স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়েই রয়

এক.

সম্ভবত, প্রতিটা মানুষই আশ্চর্য একেকটা চরিত্র।

দুই-একদিন আগে পদ্মদের বাসায় আড্ডা দিতে দিতে আরেকবার ধাক্কাটা খেলাম।

হঠাৎ করেই ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। মাসখানেকেরও বেশি হয়ে গেল, পিচ্চিটার সাথে দেখা হয় না। ফোন দেয় প্রায়ই, ব্যস্ততার কারণে ধরি না। পরে নিজেরই মন খারাপ হয়।

আইজেএসও ক্যাম্পে শাওন (জেনেটিক্স ডিপার্টমেন্টের মেয়েটা) ক্লাস নিচ্ছিল সেদিন। শাওনের ক্লাসে যেহেতু আমার দাঁত ফোটানো কঠিন, চুপ করে শোনা ছাড়া অন্য কোন গতি নেই। তাই ভাবলাম, শাওন ক্লাস নিক, এই ফাঁকে আমি পদ্মদের বাসা থেকে ঘুরে আসি!

দুই.

পদ্মদের বাসার বেল চেপে দাঁড়িয়ে আছি। আন্টি এসে দরজা খুললেন। দরজাটা একটু ফাঁক করে হাসতে হাসতে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, কে?! এই পদ্ম, লাঠিটা নিয়ে আয় তো! সাথে একটা রাবার ব্যান্ডও নিয়ে আসিস, ও চুল বাঁধবে!

আমিও হাসতে হাসতে ঢুকলাম। পদ্মদের বাসায় বিশাল একটা বুকশেলফ, সেই বুকশেলফের পাশে মেঝেতে বসে আমি আর পদ্ম দুষ্টুমি করছিলাম। পদ্ম সবকিছু খেয়ে ফেলে তো, তাই সে হচ্ছে ভোক্কস। তাই শুনে পিচ্চিটা আমার নাম দিয়েছে খোক্কস। তো, আমি আমার ভোক্কস বোনটার আঁকা জিনিসপত্র দেখছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোক্কসটা একগাদা ছবি আঁকা মারবেল, রঙ, টিনটিনের বই—সবকিছু এনে জড় করে ফেলল। আমরা ওগুলো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি—এমন সময় আন্টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা নিয়ে আসলেন—এক কাপ চা! এরপর নিজেও আমাদের সাথে বসে পড়লেন বকবক করার জন্য।

বকবক করতে গিয়ে মা-মেয়ের সে কী হাসি! আন্টি হাসছেন, আমি পদ্মকে খেপালে আন্টিও খেপাচ্ছেন, তখন আবার পদ্ম দৌঁড়ে যাচ্ছে আম্মুর সাথে মারামারি করতে—রীতিমত হুলুস্থুল অবস্থা। মারামারি করার ধরনটাও মজার, দুজন দুজনকে আস্তে করে ধাক্কা দেয়, এরপর পদ্ম তার আম্মুর কোলে মাথা ঠেকিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি ছোটখাট একটা ভুল করে ফেললাম।

কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, আংকেল কোথায়।

আন্টি এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। এরপর হাসতে হাসতেই আকাশের দিকে দেখিয়ে বললেন, আংকেল উপরে!

তিন.

আমি আর কী বলব?

এসব শুনে অথৈয়ের মনে হয়েছে, আমরা অভিনেতা, অসম্ভব ভালো একেকজন অভিনেতা। বিশাল একটা নাট্যমঞ্চে আমাদের নামিয়ে দেয়া হয়েছে, আর আমরা প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচ্ছি। আমরাই আবার এই নাটকটার দর্শক—আগ্রহ নিয়ে দেখছি শেষপর্যন্ত নাটকটা কোথায় যায়।

অবশ্য, অভিনয় জানা মানুষগুলোরও ভুল হয়। সত্যিকারের মানুষটা তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। আমি ধাক্কা খাই, প্রায় প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রেই। আমি জানি ভেতরের মানুষটা অসংখ্য গল্প নিয়ে বসে থাকে, রূপকথার মত একেকটা গল্প। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মানুষটা যখন গল্পগুলো বলা শুরু করবে তখন আমাকে আশ্চর্য হয়ে শুনতে হবে—আমি জানি। তবু, ভেতরের মানুষটা যখন বেরিয়ে আসে তখন আমি একটা ধাক্কা খাই।

এত গল্প নিয়ে বসে থাকে মানুষ!

চার.

মায়া হয়, এই গল্পগুলো শুনলে অসম্ভব মায়া হয়।

ওরা যখন বলে, ইশ ভাইয়া, আমার যদি এরকম একটা বড়ভাই থাকত—তখন আমি হেসে ফেলি। আমিও তো একই কথা ভাবি, আমার যদি এমন ছোট ভাইবোন থাকত। (এই শুনে অবশ্য আদ্রতা চোখ বড়বড় করে বলেছিল, যদি থাকত মানে? আমরা তো আছিই!)

মানুষগুলো প্রায়ই আমাকে অদ্ভুত কথাবার্তা বলে। যেসব কথা শুনলে একুশ বছর বয়সী একটা ছেলে এলোমেলো হয়ে যেতে পারে—সেরকম কথা।

“You should come, Padmo will be delighted to have a brother to fight/talk/play/learn with.”

“ভাইয়া আপনি কি ঘুমাবেন? নাহলে এক কাপ কফি বানিয়ে খান, আমিও খাচ্ছি এখন।”

“ভাইয়া, তোমার কথা অনেক মনে পড়তেসিল দেখে ঐ ছবিটা দেখতেসিলাম। হাসিটা দেখতে ভালো লাগে, একদম বড়ভাই টাইপ!”

“আমার এত্ত ভালো একটা ভাইয়া, সেদিন ভাইয়াটা আমার সাথে টানা বকবক করসে!”

“Bhaiya, do you remember this picchi exists in the world?”

আমি আশ্চর্য হয়ে শুনি।

আহা, কী এসে যেত সবাই একই উপন্যাসের চরিত্র হয়ে জন্ম নিলে? পদ্মর সাথে মারামারি করার জন্য আমাকে আলাদা করে ডেকে আনতে হত না, প্রতিদিনই মারামারি করতাম। আমাকে কফি খাওয়ানোর জন্য কাউকে রাত দেড়টায় ফোন দিতে হত না, দুজন পাশাপাশি বসে কফি খেতাম। ভাইয়ার কথা মনে পড়লে কাউকে ছবি দেখতে হত না, চট করে পাশের ঘরে এসে ভাইয়াকে দেখে যেত। আমি দুইদিন বকবক না করার কারণে কাউকে মন খারাপ করে বসে থাকতে হত না, সারাক্ষণই তার বকবক শুনতাম।

যাকগে, আমাদের ইচ্ছায় অবশ্য এসব ঘটার কথা না!

পুতুলনাচের সুতো অন্য কারও হাতে, ওটা ধরার সাধ্য আমাদের নেই।

“কী আর এমন হবে, কে পেয়েছে কবে!
স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়েই রয়।”