এক-চতুর্থাংশ (রিয়া পাগলিনী এবং অন্যান্যরা)
পড়ছিলাম। হঠাৎ একটা ফোন এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিলো।
আমি ঝড় আঁকতে পারি না, তবু ঝড় বয়ে যায়—অমন ঝড়ের মত সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল।
কী আর করা। হিসেব করতে বসি! দুই হাজার ষোলো সালের হিসেব।
এক.
রিয়া গত জন্মে আমার মেয়ে ছিল।
কথাটা মনে আসার সাথে সাথেই আমি ফিক করে হেসে ফেলেছিলাম। আর রিয়া রীতিমত হেসে কুটিকুটি হল। হাসতে হাসতেই কোনোমতে জিজ্ঞেস করলো, ক্যান ভাইয়া?
স্বীকার করছি, বেশ লাগছে। রিয়ার লেখাগুলো, আঁকাগুলো দেখলে ভ্রম হয়, আগের জন্মে নির্ঘাত বাবার কাছ থেকে শিখে এসেছে। একইরকম ভুল আঁকে, আমার মত! আর একইভাবে লেখে, সেই ভুলে ভরা গল্প।
কথায় বলে, ষোড়শ বর্ষে পুত্র মিত্র বদাচরেৎ। কন্যার ক্ষেত্রেও এটা সত্যি হওয়ার কথা। আমি এই মিত্র কন্যাটির কাছ থেকে যেই চমৎকার স্বভাবটুকু শিখেছি, সেটা সে নিজেও জানে না। সবকিছু জেনে তো কাজ নেই।
কিন্তু ভালো লাগে, চারপাশের এই পবিত্র মানুষগুলোর আলো যখন আমাকে স্পর্শ করে।
সত্যজিৎ রায়ের লেখা গুপী বাঘা সিনেমাটার একটা দৃশ্য ছিল। ভোর হচ্ছে কেবল। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে গুপী গান গাইছে। গান শেষ করার আগমুহূর্তে দুদিকে দুহাত ছড়িয়ে গুপী বলে, এত আলো!
আমারও গুপীর মত একই কাজ করতে ইচ্ছে করে। এত আলো!
বছরের সবচেয়ে চমৎকার অংশটা সম্ভবত আবির ভাইয়ের সাথে একটা ট্যুর দেয়া। রাতেরবেলা, বাসটা অন্ধকার একটা নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছে, আর ছেলেটা একটু একটু করে অসংখ্য কথা বলছে।
আমিও একটু করে কথা বলা শুরু করলাম। এবং আবিষ্কার করলাম, অনেক কিছুই মিলে যাচ্ছে।
শেষে সেপ্টেম্বরে যখন ধাক্কাটা খেলাম, তখন বাকিটুকুও মিলে গেল। আবির ভাই হাসতে হাসতে বললো, আমার খুব মজা লাগতেসে, শেষ পর্যন্ত তুইও!
আমিও হেসে ফেললাম। হুম, আমিও।
আমার মনে আছে, সেদিন বিকেলে ছেলেটা অসংখ্য কথা বলেছিল। আমি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছি, একটা স্কেচ নিয়ে এলোমেলো পেনসিল চালাচ্ছি, আর আমার সামনে বসে ছেলেটা একের পর এক ঘটনা বলে যাচ্ছে।
আমি শুনলাম, এবং আমার ধারণা, আমি বেঁচে গেলাম।
কিংবা আমার আরেকবার জন্ম হল—এটা সম্ভবত আরও বড় একটা সত্যি কথা। সেই জন্মের সাথে আমি তিনজন মানুষকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম (অবশ্যই একেকটা ধাক্কা খেয়ে)।
অথৈ, আরিফ, এবং সবশেষে তটিনী। কী আশ্চর্য, গত ক্যাম্পের সময় যাদের সাথে পরিচয়, বছরখানেক যাদের সাথে প্রায় কোনো কথাই হয় নি, তারা হঠাৎ করে আমার ইউনিভার্সে ঢুকে পড়লো। সত্যি বলতে কী, প্রবল বেগেই ঢুকে পড়লো, ঝড়ের মত চারপাশ এলোমেলো করে দিয়ে।
ঐ যে, ‘আমি ঝড় আঁকতে পারি না, তবু ঝড় বয়ে যায়’।
এবং তিনজনের ব্যাপারেই আমার বেশ ভয় লাগে। সত্যি বলতে কী, অনেকের ব্যাপারেই লাগে। যতদিন পাই নি, ততদিন হারানোর ভয়টাও ছিল না।
হারাই হারাই সদা ভয় হয়...এবং তারপর...হুম, সবাই জানে, তারপর ‘হারাইয়া ফেলি চকিতে’।
অবশ্য একজনের ব্যাপারে এই ভয়টা একেবারেই হয় না।
তামান্না।
মেয়েটা একটা গাছ হয়ে গেছে। অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে শিকড়-ডালপালা গজিয়ে গাছ হয়ে যায় নি, সেটা ভয়াবহ একটা ঘটনা হত। গাছ হয়ে গেছে বলতে, মেয়েটা একটা গাছের মত এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। উপরে, অনেক উপরে ডালপালা ছড়িয়ে দেখছে, পাগল ছেলেটা কী করে।
গাছটা যখন ছোট ছিল, তখন ভয় ছিল। এখন এত বড় হয়ে গেছে, সেটা রীতিমত ছায়াও দেয়। আমি ছায়ায় বসে থাকি, আর হা হা করে হাসি। এত আলো!
ইশিজুর কথা কী বলবো জানি না। ইবরাহিম, শিবলী, জুনায়েদ—আমাদের ইশিজু—যারা তিনজনই এই বছর আধ্যাত্মিক পর্যায়ে চলে গেছে, তাদেরকে নিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই। দেবতাদের পুণ্য কিংবা পাপ—দুটোরই ফলাফল যথেষ্ট ভয়াবহ হয়।
আমরা সাধারণ মানুষ। বসে বসে দেবতাদের কাজ দেখি। কখনো তানভীর ভাইয়ের মত ‘একটু মন খারাপ’ করে বসে থাকি।
দুই.
হঠাৎ করেই মুড চলে গেল, আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না! ঘুম পাচ্ছে, পড়াও পাচ্ছে বটে।
যাকগে, জোর করে তো আর সারা বছরের হিসেব মেলানো যাবে না। বাকি তিন-চতুর্থাংশ বাকিই থাক।
বাকি মানুষগুলোর গল্প অবশ্য দুই শব্দেই বলে ফেলা যায়। এবং এই দুটো শব্দই আমার বছরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
এত আলো!