ডগ্গো‌

লিনুর মধ্যে এই অপরাধবোধটা কাজ করে—কেননা সারা দুপুর ল্যাব করে বিকালবেলা তার ক্লান্ত লাগে, এবং সে টিএসসিতে যায় চা-বিস্কুট খেতে, তখন হয়তো একটা বাদামি কুকুর এসে ঘুরঘুর করে, বারবার লেজ নাড়ায়, মুখ তুলে লিনুর দিকে দেখে, ফলে লিনুর মনে হয় কুকুরটা হয়তো খাবারের ভাগ চায়, তখন সে প্রথমে হাসে, এরপর প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে বলে, দাঁড়া দিতেসি তোরে বিস্কুট—এবং এর ফলে যেই দুর্ঘটনাটা ঘটে—সেটার জন্য আজীবন লিনু নিজেকেই দায়ী করে, এবং তার মধ্যে এই অপরাধবোধটা কাজ করে যে, এক ক্লান্ত বিকালে সে একটা কুকুরকে বিস্কুট খাওয়ার জন্য দাঁড়াতে বলে।

বস্তুত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কেউই এই ঘটনার সাথে লিনুর সম্পৃক্ততার কথা স্মরণ করতে পারে না—কেননা যারা সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল কিংবা ছিল না—তারা ঘটনার কার্যকারণের চেয়ে ফলাফল সংক্রান্ত আলোচনাতেই বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। সেই বিকালে লিনু যখন এক হাতে চায়ের কাপ এবং অন্য হাতে বিস্কুট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন বাদামি কুকুরটা এসে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আহ্লাদ প্রকাশ করে, এবং লিনু যখন বলে, দাঁড়া তোরে দিতেসি বিস্কুট—তখন কুকুরটা সামনের দুই পা তুলে আক্ষরিক অর্থেই দাঁড়িয়ে পড়ে। দু-একজন এই বিষয়টা লক্ষ্য করে, ফলে তারা হেসে ওঠে, এবং লিনুও হাসতে হাসতে কুকুরের মুখে একটা বিস্কুট ছুঁড়ে দেয়। একটা বিস্কুট দেয়ার পরেও কুকুর সামনের পা তুলে দাঁড়িয়েই থাকে, ক্রমাগত লেজ নাড়ে, এবং জিভ বের করে হাঁপায়। লিনু দ্বিতীয় বিস্কুট ছুড়ে দিলে সেটা খপ করে কামড়ে খায়, এরপর তৃতীয় বিস্কুটের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে দুই পায়ে হেঁটে চলে যায়।

সেই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কুকুরসমাজের মধ্যে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ে। সেকেন্ড ইয়ারের কোনো এক ছেলে, হয়তো সেটা গৌতম, কিংবা সাদমান, অথবা হয়তো সেই ছেলে আদৌ সেকেন্ড ইয়ারের ছিলই না, সে ছিল থার্ড ইয়ারের, আর তার নামও হয়তো গৌতম বা সাদমান ছিল না, তার নাম ছিল হয়তো অরিত্র—এবং সে হয়তো হলের বারান্দায় আদ্ধেকটা চাঁদ দেখে আউলা হয়ে পড়ে, রাত পৌনে একটায় হল ছেড়ে বেরিয়ে ক্যাম্পাসের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে, হাঁটতে হাঁটতে হয়তো সে নিজের অজান্তেই টিএসসিতে এসে পড়ে, তখন তার মনে হয়তো এক ধরনের ভাব জন্ম নেয়, ফলে সে জোর গলায় হাঁক দেয়, আআরি রে, আআরি রাং। এই হাঁকের ফলে টিএসসির সামনে ঘুমিয়ে থাকা কুকুররা সচেতন হয়ে ওঠে। প্রথমে একজন উচ্চস্বরে অরিত্রকে স্বাগত জানায়, এরপর বাকিরা সেই সম্ভাষণে তাদের পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে। ফলে অরিত্র প্রথমবারের মত খেয়াল করে যে, সে এক পাল ঘুমন্ত কুকুরের মাঝখানে এসে হাজির হয়েছে। ক্লাস ফোরের কোনো এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা থেকে অরিত্রর এই সূত্র জানা ছিল যে, কুত্তার সামনে দৌড়াইতে নাই। ফলে টিএসসির কুকুরদের জোরালো বক্তব্যের বিপরীতে সে গম্ভীরমূর্তি ধারণ করে, এবং বিশ্বসংসারের ব্যাপারে তার নিস্পৃহতা প্রকাশ করে। এতে কুকুরের দল আশাহত হয় না, তারা বেশিরভাগই চার পায়ে, এবং কেউ কেউ দু পায়ে হেঁটে এসে অরিত্রকে ঘিরে দাঁড়ায়, এরপর তার স্যান্ডেল কিংবা টিশার্টের কোণায় কোনো সুস্বাদু বস্তু মাখানো আছে কিনা—সেটা পরখ করে দেখতে শুরু করে। পরবর্তীতে অরিত্রর সাথে আলাপচারিতায় ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরা জানতে পারে যে, যেসব কুকুর চার পায়ে হাঁটে তারা স্যান্ডেলের স্বাদের ব্যাপারে, এবং দুপেয়ে কুকুররা টিশার্টের স্বাদের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। আস্বাদনের পাশাপাশি তারা উঁচু গলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনায় রত হয়, ফলে অরিত্র মুখে নির্বিকারত্ব ধরে রাখলেও তার মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়, এবং ধীর পায়ে সে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। এই সময় টিএসসির পাশের ফুটপাথে চার-পাঁচজন পুলিশকে ঝিম ধরে বসে থাকতে দেখা যায়। নাইট ডিউটির পুলিশদের দেখে কুকুরের দল তাদের মনোযোগের নতুন উৎস খুঁজে পায়, সমস্বরে আনন্দ প্রকাশ করে তারা পুলিশের দলের দিকে অগ্রসর হয়। বেশিরভাগই চার পায়ে, কেউ কেউ দু পায়ে।

অরিত্র হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, এবং দ্রুত হলের দিকে হাঁটা দেয়।

যদিও সে খেয়াল করেনি, কিন্তু কুকুরদের সবাই পুলিশবাহিনীর সাথে খেলা করতে গেলেও একটা দলছাড়া কুকুর দু পায়ে অরিত্রকে অনুসরণ করে হল পর্যন্ত আসে। সেই রাতে অরিত্র ঘুমিয়ে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত কুকুরটা দু পায়ে হলের সামনে পায়চারী করতে থাকে। শেষরাতে তার মনে এক ধরনের বিষণ্ণতা জন্ম নেয়। ভোরের আলো ফুটবার আগমুহূর্তে সে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নের মধ্যে সে নিজেকে দু পায়ে হেঁটে হলে প্রবেশ করতে দেখে, এবং অরিত্রকে হলের বাইরে চার পায়ে পায়চারী করতে দেখে।

সেই সকালেই ক্যাম্পাসের সব পাতা হলুদ হয়ে পড়ে। এক ধরনের উজ্জ্বল হলুদ, একবার দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে বলাবলি করে, যেকোনো বড় ঘটনার পূর্বে প্রথমত ক্যাম্পাসের সব গাছে হলুদ, এরপর অর্ধেক গাছে নীল পাতা দেখা যায়। ফলে ফার্স্ট ইয়ারের কেউ কেউ তুমুল উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, কী হয় কী হয়! এই উৎসাহের কারণে সকাল আটটার ক্লাসে সবার এ্যাটেন্ডেন্স বাড়তে শুরু করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একরকম প্রাণের সঞ্চারণ ঘটে, কিন্তু এরপরেও গাছে তারা নীল পাতার দেখা পায় না, কেবল সকাল আটটা থেকে এগারোটা ক্লাস করে খিদায় যখন তাদের বারোটা বাজতে শুরু করে, তখন তারা বেরিয়ে সিঙ্গাড়া দিয়ে চা খায়, এবং তখন ক্যাম্পাসের কুকুররা দুই পায়ে এগিয়ে আসে, এবং তখন পাবলিক এ্যাডের প্রান্তী, কিংবা হয়তো জেনেটিক্সের সুষ্মী, অথবা হয়তো চারুকলার আদিত্য আদর করে তাদের সিঙ্গাড়ার ভাগ দেয়। সামনের দুই পা উঁচু করে দাঁড়ানোর ফলে তাদের খাবার দিতে বড় সুবিধা হয়। এরপর, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সূত্রে মানুষজন জানতে পারে যে, কুকুররা খেয়েদেয়ে সন্তুষ্ট হয়, এবং তারা লেজ নেড়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, তারপর হেঁটে চলে যায়, দুই পায়ে।

কিন্তু ক্যাম্পাস তো ক্যাম্পাসই, সেখানে মিছিল থাকে, সেই মিছিলে সংসারী থাকে, সংসার-বিরাগী থাকে। ফলে অবধারিতভাবেই এক রোদলাগা দুপুরে, যেদিন মনে হচ্ছিল ভার্সিটির প্রতিটা গাছে হলুদ পাতার আগুন লেগে গেছে, সেদিন ভার্সিটির কয়েকজন নিজেরাই আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে, তারা ক্যাম্পাসজুড়ে স্লোগান দিয়ে বেড়ায়। রসিকজনেরা এর মধ্যেও লক্ষ্য করে যে, মিছিলের সামনে-পিছে বেশ কিছু দুপেয়ে কুকুর দেখা যায়। তারা স্লোগানে গলা মেলায় কিনা এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক থাকে, কিন্তু এ ব্যাপারে সবাই একমত হয় যে, দুটা মিছিল যখন পরস্পরের মুখোমুখি হয়, একটা অনিবার্য সংঘর্ষ ক্যাম্পাসকে উত্তাল করে তোলে, তখন উভয় মিছিল থেকেই দুপেয়ে কুকুররা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, এবং তাদের আঁচড়-কামড়ে আহত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে যেতে হয়। কেউ কেউ দাবি করে, সংঘর্ষের এক পর্যায়ে দুপেয়ে কুকুরদের কোনো একজন লাফিয়ে উঠে ফার্স্ট ইয়ারের শাওনকে একটা চড় মারে, নাহলেও অন্তত চড় মারার মত একটা ভঙ্গি করে, কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে অন্তত পঁয়তাল্লিশজন শাওন থাকায় এই ঘটনার সত্যতা কখনো যাচাই করা যায় না। কিন্তু টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় ক্যাম্পাস আচ্ছন্ন হয়ে গেলে একসময় সবাই খানিকটা ঝিমিয়ে পড়ে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় তারা জড় হয়ে বসে, উত্তেজিত গলায় সারাদিনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে লিপ্ত হয়।

তখন ক্যাম্পাসের কুকুরদের কেউ কেউ এসে তাদের পাশে বসে পড়ে। ক্রমাগত লেজ নেড়ে তারা আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে। হয়তো জড় হয়ে বসা ছেলেদের, কিংবা মেয়েদের, কিংবা ছেলেমেয়েদের কারো কারো মনে এক ধরনের স্নেহ জন্ম নেয়, তখন হয়তো সাইকোলজির বিন্দু আপনমনে একটা কুকুরকে আদর করতে থাকে। ফলে প্রায় সবাই এক ধরনের ক্লান্তিতে পড়লেও, সেই বিকালটা কিছু কুকুরের অত্যন্ত চমৎকার কাটে। এক সময় আদরের আতিশয্যে তারা ঘুমিয়েও পড়ে।

এরও অনেক অনেকক্ষণ পরে, সন্ধ্যায়, কিংবা আরেকটু রাতে যখন তাদের কারো কারো ঘুম ভাঙে, ততক্ষণে সভাভঙ্গ হয়ে যায়, এবং যাদের ঘুম ভাঙে তারা জেগে উঠে নিজেকে একাকী আবিষ্কার করে। আশেপাশে ছেলেমেয়েদের ইতস্তত আড্ডার মাঝে একা নিঃসঙ্গ ঘুমানোর কারণে তারা প্রথমে বিব্রত হয়, এরপর একটা গভীর বিষাদ তাদের ঢেকে ফেলে। ধীরে ধীরে প্রথমে তারা চার পায়ে দাঁড়ায়, এরপর তাদের কিছু একটা মনে হয়, তারা জিভ কাটে, এবং দুই পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলে থাকে, সেই রাতে ক্যাম্পাসের কুকুরদের স্বভাবসিদ্ধ আহ্লাদী আচরণ করতে দেখা যায় না। তাদের প্রায় সবাই মাথা নিচু করে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। রাত গভীর হলে তারা ধীরে ধীরে জড় হয়। সেই রাতে তাদের সভায় কী বিষয়ক আলোচনা হয় সেটা সবার অজানাই থেকে যায়, কিন্তু নিকটবর্তী হলের ছেলেরা, কিংবা মেয়েরা স্মরণ করতে পারে যে, সভার পরিসমাপ্তি হয় প্রচণ্ড উল্লাসের মধ্য দিয়ে, আশেপাশের দু-তিনটা হলের অনেকেই ঘুম ভেঙে সেই উল্লাসের ভাঙতি শুনতে পায়।

প্রথমে একদিন।

দুদিন।

এরপর প্রায়দিন।

এবং সিএসইর ইসরাত এক রাতে হলের গেট খুলে বেরিয়ে তাদের ঝাড়ি দিতে গেলে পাল্টা চিৎকার সামলাতে না পেরে ফিরে আসে, এবং পরদিন সোশিওলজির সুদীপ্ত ঝাড়ি দিতে বেরোলে পাল্টা কামড় খেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়, ফলে ব্যাপারটা ক্যাম্পাসে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়, এবং কোনো এক দুপুরে হলে ফিরে ইসরাত তার রুমমেট মীমকে হাঁটু গেড়ে পায়চারী করতে দেখে। ইসরাতকে দেখে মীম বিব্রত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়, এরপর কৈফিয়ত দেয়—হাঁটু দিয়ে হাঁটা বড় ভালো ব্যায়াম। দীর্ঘ সময় ব্যায়াম করার কারণেই হয়তো মীম খানিক হাঁপায়, তার জিভ বের হয়ে থাকে।

এবং যেই বিকালে লিনু আবারও টিএসসিতে বসে চা খায় এবং আড্ডা দেয়, তখন বাইরে এক ধরনের হইচই শোনা যায়। লিনু দ্রুত বেরিয়ে একটা মিছিল দেখতে পায়। অন্তত একশোটা দুপেয়ে কুকুর সেই মিছিল নিয়ে টিএসসি পার হয়ে চলে যায়। মিছিলের ফাঁকে ফাঁকে কিছু মানুষও দেখা যায়। তাদের কেউ কেউ দু পায়ে, কিন্তু অনেকেই হাত এবং হাঁটুতে ভর দিয়ে চার পায়ে হাঁটে।

জনশ্রুতি আছে, ঠিক সেদিন ভোরেই ক্যাম্পাসের অর্ধেক গাছের পাতা নীল হয়ে যায়। এক ধরনের বিষাদবর্ণ নীল। ক্যাম্পাসজুড়ে পড়ে থাকা উজ্জ্বল হলুদ এবং বিষাদবর্ণ নীল পাতা মিলে যেই অপূর্ব দৃশ্যের জন্ম দেয়—সেটা অধিকাংশ মানুষকেই আশ্চর্যরকম মুগ্ধ করে। বিভিন্ন দৈনিক পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

দেশের মানুষ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে।