছেলে আশেপাশে থাকলে সময়টা চমৎকার কাটে!

সেই সাথে একজন ‘না পিচ্চি-না বুড়ো’ জাতীয় মানুষ থাকলে সময়টা আরও ভালো কাটে। আজরা মেয়েটা সেরকম একটা পিচ্চি। বুড়োদের মত এত বড় বড় চশমা পড়ে ঘোরে, আর সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করে। ক্যাম্পের শেষ রাতে পিচ্চিটা অনেক্ষণ হি হি করে হেসেছে। এর একটু পরে সে হাসার কারণটা ধরতে পেরেছে। আর তার একটু পরে আমি ধরতে পেরেছি, আমাদের এই ছোট বোনটা আসলেই পিচ্চি।

আমার কেন যেন মনে হয়, একদিন রাস্তায় পিচ্চিটার সাথে দেখা হয়ে যাবে, এমনিই। আমার ইচ্ছা, সেদিন পিচ্চিটাকে আমি প্রথমে ঝাড়ি দিবো, খুব করে ঝাড়ি দিবো। এরপর আদর করে একটা আইসক্রিম খাওয়াবো।

তার মানে অবশ্য এই না যে, যেকোন পিচ্চিকেই আমি আইসক্রিম খাওয়াই। বরং অরিত্রর সাথে দেখা হলে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করি, তনু আপু আজকে আমাদের জন্য চকলেট দেয় নাই? বেশিরভাগ দিনই অরিত্রর ব্যাগ থেকে চকলেট কিংবা পিঠাজাতীয় কিছু বের হয়। আমরা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে গাপুসগুপুস করে ওগুলো খাই।

তনু আপুকে যেহেতু আপু ডাকি, সেই হিসেবে আমরা অরিত্রর মামা এবং খালা। কিন্তু অরিত্র আমাদেরকে ভাইয়া-আপু ডেকে উলটো তনু আপুকেই দিদি ডেকে ফেলে! হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না।

অরিত্রদের বাসায় আমার গিটারটা ফেলে এসেছি। বেচারা গিটার বেঁচে আছে নাকি সায়েন্টিফিক রিসার্চের অংশ হিসেবে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গেছে কে জানে!

ক্যাম্পের একদিন দুপুরবেলা আমি ক্যাম্প থেকে কিছুক্ষণের জন্য বের হয়েছি। এমন সময় তনু আপু ফোন দিল। আপু ফোন দিয়ে আমাকে একটা প্রশ্ন করল এবং একটা কথা বলল, এবং সেটা শোনার পর আমি মোটামুটি একটা ধাক্কা খেলাম।

দেয়ার আর মোর থিংস, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ।

পাঁচ.

এবং সেই সাথে আরেকটা কথাও সত্যি, জীবন এত ছোট কেনে এ ভুবনে।

তিনদিনের একটা ক্যাম্পে কতজনের নিউরনের অলিগলিতে ঢুঁ মারা যায়?

কত কী করার ছিল।

মৃণ্ময় অসাধারণ একটা ছেলে, আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটার মত জ্বলছে। তার ভেতরে কী চলছে দেখা হল না।

নটরডেমের ফার্স্ট বয় হয়েও ফাহিম নাকি মৃত না। মানুষ কীভাবে দেবতাদের পর্যায়ে চলে যায়, জানা হল না।

নিবিড়, ছাই তার সাথে বিডিজেএসও-র কে যেন ছিল। আমার আরও দুটো নক্ষত্র, ধরা হল না।

এরপর রিগান, মুকিতদের চুপচাপ গ্রুপটা। ওরা কী ভাবছে শোনা হল না।

আর আরাফ ইশরাক? এইটুকু একটা পিচ্চি, বড় বড় চোখ করে চারপাশে তাকায়, আর মিটমিট করে হাসে। ওকে একটা গল্প বলা উচিত ছিল, বলা হল না।

আরিশা খুব মিষ্টি করে হাসতো, আর আমাকে বলত, ভাইয়া আমি কিন্তু কিউব শিখবো! শেখা হল না।

সুদীপ! ক্লাস নাইনের একটা ছেলে কেন এত লাজুক মুখে বসে থাকে? জানা হল না।

শ্রেয়সী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ফিক করে হেসে বলেছিল, আমি শ্রেয়সী! পিচ্চিটাকে একটু আদর করা উচিত ছিল, করা হল না।

অনেক কিছুই করার ছিল। অনেক কিছু বলার ছিল।

ছয়.

আগের জগদীশ বসু ক্যাম্পগুলোর গল্প এখনো শেষ হয়ে যায় নি, কাজেই এবারের গল্প এত দ্রুত মুড়িয়ে যাওয়ার কথা না। এই গল্পগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, উপন্যাসটা বারবার এদিকে-ওদিকে বাঁক নেয়, ছন্দে-ছন্দে রঙ বদলায়, কয়েকজন মানুষ ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদতে থাকে, আবার কেউ অট্টহাসি হাসতে হাসতে হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। ওরা জানে, দিনশেষে দুটো চাল কেনা লাগবে, কিন্তু তবু, ওরা ভালোবাসে, প্রবলভাবে ভালোবাসে।

দেখা যাক, এবারের উপন্যাসটা কোথায় যায়!

“দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ,
ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ—
পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে চিরজনমের বেদনা।”