আবু তালেবের উপাখ্যান

আমরা পেছন ফিরে তাকাবো, এবং কে জানে, হয়তো ২৩ এপ্রিল, ১৬৮২-তেই আমাদের দৃষ্টি পড়বে। 

আমরা দেখবো, বুড়িগঙ্গার পাড়ে বড়সড় কোনো অশ্বত্থ গাছের নিচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ধরে নিবো, তার নাম লাল মিয়া। 

এপ্রিলের ঐ দিনটাতে হয়তো খুব একটা গরম থাকবে না। কারণ বিক্রমপুরের উপকণ্ঠে ঢাকা নামের এলাকাটাকে হয়তো আমরা জঙ্গলাকীর্ণই দেখবো, সে হয়তো অজস্র আমের মুকুলের ঘ্রাণে আর বুড়িগঙ্গার বয়ে আনা শীতল বাতাসে লাল মিয়ার পরানডা জুড়ায়ে দিবে। 

তবু আমরা লাল মিয়াকে ঘামতে দেখবো। অকারণেই বারবার ধুতির খুঁট তুলে মুখ মুছতে দেখবো। 

কাজেই আমরা অনুমান করবো, লাল মিয়া বড্ড চিন্তা করে। হ্যায় কী জানি ভাইবা ভাইবা চোখমুখ ঘামায়া ফালায়। 

এবং আমরা ১৬৮২ সালের কোনো এক দিনে, হয়তো ১৫ মেই হবে সেটা, সেই দিনটার দিকে যখন দৃষ্টিপাত করবো, তখন বুড়িগঙ্গার তীরের অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লাল মিয়ার দিকে আমাদের দৃষ্টি পড়বে, এবং আমরা অকারণেই তাকে ঘামতে দেখবো। আমরা কৌতূহলী হয়ে তার দিকে একটু এগিয়ে যাবো। আমরা বিড়বিড় করে তাকে বলতে শুনবো, 

আবু তালেবের বাড়িত যামু 
শাগ-ডাইল আর বিনুন খামু। 

সুতরাং আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়বো, ব্যাঞ্জন এবং শাক-ডাল খাওয়ার চিন্তায় লাল মিয়া ঘামছে কিনা—তার সমাধান আমরা করতে পারবো না। তবে আমরা খেয়াল করবো, লাল মিয়ার দৃষ্টি সামনেই কোথাও নিবদ্ধ হয়ে আছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমরা সেদিকে তাকাবো, এবং বুড়িগঙ্গার ধার ঘেঁষে বড়সড় একটা দেয়াল দেখবো। মেটে রঙের সেই দেয়ালের দিকে তাকিয়েই আমরা পেছন থেকে লাল মিয়াকে বলতে শুনবো, 

হালার বাড়ি মস্ত বড় 
ঢুকার দরজা কুথায় পামু? 

তখন আমাদের মনে হবে, এই দেয়ালের ওপাশেই আবু তালেবের বাড়ি, এবং সেখানে যাওয়ার রাস্তা করতে না পেরেই হয়তো লাল মিয়া ঘেমে একাকার হয়। হেলান দিয়া অশুথ গাছে হালায় খালি ঘাইমতে থাকে, মুখডা মুছে ধুতির খুঁটডা তুইলা। 

সুতরাং লাল মিয়ার দুঃখে আমাদের হৃদয় দ্রবীভূত হবে, আমরা আবু তালেবের বাড়িতে ঢোকার রাস্তার খোঁজ করবো। এবং আমরা আবিষ্কার করবো, ১৬৮২ সালের এপ্রিল, বা মে মাসে আমরা যখন বুড়িগঙ্গার পাড়ে তাকাবো, তখন আমাদের চোখে পথঘাটের বদলে কেবল জঙ্গলই পড়বে। ফলে আমরা ক্লান্ত হয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়বো। 

এবং কিছুক্ষণ, কিংবা কে জানে, হয়তো অনেকক্ষণ পরেই আমরা জঙ্গলের ভেতর একটা সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে বর্শা হাতে দুজন লোককে আসতে দেখবো। তাদের ধুতির ওপরের পোশাকটা হয়তো রাজকীয়ই হবে। দৃপ্তপদে তাদের আসার ভঙ্গি দেখে আমরা প্রার্থনা করে উঠবো, 

ধোরো নাকো ধোরো নাকো 
ধোরো নাকো ধোরো নাকো 
ধোরো নাকো সান্ত্রীমশাই— 

এবং ১৬৮২ সালের গ্রীষ্মের এক দুপুরে বর্শা হাতের দুজন সান্ত্রী আমাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লাল মিয়ার সামনে এসে দাঁড়াবে। 

- আপনে লাল মিয়া? 

- জ্বে, আমি— 

- হুজুর আপনেরে সেলাম জানাইসে। আহেন আমাগো লগে— 

সুতরাং আমরা জঙ্গলের ভেতরে আবু তালেবের বাড়ির মেটে দেয়াল ঘেঁষে লাল মিয়াকে দুজন সান্ত্রীর সাথে হাঁটতে দেখবো। লাল মিয়ায় হাইট্টা যায় সান্ত্রী হালার লগে। 

যেহেতু তাদের গন্তব্য সম্পর্কে আমাদের বিশদ জানতে ইচ্ছে করবে, সেহেতু তাদের পিছু পিছু আমরাও এগোবো, এবং খানিক পর মেটে রঙের সেই বিশাল দেয়ালের কোথাও বিশালতর একটা দরজা আমাদের সামনে আবিষ্কৃত হবে। হয়তো আমরা সেই দরজার বিশালত্বের সামনে দাঁড়িয়ে লাল মিয়াকে তার ক্ষুদ্রত্ব অনুভব করতে দেখবো। 

তখন হয়তো সান্ত্রীরা এক হাতে বর্শা নিয়ে অন্য হাতে কড়া নাড়বে, 

টক টক টক 
সান্ত্রী এলো ঠক— 

এবং ১৬৮২ সালের ১৫ মে কিংবা ২৩ এপ্রিলের তীব্র দুপুরে আমরা আবু তালেবের বাড়ির দরজাটাকে খুলে যেতে দেখবো। প্রায় একইসাথে আমরা লাল মিয়াকে অস্ফুট একটা শব্দ করতে শুনবো, এবং তার দৃষ্টি অনুসরণ করে শব্দ করে উঠবো আমরাও, কারণ দরজার ওপাশেও আমরা কেবল ঝোপঝাড় আর জঙ্গলই দেখতে পাবো, সেখানে কোনো মানুষ থাকে বলে আমাদের ঠিক বিশ্বাস হবে না। 

আমরা দেখবো লাল মিয়াকে ধুতির খুঁটটা সামান্য একটু তুলে ধরে সন্ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকতে, এবং সেই সাথে আরেকজন সান্ত্রীকে সসম্ভ্রমে তার দিকে এগিয়ে আসতে। আমরা লাল মিয়াকে সাদরে সম্ভাষিত হতে শুনবো, এবং সান্ত্রীদের হুজুর যে পুকুরপাড়ে বিশ্রামগ্রহণ করছেন—এ তথ্যটি জানতে পারবো। 

পুকুরপাড়ে বইসা হুজুর 
সুখে নিদ্রা যায়— 

সুতরাং সেই সান্ত্রীর পথ ধরে লাল মিয়া, এবং লাল মিয়ার পথ ধরে আমরা পুকুরের দিকে এগোবো। ফলে ১৬৮২ সালের অনির্দিষ্ট কোনো দুপুরে আমাদের সাথে আবু তালেবের সাক্ষাৎ ঘটবে, এবং শুভ্র দাড়িগোঁফ দেখে আমরা তার বয়স সম্পর্কে অবগত হব। কিন্তু আমরা বিভ্রান্তিতে পড়বো, যখন লাল মিয়া তাকে হালা বলে সম্বোধন করবে, এবং আমাদের রীতিমত বিভ্রমের সৃষ্টি হবে, যখন বিপরীতক্রমে আবু তালেবও তাকে হালা বলেই সম্বোধন করবে। বহুদিন পর ফিরে পাওয়া অন্তরঙ্গ দুই বন্ধুর মত আমরা তাদের একে অপরকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ ও মুক্ত হতে দেখবো। 

ইতোমধ্যে আবু তালেবের কর্মচারীরা লাল মিয়ার বসবার জন্য আসন নিয়ে আসবে, এবং আমরা শুভ্র দাড়িগোঁফের আবু তালেব এবং অননুমেয় বয়সের প্রৌঢ় লাল মিয়াকে পুকুরপাড়ে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখবো। অনতিদূর থেকে বুড়িগঙ্গার স্রোতের মৃদু শব্দ আমাদের কানে আসতে থাকবে, এবং অনতিকাল পরপর সেই স্রোতের বয়ে আনা মৃদু বাতাসে আবু তালেবের প্রাণ জুড়িয়ে এবং লাল মিয়ার পরানডা জুড়ায়ে যাবে, ফলে এই দুই প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধের কথোপকথন থেকে আমরা তাদের পরস্পরকে হালা ডাকার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করবো। আমরা জানতে পারবো যে ছুটুবেলায় হ্যারা এক লগে খেইলা বেড়াইতো, হুম খেলে বেড়াতো তো বটেই, বড় সুন্দর ছিল দিনগুলো, পরে হালার আবু তালেবের বাপ তো চইলা গেল শা-জাহানের উজির হয়া, তার পিছ পিছ গেল আবু তালেব, আর ওদিকে লাল মিয়ার দাদা সম্রাটের রোষের পাত্র হয়ে পরিবারসুদ্ধ পালিয়ে কোথায় গেল কে জানে, ফলে আবু তালেবরে বহু দিন ধইরা লাল মিয়া দ্যাখে নাই, হ্যার জন্য লাল মিয়ার পরানডা যে ক্যামন কইরা কানতো হেইডা কেবল লাল মিয়াই জানে, আর হুম, লাল মিয়ার কথাও আবু তালেবের খুব মনে পড়তো বটে, কিন্তু সে তো জানতো না লাল মিয়ারা শাঁখারিবাজারে লাখেরাজ জমি নিয়ে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, কাজেই কুড়ি বছর ঢাকায় থেকেও সে লাল মিয়ার খোঁজ পায়নি, আবে লাল মিয়াই বা ক্যামনে জানবো আবু তালেব ঢাকায় আইসে শায়েস্তা নাম নিয়া, ল্যাজের মইধ্যে আবার খান বাহাদুরও লাগাইসে হালায়, অবশ্য, আবু তালেব তো আর ইচ্ছে করে নাম লাগায়নি, জগদ্‌সম্রাট মহিউদ্দিন মোহাম্মদ হুজুরে আওরঙ্গজেব তাকে এই পদবি করে ধন্য করেছেন দেখেই তো সে— 

অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল ১৬৮২, (কিংবা, যেহেতু আমাদের সংশয় দূর করা প্রয়োজন), হয়তোবা ১৫ মে ১৬৮২-র কোনো এক দুপুরে আমরা তালেব আবু এবং মিয়া লালকে বিগত পৌনে এক শতাব্দীর স্মৃতি হাতড়ে একের পর এক গল্প উদ্ধার করে যেতে দেখবো, এবং আমরা এই আশায় সেখানে বসে থাকবো যে, এইসব গল্পের সূত্র ধরে আমরা তাদের সম্পর্কে বিশদ/বিস্তারিত জানতে পারবো।