এলোকথন (আষাঢ়া ২৫:২)

শেষবিকেলে, সন্ধ্যে নামার আগে আগে রাস্তায় হাঁটছিলাম। এক চাচাকে বাসে তুলে দিয়ে ঘরমুখো হতেই আবিষ্কার করলাম, বিকেলটা অসম্ভব সুন্দর। এই বাতাসে যতখানি জল ধরার কথা তার চাইতে ইকটুউ বেশি আছে, সুতরাং এদিক-ওদিক জলের কণা হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে এর-ওর গায়ে পড়ছে। মানুষজন এতে বিরক্ত হচ্ছে না, বরং বেশ আরামই পাচ্ছে মনে হয়। 

বিকেলে স্নান করে বেরিয়েছিলাম, হয়তো একারণেই পবিত্র একটা অনুভূতি হচ্ছিল। বাসার ঢিলেঢালা জামা পড়ে বেরিয়ে পড়ায় ফুরফুরে একটা ভাব কাজ করছিল। আপনমনেই এলাকার রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। চমৎকার কিছু ফাঁকা রাস্তা আছে আমাদের এদিকে—খেয়াল করিনি আগে। কী মিষ্টি গন্ধ তার ফুটপাথে, মধ্যিখানে, প্রতিটা মোড়ে! 

আমি বোধহয় পাগল—কেননা আমার রাস্তা ভালো লাগে। রাস্তার এক কোণে চায়ের দোকানে বসে থাকা প্রৌঢ় লোকটাকে দেখে আমার মনে বিচিত্র কিছু বোধ কাজ করে। কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিজেকে জনশূন্য অন্য কোনো রাস্তায় আবিষ্কার করে আমি বিস্মিত হই। কখনো দু হাত পেছনে জড় করে, কখনো এক হাতে বই ধরে, কখনো অন্য হাতে হাত ধরে হাঁটতে গিয়ে আমার নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে হয়। 

ফলে এইসব মুহূর্তের ঝোড়ো হাওয়ায় একের পর এক চিন্তা মাথায় উড়ে আসতে থাকে। 

আমি সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কার্যকারণগুলো আবার-আবার ভেবে দেখি। কেমন করে এমনটা বাস্তব হল, বোঝার চেষ্টা করি। শ্রদ্ধার পদে আসীন মানুষগুলো কীভাবে একে-একে সেই আসন থেকে নেমে গেল—তা ব্যাখ্যা করতে না পেরে আমার নিজেকে অসহায় মনে হয়। ছ’ মাসের মধ্যে সব্বাই একসাথে আমার অশ্রদ্ধা পাওয়ার কাজ করবে? এতটা অতিরঞ্জন তো উপন্যাসেও ঘটে না! 

কাজেই আমার নিজেরে শূন্য মনে হয়। গুরুর সম্মান দেবার মতন কাউরে না পায়া আমি হাহাকার কইরা উঠি। গত ছয় মাসে যা দেখলাম, এর পর আর কোনো মাইনষেরে রেসপেক্ট করতে পারুম না—এইটা ভাইবা ভাইবা আমি পাগল হয়া যাই। 

তবু, বাঁইচা থাকতে ইচ্ছা করে। 

আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। আবিরের সাথে যখন আরও একটা ক্যাম্পে ক্লাস নেই, বাচ্চাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে বলি দু হাজার বছরের পুরনো গল্প, তখন দিনশেষে এককাপ চা খেতে খেতে আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। আরও একবার চট্টগ্রামের বাসে চড়ে সাঁ-সাঁ করে ছুটে যাবার সময়, কিংবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। 

ডুবে যাবার কথাও মনে পড়ে। যখন এই উপলব্ধিটা আসে যে, জীবনে বস্তুত সবই হারিয়েছি, তখন আরেকটা দিন জীবনের অর্থ খোঁজাটাকেই অর্থহীন মনে হয়। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমুদ্রের অতল জলে ডুব দিতে ইচ্ছে করে। বাইরে শান্ত হয়ে বসে ভেতরের আশ্চর্য যন্ত্রণায় আমি ছটফট করতে থাকি।