তোমরা

জানালা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা আসছে। শুধু ঝাপটা আসছে বললে ভুল বলা হবে, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা জানালা দিয়ে ঢুকছে। ইচ্ছে করেই জানালাটা খুলে রেখেছি, কারণ খানিক্ষণ আগে আমার মাথায় দেবব্রত বিশ্বাস ঢুকে গেছে। ভাঙা রেকর্ডের মত একটা কথা মাথায় বাজছে।

সকাল থেকে টানা জাভা দিয়ে একটা ফাইল এক্সপ্লোরার বানানোর চেষ্টা করছিলাম। দীর্ঘক্ষণ কোডের দিকে তাকিয়ে মাথাটা এখন আর কাজ করছে না। অথবা, মাথাটা আর চাপ নিতে চাচ্ছে না—সেই বেচারারও তো একটা সহ্যসীমা আছে।

আমার পুরো চিন্তাভাবনায় এখন অন্যকিছু নেচে বেড়াচ্ছে। জানি না কেন, প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে বারবার চোখে পানি আসছে। এই কিছুদিন আগেও নওশীনকে বলছিলাম, একুশ বছরের একটা মানুষ কথায় কথায় ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতে পারে না। কাজেই কত এক ঘন্টা ধরে যা ঘটছে, তাতে আমার বিব্রত হওয়া উচিত ছিল।

আমার বিব্রত লাগছে না। ভালো লাগছে কেন যেন। সপ্তাহখানেক আগে একজন বলছিল, সে প্রবল বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদবে। আমাকেও তার পাশে দাঁড়িয়ে ভেউ ভেউ করতে হবে। সেই মুহূর্তে ব্যাপারটা অনেক হাস্যকর মনে হয়েছিল, ঝাড়ি দিয়েছিলাম মেয়েটাকে। আজ রাত নয়টা সাতান্ন মিনিটে প্রস্তাবটা আর হাস্যকর লাগছে না। ছেলেমানুষী একটা ইচ্ছে হচ্ছে কাজটা করে ফেলতে।

ভালো লাগছে, আবারও যখন বদ্যি বুড়ো অবস্থায় ফিরে এলাম, আমার চিন্তায় আবারও অনেক কিছু ফিরে আসতে শুরু করল।

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো।

এবং গতকাল মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, এরপরেও আমি বেঁচে থাকবো।

আমি বেঁচে থাকবো, যতদিন ছাদে পা ঝুলিয়ে রিয়া বসে থাকবে। হাতে ফোনটা থাকবে, আমাকে কোনভাবেই ফোন দিতে পারবে না, কিন্তু যতদিন মেয়েটা পৃথিবীতে থাকবে, আমি থাকবো। রিয়া চমকে ডানদিকে তাকাবে, ঠিক যেখানে আমি বসে ছিলাম। এবং আমি বসে থাকবো, ঠিক বসে থাকবো।

আমি বেঁচে থাকবো, যখন আরিফ একটা মাঠের কোণে চুপচাপ বসে থাকবে। ধরো, আমি কেমিস্ট্রির যেই গাছটার নিচে শুয়ে থাকি, তার পাশে বসে আরিফ যখন ঘাস চিবোবে, আমি সেখানে থাকবো।

বেঁচে না থাকার তেমন কোন কারণ দেখছি না। আমি যখন থাকবো না, এ্যানি কি লাইব্রেরির সামনের সেই ফুটপাথে বসবে না? নিশ্চয়ই বসবে। এবং আমি সেখানে থাকবো।

নভেম্বরের বৃষ্টিতে আমি থাকবো, নভেম্বর রেইনে আমি থাকবো।

যতদিন মুদ্দাসসের থাকবে, জগদীশ বসু ক্যাম্পের প্রতিটা মুহূর্তে আমি থাকবো।

এবং বুধবারের সন্ধ্যাগুলোতে যখন পদ্ম মন খারাপ করে বসে থাকবে, সেই অপেক্ষায় আমি থাকবো।

মানে, আমি সম্ভবত প্রতিটা জায়গাতেই আলাদা আলাদাভাবে থাকবো।

এবং আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো।

বৃষ্টিটা বাড়ছে, প্রচণ্ড শব্দে পড়ছে বৃষ্টিটা। হ্যারিসন শুনতে শুনতে লিখছি, বৃষ্টির শব্দে ছেলেটার গলা মৃদু হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে। আর আমার চিন্তাভাবনা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাচ্ছে, আমি নিজেও যেন ভাসছি, ল্যাপটপের উপর আমার আঙুলগুলো হালকা হয়ে ভাসছে....

আমি সম্ভবত....