বুড়ো

ওদের দুজনের সাথে কবে পরিচয় হয় আমার মনে নেই। ভাইয়া আমার চেয়ে বয়সে পাঁচ মাসের বড়, জ্ঞান হওয়ার পর আবিষ্কার করেছি, আমি তাকে ভাইয়া বলে ডাকি। আর অলিন্দ আড়াই বছরের ছোট, জ্ঞান হওয়ার পর আবিষ্কার করলাম, আমি তাকে অলিন্দ বলে ডাকি (খুব একটা আশ্চর্যের ব্যাপার না এটা অবশ্য, স্বীকার করছি)।

আমি যখন অনেক ছোট, আমরা একসাথে থাকতাম। ওদের আব্বু আবার সম্পর্কে আমার চাচা হয়। আপন চাচা। আমার আব্বু বড় ভাই, এরপর একজন সেকেন্ড হয়েছিল, আর ওদের আব্বু থার্ড হয়েছে। থার্ড হওয়ার কারণেই কিনা কে জানে, দাদু তার নাম রেখেছিল বাবু। তো, ধানমণ্ডির একটা দোতলা বাসায় বাবুচাচারা আর আমরা থাকতাম। সাথে থাকতো ভাড়াটিয়া, আর ভাড়াটিয়াদের বিশাল এক কুকুর। আমার জীবনটা শুরু হয়েছিল এভাবেই, ভাইয়া, অলিন্দ, আমাদের দুই পরিবার, বৃদ্ধা ভাড়াটিয়া, আর একটা কুকুর নিয়ে।

তারপর, মনে হয় আমার বয়স তখন তিন বছর, আমরা বাসা পাল্টালাম। মোহাম্মাদপুরের এদিকে খুব শান্ত একটা জায়গা আছে। এখানে আমরা বাসা নিলাম, আর আমাদের দুই-এক বাসা পরেই বাসা নিল চাচারা। এরপর আমরা আরেকটু বড় হলাম, আমাদের আরেকটু জ্ঞান হল, আর আমরা তিন ভাই দিনরাত একসাথে হাউকাউ শুরু করলাম! সমবয়সী তিন ভাই একসাথে থাকলে যেসব হয় আরকি। পাড়ার ছেলেদের সাথে একসাথে ক্রিকেট খেলা। বৃষ্টির দিনে কাদা মেখে ফুটবল। খেলতে খেলতে ঝগড়া। আহা, তখন সিডি কিনে গান শোনার যুগ ছিল! আর সেই সময়ে বাংলা ব্যান্ডগুলো ব্যাপক ফর্মে ছিল। আমরা সিডি কিনতাম, আর ভাইয়ার সিডি প্লেয়ারটায় গান ছেড়ে দিতাম। বৃষ্টির দিনে গান শুনতে শুনতে আমরা বাসাতেই ক্রিকেট খেলতাম। সেই সময়ের তুলনা হয়? ঈদে দাদুবাড়ি যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে আমাদের পরিকল্পনা শুরু হত কী কী নিবো। ভাইয়া! আমরা কি মারুতি ব্যাটটা নিচ্ছি, নাকি নাটওয়েস্ট?? অ্যাই অলিন্দ দাদুবাড়িতে কি এক সেট উইকেট রেখে আসচিলাম?! নোবেল ভাইয়াআআআ!! আমি বাসে জানালার পাশে বসবো।

তখন সোনালি রঙের বৃষ্টি হত। মাঝেমাঝে রূপালি বৃষ্টিও হত, আমার স্পষ্ট মনে আছে।

ওল্ড ডেজ। গুড ওল্ড ডেজ।

এখন তিনজনই একটু বুড়ো হয়েছি। কয়েকদিন আগে অলিন্দ দেখলাম শেভও করা শুরু করেছে, বেচারাকে আমি আর ভাইয়া খেপালাম অনেক্ষণ ধরে। প্রথমবার শেভ করার পর জনসমক্ষে আসার স্মৃতি খুব একটা সুখকর হয় না অবশ্য! যাকগে সে কথা। তো, বুড়ো হওয়ার কারণে যা হয়েছে, আমরা তিনজন একসাথে বসলে আশি বছর বয়সী দার্শনিকের মত বড় বড় কথা বলি। প্রচুর বকবক করি আমরা, প্রচুর। একদিনের কথা মনে আছে, ভাইয়া যখন ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে, আমি ওদের বাসায় গিয়েছি ভাইয়ার সাথে পড়াশোনা করতে। আমি ভাইয়ার ঘরে বসলাম, অলিন্দ টুকটুক করে হেঁটে এদিকে চলে আসলো, চাচী এসে চা দিয়ে গেল, আর আমরা তিনজন....ধুমসে আড্ডা! কোথায় পড়াশোনা, কোথায় কী।

অবশ্য সবসময় যে আড্ডা জমে, এমনও না। মাঝেমধ্যেই এমন হয়, তিনজন মিলে চুপ করে আছি। মাঝেমধ্যে কেউ কোনো একটা কথার বেলুন ফোলাচ্ছে, সেটা সাথে সাথেই দুম করে ফেটে যাচ্ছে। তখন আমাদের মধ্যে কোনো একজন গম্ভীর মুখে ঘোষণা করে, আচ্ছা ঠিক আছে আজকে আসি। অন্য দুজনও গম্ভীর মুখে সায় দেয়, যেন এইমাত্র বিশাল একটা কাজ হয়ে গেল। তারপর....তিনজন বাসায় ফিরে যাই, যে যার যার কাজে। সবকিছুই স্বাভাবিক লাগে।

বিশ বছর অনেক বড় একটা সময়। বিশ বছর ধরে তিন ভাই একসাথে থাকলে নিজেদের মাঝখানে অসম্ভব চমৎকার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। আমাদেরও সেটা হয়েছে।

কয়েকদিন আগে ভাইয়ার জন্মদিন ছিল। আজকে অলিন্দর জন্মদিন। একটু আগে আমাদের এলাকায় লোডশেডিং চলছিল, তখন আমি ওদের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি বাসায় কেউ নেই, শুধু ওরা দুইজন নির্বিকারমুখে বসে আছে। তেমন কিছু করার নাই, তিনজন মিলে ছাদে গেলাম নক্ষত্র দেখতে। ছাদজুড়ে উথালপাথাল বাতাস, আর লোডশেডিং-এর কারণে আকাশে অনেকগুলো নক্ষত্র। গতকাল আমি আর চাষী একটা কনস্টেলেশন দেখেছিলাম, চিনতে পারি নি যদিও। অসম্ভব সুন্দর একটা কনস্টেলেশন। আজকে অলিন্দকে সেটা দেখালাম।

আমার আঠারো বছরের পুরনো ভাইটাকে জন্মদিনে পুরো একটা কনস্টেলেশন দিয়েছি, ভালো লাগছে আজকে।