ঢাকার মানভাষা, ঢাকার ভাষা এবং ঢাকার অপমানভাষা

এক. 

তনু আপু এক সকালে দারুণ উৎসাহ নিয়ে আমাকে ঝাড়ি দিচ্ছিলেন। 

আমি তখন কচি নধর শিশু, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। কলেজ-জীবনে চোখে ভারী চশমা এঁটে কেবল কাগজপত্রই ঘেঁটে গিয়েছিলাম, সুতরাং আমার সত্যিকারের পৃথিবী দেখার শুরুটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে। বেশ কাদা-কাদা একটা মাটির তাল ছিলাম, মানুষ যা বলতো সব কেবল কানভরে না, প্রাণভরেও গ্রহণ করতাম! 

তো, সেই সকালে তনু আপু বলছিলেন, আমি যেন ‘করসি-গেসি’-জাতীয় অপ্রমিত-ভাষায় না লিখি—কেননা অরিত্রদের মত ছোট মানুষেরা আমাদের দেখেই ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, এবং ওদের সামনে একটা সুন্দর আদর্শ দাঁড় করানো উচিত। 

আদর্শ দাঁড় করানোর ব্যাপারটা আপু এত সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, পরবর্তীতে আমার বহু মানুষকে কথাটা বলতে হয়েছে। 

কিন্তু, আদর্শ আসলে কী? 

ছোট পরিসরে, কেবল ভাষার আদর্শের কথাই যদি ভাবি, মানভাষায় না লিখলেই কি বাংলা অশুদ্ধ হয়ে যায়? 

দুই. 

আমার তা মনে হয় না। 

বাংলা ভাষার প্রমিত রূপটা আমরা পাইসি তুলনামূলকভাবে দেরিতে—ব্রিটিশ আমলে। কলকাতা বাংলার রাজধানী হবার পর সবাই যখন সেখানে জড় হতে শুরু করলো—তখন সবার বোঝার মত একটা প্রমিতভাষা (বা মানভাষা) খুব জরুরি হয়ে যাইতেসিল। কাজেই মানুষজন ঠিক করলো, কলকাতার উত্তরের নদিয়া-শান্তিপুরের ভাষাটাকে মানভাষা হিসেবে ধরে নেয়া হবে। 

ব্যাপারটা সেই মুহূর্তে যৌক্তিক ছিল। মানভাষা ছাড়া এই বিশাল বাংলার মানুষ একসাথে জড় হয়ে কথা বলতে পারতো না। 

কিন্তু তার অর্থ এই না যে, মানভাষাটাই ভাষার শুদ্ধতম রূপ, এবং এই মুহূর্তে ঢাকায় বসে আমাকে নদিয়া-শান্তিপুরের ভাষায় কথা বলতে হবে, মঞ্চে-সভা-সমাবেশে-টেলিভিশন-রেডিওতে আমার নিজের ভাষায় কথা বলা যাবে না, লেখা যাবে না আমার ভাষায়! 

নিজের ভাষাটাও কিন্তু ঢাকার সবার ক্ষেত্রে একরকম না। আমার কথাই যদি ধরি, আমার জন্ম ঢাকায়, কিন্তু ভাষাটা পুরোপুরি বিশুদ্ধ ঢাকাইয়া না। পারিবারিক কারণে কিছুটা দিনাজপুরী ভাষা, আম্মুর কারণে কিছুটা শুদ্ধ ভাষা, আবার স্কুল-কলেজের বন্ধুর কারণে কিছুটা ঢাকাইয়া ভাষা—সবকিছু মিলে একটা ভাষা দাঁড়ায় গেসে। ফলে খেয়েছিকে আমি বলি খাইসি; কিন্তু খাচ্ছিকে খাচ্ছিই বলি, খাইতেসি বলি না। (‘খাচ্ছিকে-খাচ্ছিই-বলি’ কি বেশি বিদ্‌ঘুটে শোনায়? :3) 

এই ভাষাটাই আমার প্রিয়, এবং এভাবেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। 

তিন এক্কে তিন. 

বাট প্রবলেমটা হইল এইখানে যে, ইন দিজ ডেইজ ইংলিশ শব্দগুলো যেন স্রোতের মত বাংলায় ঢুকতেসে। এই পয়েন্টে এসে মোস্ট অফ দা পিপ্‌ল বলার ট্রাই করে—ল্যাঙ্গুয়েজ হচ্ছে নদীর মত, একে ইচ্ছেমতই চলতে দিতে হবে। হিস্ট্রি বলে, অতীতেও অন্যান্য ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ড যখন বাংলায় ইন করসে, তখনও ওল্ড পিপ্‌ল রেজিস্ট করতো, কিন্তু একচুয়ালি তারা সাকসেসফুল হয় নাই। 

আমরা বোঝার ট্রাই করতে পারি যে, হিস্ট্রির সাথে প্রেজেন্ট সিচুয়েশনের ডিফারেন্সটা কী! 

আমাদের এই এরিয়ায় যেইটা ঘটতো, বাইরের কান্ট্রির (মাই ব্যাড, কান্ট্রি না বলে কিংডম বলতে হবে মে বি) লোকজন আইসা যখন রাজা হয়ে বসতো, তাদের সাথে আসতো তাদের কালচারটাও। ফর এক্সাম্পল মোঘলদের ভাষা ছিল ফারসি, ফলে তাদের আমলে একটা লার্জ এমাউন্টের ফারসি শব্দ বাংলায় ঢোকে (অফ কোর্স, সেই সাথে কালচারের অন্যান্য এসপেক্টগুলাও ঢুকসিল, যেমন মোঘল আর্কিটেকচার)। 

এইবার একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখা যায়। যেসব ফারসি ওয়ার্ড বাংলায় ঢুকসিল সেগুলো আসলে ভাষাটাকে কী করসে। 

‘অল্প’ আর ‘কম’—এই দুটো ওয়ার্ডের মধ্যে কোনটা আমরা ইউজ করি? আমি করি দুটোই—যখন যেইটাকে পারফেক্ট মনে হয়। আম্মু যখন আস্ক করে প্লেটে ভাত তুলে দিবে কিনা, আর আমার একটু ঢঙ করা লাগে, আমি তখন টেনে টেনে বলি, অ-ল-পো-ও একটু দিও! 

‘কম’ শব্দটা ইউজ করে কি এইভাবে বলতে পারতাম? মনে হয় না। আবার— 

বেশি বৈ কম নয় ছয়-সাত হাজারে 
গুণ্ডার দল এল সবজির বাজারে! 

রবিঠাকুর এই ছড়ায় ‘বেশি বই অল্প নয়’ লিখলে সব ডেসট্রয় হয়ে যেতো না? 

সো, ‘কম’ আর ‘অল্প’—এই ওয়ার্ড দুটো একসাথে হয়ে বাংলাকে আরও সমৃদ্ধ করসে। এদের মধ্যে কোনো একটা বাংলা, অন্যটা ফারসি। আমি বলতেসি না কোনটা কোন ভাষা। জাস্ট ওয়েইট ফর আ সেকেন্ড, অ্যান্ড থিংক—এমন আরও অনেক ফরেইন শব্দ আছে—যেগুলো বাংলার পাশাপাশি ইউজ্‌ড হইতেসে, এবং সেগুলো কীভাবে বাংলাকে ঋদ্ধ করতেসে। 

আবার কিছু ফারসি ওয়ার্ড ঢুকসে—যার ইকুইভ্যালেন্ট বাংলা ওয়ার্ড ছিল না (অ্যাজ ফার অ্যাজ আই নো)। যেমন ‘কারখানা’। যখন ইকুইভ্যালেন্ট ওয়ার্ড নাই, তখন ফরেইনটা অ্যাকসেপ্ট করা যেতেই পারে, উইথ প্লেজার! 

তিন দুগুণে তিন. 

কিন্তু আমরা যেইভাবে ইংলিশ ওয়ার্ড ইউজ করতেসি—এইটার কারণ কি বাংলায় ইকুইভ্যালেন্ট ওয়ার্ড না থাকা, নাকি পুরানোর পাশাপাশি নতুন ওয়ার্ডকে স্পেইস দিয়ে বাংলাকে আরও রিচ করা? 

ডিপ্রেসিং ব্যাপার হল, নান অফ দিজ। পুরো ব্যাপারটার পেছনে রয়েছে ক্যাপিটালিস্ট আগ্রাসন। এবং মনে রাখতে হবে যে, আগ্রাসন কখনই ভাষার এভোলিউশনের নরমাল ওয়ে না। কাজেই ‘ভাষা নদীর মত, একে আটকে রাখা যাবে না’—এই লজিক দিয়ে আগ্রাসনকে একসেপ্ট করে নেয়া যায় না। 

এবং ক্যাপিটালিস্ট আগ্রাসনের আরেকটা দিক হল, সেনটেন্সের মাঝে একগাদা ইংলিশ ওয়ার্ড বলে যে আমরা প্রাউড ফিল করি—কেবল তাই না, ইন সাম কেইসেস, বাংলা বলাটাকে একটা খ্যাতামো হিসেবে দেখা হয়। 

এক্সাম্পল হিসেবে বলা যায়, আমরা স্কুলে থাকতে দস্তগীর ভাইয়ারা বিজ্ঞানমেলা চালু করসিল (হুম, আমি ডিআরএমসিতে পড়তাম)! কলেজে উঠতে উঠতে সেটা হল সায়েন্স ফেস্ট। ভার্সিটিতে উঠেও দেখি কেবল ফেস্টই হয়ে থাকে। সেই ফেস্টের ওয়েবসাইট ইংলিশে, ইভেন্ট নেইম্‌স ইংলিশে, ডেকোরেশনের জন্য যা যা লেখা হবে সবই ইংলিশে। 

ঔ ম্যান, অল অফ দেম আর বেঙ্গলি পিপ্‌ল, দেন হোয়াই শুড ডু এভ্রিথিং ইন ইংলিশ! 

আমার সেনটেন্সের হাফ অফ দা ওয়ার্ড্‌স কেন হতে হবে ইংলিশ! 

তিন তিরিক্কে তিন. 

আমরা যদি নিজে থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ না করি, আগ্রাসন আমাদের পুরোপুরিই গ্রাস করবে। আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেললে অস্তিত্বের কোনো অর্থ থাকে না। জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের অস্তিত্বকে অর্থপূর্ণ করতে চাই কিনা—সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। 

পরিশিষ্ট. 

প্রাসঙ্গিক বলেই লিখতে ইচ্ছে করতেসে। আরিফ একবার কাউকে কিছু একটা উপহার দিবে। আমাকে বললো, যেন সেই উপহারের গায়ে লিখে দেই, with love! আমি প্রকাণ্ড এক ধমক দেয়ার পর সে অনেক ভেবেচিন্তে বললো, তাহলে বাংলায় লিখে দেন, ভালোবাসার সহিতে। 

এই শুনে হাত-পা অবশ হয়ে আমি মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম, গাধাটা বলে কী! 

সেদিন শেষপর্যন্ত আমরা লিখে দিসিলাম—ভালোবাসি, ভালোবাসি।