অর্থহীন গপ্পো (এক্সারসাইজ ২০১৯০৪.০১)

যতদিন ইসরাতকে চিনতাম ততদিন কোনো সংশয় আমার মধ্যে কাজ করেনি। কেননা, তার একটা পরিচয় ছিল। সে ছিল ইসরাত। যার কপালে রক্তের ছোপের মত টিপ লেগে থাকে। ইসরাত ছিল পৃথিবীর প্রথম মানুষ—যার চোখের দিকে দেখার আগে আমি টিপের দিকে দেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল—সেটাও বুঝি একটা চোখ। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে যুগ-যুগান্তরের কথা পড়ে ফেলা যাবে। ভদ্রসমাজ প্রথম দেখাতেই যুগ-যুগান্তরের কথা পড়ে ফেলাকে সমর্থন দেয় না। তাই ভদ্রতাবশত আমি তার পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার কাঁচুমাচু ভঙ্গি দেখে হয়তো রাস্তার পাশের সোনালু গাছটার একটু দয়া হয়—সে একটু এদিক-ওদিক গা-ঝাড়া দিয়ে ইসরাতের পায়ে হলদে ফুলের পাঁপড়ি ফেলে দেয়। তখন আমার মনে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়, কেননা তার পায়ে পড়ে থাকা সোনালুর পাঁপড়িকে আমার আরেকটা চোখ বলে ভ্রম হতে শুরু করে, এবং আমি তার হাতের দিকে দেখি, সেই হাত এমন একটা ভঙ্গিতে মুদ্রা করা ছিল যে, আমার নটরাজের মূর্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা শিবের কথা মনে পড়ে যায়, হাতের দিকে তাকিয়ে আমার শিবের উজ্জ্বল চোখের কথা মনে পড়ে, আমি পাগল হয়ে যাই, অমানুষিক এক প্রকার অস্থিরতায় ছটফট করতে করতে আমি প্রথমবারের মত ইসরাতের চোখের দিকে দেখি।

ইসরাতের একটা পরিচয় ছিল, কেননা সে ছিল একমাত্র মানুষ—যে তিনটা চোখ পরে ঘুরতো। তার কপালে হলুদ টিপ জেগে থাকতো সূর্যের মত। কালো টিপ লেগে থাকতো অন্তহীন শূন্যতার মত। কতবার, কত দিন আমার মনে হয়েছে পালিয়ে যাই, চিৎকার করে দৌড়াতে থাকি, একটা ট্রেনে উঠে সোজা বাড়ি চলে যাই, বড় রাস্তা পার হয়ে, জেলা স্কুলের পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে, সুবর্ণ চাচার বাড়ির দেয়াল টপকে, ধুলোভরা রাস্তায় মাইলখানেক দৌড়ে, কবরস্থান পার হয়ে, সোজা আমার টাঙন নদীর পাশে গিয়ে বসে পড়ি, মাঘী টাঙনের স্বচ্ছ পানিতে আমার ছায়াটা দেখি। তখন আমি নিজেকে ইসরাতের স্বচ্ছ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে আবিষ্কার করে বড় বিব্রত হয়ে পড়ি, তাকে টাঙন নামে ডাকার একটা তীব্র ইচ্ছা আমাকে দ্বিগুণ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

অবশ্য, এই নিয়ে কোনো ধরনের সংশয়ে পড়তে হয়নি আমাকে। আমি তো জানতাম, এমনটা হয়েই থাকে, জীবনের স্বাভাবিক সূত্র বলে যে, কার কপালের টিপ যে চোখের মত মনে হবে, সেই চোখ কখন যে নদীর মত মনে হবে, আর কেন যে নদীটাকে নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছা করবে—তার কোনো সূত্র নেই। তাই মানবিক অস্থিরতার কুয়াশার ভেতরেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম, কোনদিকে হাঁটতে হবে। কী ভাগ্য, আমার এটাও জানা ছিল যে, সবসময় নদীর দিকেই হাঁটতে হয়, কেননা নদী দেখলে সবসময়ই মনে হয়, কোথাও এসে পৌঁছালাম!

আমার সবসময়ই একটা প্রশ্ন ছিল, এই মানবজনম দিয়ে আমি করবটা কী। এই সংকটটা আমার মধ্যে প্রথমবারের মত জন্ম নেয়—যখন আমরা পড়ি ক্লাস সেভেনে। স্কুলের পঁয়ত্রিশটা বাথরুমের সিটকিনি খুলে আমরা সারা স্কুলবিল্ডিং টহল দেই, এক হাত লম্বা লোহার সিটকিনি প্যান্টের কোমরে গুঁজে হাঁটতে গিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের গাম্ভীর্য জন্ম নেয়, ফলে এক দুপুরের ব্যবধানে আমাদের হাঁটার ছন্দ, ঘাড় নাড়ানোর ভঙ্গিমা, হাসির শব্দ—সবকিছু পাল্টে যায়—যেখান থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা বের হতে পারি না। সেই দিন স্কুলের আঠারোটা জানালা ভেঙে আমরা যখন অংক স্যারের জানালা গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য এগোচ্ছি—সেই সময় দপ্তরী কৃষ্ণা ভাই প্রথমবারের মত ব্যাপারটা খেয়াল করে। সে তখন মাত্রই আখ খেতে শুরু করেছিল, ফলে কর্তব্য পালনের প্রক্রিয়াটা তার জন্য অত্যন্ত সহজ হয়ে ওঠে, কৃষ্ণা ভাই আখ নিয়ে আমাদের তাড়া করতে শুরু করলে তার কুত্তাটাও কী ভেবে আরেকটা আখ কামড়ে ধরে দৌড়াতে থাকে। কী জানি বাপু, সে হয়তো ভেবেছিল এটাও একটা খেলা, তার মনিব হয়তো সারা সকাল টিচারদের ঝাড়ি খেয়ে এখন একটু আখ নিয়ে দৌড়ে আনন্দ করতে চায়, ফলে আমরা কৃষ্ণা ভাইয়ের সাথে তার কুত্তারও তাড়া খাই, সবাই মিলে হুড়মুড় করে স্কুলের পেছনের গেটে এসে আবিষ্কার করি যে, কৃষ্ণা ভাইয়ের সাথে বর্তমানে আমাদের যেই পরিমাণ দূরত্ব, এবং এই দূরত্ব অতিক্রম করে আমাদের কাছে আসা পর্যন্ত তার যেই পরিমাণ সময় প্রয়োজন, এবং এই পরিমাণ সময়ে জেলা স্কুলের পেছনের গেট দিয়ে যেই পরিমাণ ছেলে বের হওয়া সম্ভব—তার তুলনায় বেশিসংখ্যক ছেলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ‘বাইর হ বাইর হ’ বলে তুলকালাম করে, এবং এতে যেটা অবধারিত ছিল সেটাই ঘটে—কৃষ্ণা ভাই তিনজনকে আখপেটা করে হেডস্যারের কাছে নিয়ে যায়।

আমি সেই তিনজনের কোনোজনই ছিলাম না, কাজেই সেই দুপুরে আমার বিমর্ষ হওয়ার মত বিশেষ কিছু ঘটেনি। বরং কৃষ্ণা ভাই আখ খেতে খেতে যখন চোখ কপালে তুলে একটা বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে দৌড়ে আসে—সেই দৃশ্যটার কথা মনে করে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার বেশ ঝরঝরে একটা অনুভূতি হয়। রাতে স্বপ্নের মাঝে আমি মেরিলিন মনরোকে একটা সিটকিনি চাবাতে দেখি, প্রতিবার চাবানোর সময় কেমন যেন কাচ ভাঙার শব্দ হয়। মেরিলিন খুব আদুরে ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে সুর করে বলে, কাচ খাবু না বাউ? ঘুম ভাঙার পর আমি মনে করতে পারি, মেরিলিন আমাকে কাচ খাওয়ার প্রস্তাব যেই সুরে দেয়—সেটা আজম খানের ‘হারিয়ে গেছে’ গানের সুর, ফলে মেরিলিনের আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলার বিষয়টা কিছু সমস্যার সৃষ্টি করলেও, অনেক দিন ধরে আজম খানের গানটা আমার মাথায় ঘুরতে থাকে।

কিন্তু সেদিনই স্কুলে গিয়ে আমি যখন জানতে পারি আগের দিন ধরা পড়া তিনজনকে পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলার বদলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, এবং সকাল নটার ক্লাসে যখন হেডস্যার এসে অত্যন্ত বিষণ্ন ভঙ্গিতে দাঁড়ান, প্রায় তিন মিনিটের অসহ্য নীরবতা ক্লাসের সবাইকে অস্থির করে তোলে, কাঞ্চন পর্যন্ত কাটাকুটি খেলা থামিয়ে ছটফট করতে থাকে, তার মনে হয়, এই বুঝি ক্লাসের ছাদটা ধসে তাদের মাথার ওপরে পড়লো, সে চারদিকে তাকিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকে, এবং একসময় পিনপতন নীরবতার মধ্যেই দু হাতে কান চেপে চিৎকার করতে করতে ক্লাসের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।

তখন হেডস্যার ধীরে ধীরে, প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বলেন, বাপ, তোরা এই কাজটা করলি ক্যানো?

এই ‘ক্যানো’ শব্দটা বহুদিন ধরে আমাদের মনে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, আমাদের মনে হয়, ক্লাসসুদ্ধ সবাই ন্যাংটা হয়ে বসে আছি। বারবার চারদিকে দেখে আমরা এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হই যে, সবার পরনেই জামাকাপড় আছে, কিন্তু ক্লাসের সবাই ন্যাংটা হয়ে বসে থাকার অনুভূতিটা কোনোভাবেই দূর করা যায় না। সেদিন বাসায় ফিরে মুবিন প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়, আটদিনের জ্বরে ভুগে মারা যাওয়ার আগে সে একমাত্র যেই প্রলাপের বাক্যটা বলতে পারে—সেটা লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে আশেপাশের জেলাগুলোতে প্রায় কিংবদন্তীর মর্যাদা লাভ করে, প্রায় ত্রিশ বছর পর পঞ্চগড়-রংপুর রুটের বিআরটিসি বাসের ড্রাইভার যখন দশমাইল পার হবার সময় এক রিকশাওয়ালার গালি খায়, তখন সে হেলপারের দিকে তাকিয়ে সেই কিংবদন্তী-বাক্যটা স্মরণ করতে পারে—ভাই, মোক একটা লুঙ্গি দে। অবশ্য, রসিক ড্রাইভারের ধারণা ছিল, বাক্যটার জন্ম নিছক রসের বশেই, কিন্তু, আমি তো জানি, এই একটা বাক্য কতদিন ধরে আমাদের তাড়া করে বেরিয়েছে, হেডস্যারকে যতবার দেখেছি, প্রতিবারই কত অসহায়ের মত মনে হয়েছে, ভাই, মোক একটা লুঙ্গি দে। এবং আটদিনের জ্বরে ভোগার পর মুবিন যখন শান্ত হয়ে ঘুমাতে পারে, তখন তাকে আমরা মাটি দিয়ে ফেরার সময় আমাদের প্রচণ্ড পিপাসা পায়, কবরস্থানের দক্ষিণ দিকের টিউবয়েলটা ঠেসে আমরা প্রাণভরে পানি খাই, আমাদের তৃষ্ণা মেটে, এবং তখন কাদামাখা হাতের দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে পড়ে, এই হাত দিয়েই মুবিনকে একটু আগে মাটি দিয়ে এসেছি। প্রাণভরে পানি খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে তখন আমাদের তীব্র আত্মগ্লানিবোধ হয়—যেন এই কাজটা আমাদের করার কথা ছিল না। হয়তো একারণেই টিউবয়েলের পাশে কাঞ্চন মাথা টিপে বসে থাকে। আলভী গিয়ে তার ঘাড়ে হাত রাখার পর সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, সেই কান্না মানুষেরও আগে সংক্রমিত হয় গাছের মধ্যে, কেননা কাঞ্চনের অশ্রুপাতের সাথে কবরস্থানের দেয়ালঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছটা পত্রপাত করতে থাকে। একসময় কবরস্থানের প্রতিটা গাছ থেকে আমরা বৃষ্টির মত পাতা ঝরতে দেখি। তখন আমার মনে এই প্রশ্নটা জন্ম নেয় যে, কবরে শুয়ে থাকা মুবিন এবং টিউবয়েল ঠেসে পানি খেতে থাকার আমার মধ্যে বিভাজনটা ঠিক কোথায়। আমি মুবিন না হয়ে আমি হওয়ার কারণে কাদামাখা হাতে টিউবয়েল ঠেসে তৃষ্ণা মেটাতে পারি, কিন্তু এই মানবজনম দিয়ে আমি করবটা কী।

সেই ঘন নীল সন্ধ্যায় আমরা কবরস্থান থেকে বেরিয়ে আসার আগেই বৃষ্টি নামতে শুরু করে। সেই সন্ধ্যায় আমি বৃষ্টিকে নীল রঙ নিয়ে পড়তে দেখি, এবং সেই নীলে একের পর এক গাঢ় শেড পড়তে দেখি, ঘন হতে হতে বৃষ্টির রঙটা অন্ধকার হয়ে যায়, যখন আমি বাসায় পৌঁছাই। আর সেই বৃষ্টির কথা আমার আবারও মনে পড়ে যায়, যেদিন ইসরাত নীল একটা টিপ পরে বের হয়। বহু বছরের পুরনো প্রায়-বিস্মৃত একটা সন্ধ্যা একের পর এক স্ট্রোক নিয়ে আমার সামনে তেলরঙে আঁকা একটা ছবির মত এসে দাঁড়ায়।

[চললেও চলতে পারে।]