যারা বেঁচে আছে, যারা বেঁচে নেই

একগাদা কাজ ফেলে রেখে লিখতে বসলাম। এই ঘরে বসে লিখতে বড় ভালো লাগে। আমার ঘরটা বেশ ছোট, কিন্তু অনেক বছর ধরে অল্প অল্প করে গোছানো। দেয়াল থেকে ঘড়ি, ক্যালেন্ডার সবকিছু সরিয়ে দেয়াল সাদা করে ফেলেছি, বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আপুর ঘরের বুকশেলফ থেকে ভালো ভালো বইগুলো এনে আমার বুকশেলফে রেখেছি, ছাদের সাথে লাগানো বুকশেলফজুড়ে শুধু বই আর বই, সেটাও দেখতে ভালো লাগে। স্ক্রু-ট্রু দিয়ে চেয়ারের হাতল খুলে ফেলেছি, চেয়ারে পা তুলে আরাম করে বসা যায়। আর আমার পড়ার টেবিলটা জানালার সাথে লাগানো, জানালার ওপাশে মোটামুটি বড় একটা ফাঁকা রাস্তা। তারও পরে একটা বিল্ডিং। আমার জানালা দিয়ে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। বৃষ্টি পড়লে বেশ ঠাণ্ডা বাতাসও আসে। আর দূরের বাসাটার কবুতরের মত খুপড়িগুলো দিয়ে দেখা যায়, ঢাকাশহরের দিবারাত্রির কাব্য। ও বাড়ির হাসিকান্না এ বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায়। রাতে যখন সবকিছু চুপ হয়ে যায়, মেয়েটা মৃদু হাসলেও আমি শুনি, বুড়ো লোকটা হালকা কাশলেও আমি শুনি। আমার মাঝেমধ্যে বড় ভালো লাগে।

এমন সময়, ওয়ারফেজের একটা পুরনো গান শুনতে শুনতে আমার মধ্যে নস্টালজিয়া ভর করল।

কিংবা হিমশীতল বাতাসটাকেও এর দায় দেয়া যায়।

আমার দাদু এখন ফরেস্ট গাম্পের মত চুপ করে বসে থাকে।

ফুপী মারা গেছে অনেকদিন হল। মাসতিনেকেরও বেশি। ফুপী যেদিন অসুস্থ হয়, সেদিন আমরা সেন্ট যোসেফে একটা প্রোগ্রাম করছিলাম। প্রোগ্রাম শেষ করে, একজনকে ভার্সিটি পৌঁছে দিয়ে, বৃষ্টি মেখে আমি বেশ খুশিমনে বাসায় ফিরেছিলাম। ফিরে এসে শুনি, ফুপী খুব অসুস্থ। এরপর....খুব দ্রুতই ফুপী অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার বন্ধুরা অনেকেই জানতো ফুপীর অসুখের কথা। কিন্তু যেটা জানতো না— ফুপী জন্ম থেকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। এবং বাকপ্রতিবন্ধী। ফুপীর অসুখের সাথে এজন্য বারবার দাদুর কথা আসে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে দাদু ফুপীকে বড় করেছে। খাওয়ানো, গোসল করানো— সব কাজ দাদু নিজ হাতে করিয়ে দিতো, দাদুর বয়স পঁচাত্তর, তারপরেও দাদু করত।

অনেক কষ্ট হত অবশ্য। পঁচাত্তর বছর বয়সে নিজেকে টানাই বড় কঠিন। সেই সাথে আরেকজন মানুষকে টানা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি একটা ব্যাপার।

কী জানি কী হল।

ফুপী মারা যাওয়ার পর দাদু আরো দ্রুত বুড়িয়ে গেল....

এখন বুঝি, ফুপীকে নিয়ে অনেক খাটাখাটনি গেলেও, তখন দাদুর একটা স্বপ্ন ছিল, একটা কাজ ছিল অন্তত। এখন ফুপী নেই, তার কিছু করার নেই।

দাদু দিনরাত বসে থাকে।

আমি একশোভাগ নিশ্চিত, দাদু যদি রাত তিনটা পর্যন্ত ল্যাব রিপোর্ট লিখে সকালে ক্লাসে গিয়ে আবার পেইন খাওয়ার সুযোগ পায়, সে সেই সুযোগটা নিবে। ওটায় অনেক কম কষ্ট।

আর শাওন মামা? নাইস খালামণি?? আমি আর আপু যখন অনেক ছোট, আমাদেরকে ওরা পড়াত। শাওন মামা আমাকে পড়াতে আসতো, আর খালামণি পড়াত আপুকে। ওরা দুজন আপন ভাইবোন না, কাজিন। একদিন দুম করে শুনি....ওদের বিয়ে। দুজনেই বিয়ের পর লন্ডনে চলে গেল। এখনো দেশে ফিরতে পারলো না। মামার সাথে ফোনে কথা বলছিলাম একটু আগে। বললাম, আমি বুড়ো হয়ে গেছি। তোমাদের কল্পনার ঐ পিচ্চিটা আর নাই।

রূপ মেয়েটাও তো বুড়ো হয়ে গেছে। আমার কল্পনায় ছিলো ক্লাস সেভেনের একটা পিচ্চি। অসম্ভব তীব্র আবেগ নিয়ে লিখতো। ভেউ ভেউ করে কাঁদতো, হি হি করে হাসতো। বহুদিন পর যখন খুঁজে পেলাম, সেই পিচ্চিও নেই, আমিও নেই। দুটো পিচ্চিই মারা গেছে।

মানুষ বেঁচে থেকেও কীভাবে মরে যায়— এটা যথেষ্ট আশ্চর্যের একটা ব্যাপার।

অনেকে অবিশ্বাস্যভাবে জন্ম নিয়েছে। সুক্রন্দসী।

যাকে পাঁচ মাস আগেও কেউ চিনতো না, সে কীভাবে জন্ম নিয়ে এত দ্রুত বুড়ো হয়ে গেল, কে জানে!

ভাইয়া আর অলিন্দ আগের মতই আছে বোধহয়। আমরা তিনজন আগের মতই ঝগড়া করি, আগের মতই হাসি। প্রাণখুলে হাসি। আগের সাথে পার্থক্য হল, তিনজনের চিন্তাভাবনা আগের চেয়ে পরিণত, কথাবার্তায় সেটা বেশ বোঝা যায়।

কখনো এরকম হয়, আমরা আড্ডা দিতে দিতে সব ভুলে যাই। টানা বকবক করতেই থাকি।

আবার কখনো জুম্মার নামাজের পর তিনজন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। কোনো কথা মনে আসে না। একসময় কেউ একজন বলে, আচ্ছা যাই। বাকি দুজনও বলে, হুম যাই। নির্বিকার মুখে তিনজন বাসায় ফিরে আসি।

বাঘা ছেলেটার কী থেকে কী হয়ে গেল। আমি ওকে কথা বলতে মানা করলাম। সে নাকেমুখে রক্ত নিয়েই আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল, মানা করার পরেও। ইনফেকশনের ভয়ে আন্টি ওর কাছে যেতে মানা করল, আমি ছেলেটার মাথায় একবার হাত পর্যন্ত বুলিয়ে দিয়ে আসতে পারলাম না।

আর এদিকে, অনেকগুলো পিচ্চি জন্ম নিয়েছে। পিচ্চিগুলো এক দিক দিয়ে চমৎকার, ওদের জটিলতা কম। ওরাও সমস্যায় পড়ে, ওরাও কাঁদে, কিন্তু ওদের সমস্যাগুলো শুনতেও বড় ভালো লাগে।

ভাইয়া ভাইয়া আমার স্কেচ মিলতেসে না! খুব মন খারাপ। :’(

ভাইয়াআআআ জানো কী হইসে?? দুষ্টু ছেলেটা কোরিয়া গিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেসিল! :|

উই ভাইয়া বলো দেখি বব ডিলান বেশি জোস নাকি ফ্রেডি মার্কারি?? :3

ভাইয়া আমার না, কোডব্লক্স চলতেসে না! :’(

ভাইয়া আমি কলাগাছে ঝুলে মারা যাবো। :’(

এই সমস্যাগুলো শুনতেও ভালো লাগে। হয়তো বড়দের মত অত প্যাঁচ নেই দেখে।

বেঁচে থাকা মানুষ, মরে যাওয়া মানুষ, বেঁচে থেকেও মরে যাওয়া মানুষ এবং মরে গিয়েও বেঁচে থাকা মানুষ— ওদের সবাইকে নিয়ে আমি প্রতিদিন দৌঁড়াই। বাসা থেকে ভার্সিটি, সেখান থেকে অন্য কোথাও, এরপর আবার বাসা। জাদুর শহরের অদ্ভুত বাতাসে ভেসে আমি বেঁচে থাকি।

আর আমি কল্পনা করি, লাগামছাড়া কল্পনা করি।

এইসব দিনরাত্রি, এই মেঘ, রৌদ্রছায়া— এইসব আমার ভালো লাগে।


“এইখানে
পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।”