ভাষা এবং বোধ

বোধ শব্দটা ব্যাখ্যা করিতে গিয়া আমরা সচরাচর জীবনবাবুকেই স্মরণ করিয়া থাকি। তিনি প্রসঙ্গটা তুলিয়াছিলেন এইভাবে— 

আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে 
স্বপ্ন নয়,—কোন্‌ এক বোধ কাজ করে! 
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়, 
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়! 

অর্থাৎ প্রায়শই আমরা কিছু অনুভূতির দ্বারা তাড়িত হই—যাহাদিগকে আমরা আমাদের প্রচলিত ধারণা (স্বপ্ন, শান্তি, হয়তো ভালোবাসা) দিয়া সংজ্ঞায়িত করিতে পারি না। সেক্ষেত্রে আমরা বোধ শব্দটার আশ্রয় লই। অদ্য সন্ধ্যায় আমার অভ্যন্তরে এক ধরনের বোধ জন্ম নিয়াছে—এই কথাটার অর্থ হইল, অদ্য সন্ধ্যায় এমন কোনো অনুভূতি আমাকে তাড়িত করিয়াছে—যাহার সহিত আমার পূর্বপরিচয় ছিল না, কিংবা থাকিলেও উহাকে আমি ভাষার দ্বারা ব্যাখ্যা করিতে পারিতেছি না। 

ইহা বোধের খুব গুরুত্বপূর্ণ একখানা বৈশিষ্ট্য—সচরাচর বোধের এই অনুভূতিগুলো অপার্থিব হইয়া থাকে, এবং আমরা ইহাকে সরাসরি ভাষার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করিতে পারি না। 

উল্লেখ্য, অকারণ-দুঃখ, যাহাকে ইংরেজিতে ডাকা হয় melancholia—তাহার সহিত ইহার স্পষ্ট পার্থক্য রইয়াছে। সব মেলানকোলিয়াই বোধের জন্ম দেয় না, এবং প্রায়শই বোধের পেছনে যেই কারণ কার্যকর থাকে উহা মেলানকোলিয়া নয়। 

বোধের আরেকখানা বৈশিষ্ট্য হইল, ইহা ‘জন্ম লয়’। কোথা হইতে এবং কীভাবে ইহার জন্ম হয় তাহা কেউই নিশ্চিতভাবে বলিতে পারে না। খুব সাধারণ একখানা ঘটনা হইতেও মানবের ভেতরে অপূর্ব বোধ জন্ম লইতে পারে। হয়তো একদিন ক্লাসশেষে বাহির হইয়া কেউ দেখিল, শহরে তুমুল বৃষ্টি হইতেছে, এবং ব্যাগে ছত্র থাকা সত্ত্বেও সে তাহা না খুলিয়া প্রবল বর্ষণে ভিজিতে ভিজিতে অনেকক্ষণ রাস্তায় হাঁটিয়া বেড়াইল। কে জানে, হয়তো সেই বর্ষণ, কিংবা শহরের রাস্তা, কিংবা আকাশজোড়া মেঘের কল্যাণে তাহার মনে বিচিত্র কিছু ভাবের উদয় ঘটিবে, বাড়িতে ফিরিয়া সে সন্ধ্যায় তাহার মনে একখানা হারাই-হারাই ভাব কাজ করিবে, সামনে বইপত্র খুলিয়া গালে হাত দিয়া সে ভাবিতে বসিবে, কই, কোনোদিন তো এমন কিছু অনুভব করি নাই! হয়তো সে সন্ধ্যাতেই সে অসম্ভব সুন্দর একটা উপন্যাস লিখিয়া ফেলিবে, যেমনটা লিখিয়াছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, কিংবা সে রাতে ঘুম থেকে উঠিয়া কালজয়ী একখানা গান রচনা করিয়া ফেলিবে, যেমনটা করিয়াছিলেন জন লেনন। 

অবশ্য, সর্বত্রই যে বোধের প্রভাবে মানুষ সৃষ্টিশীল কাজ করিয়া থাকে—ব্যাপারটা কিন্তু তাহাও নয়। এমনও হইতে পারে, সে সন্ধ্যায় তাহার মনে হয়তো প্রশ্ন আসিবে, এই জগতের প্রকৃত অর্থ কী? আমরা প্রতিনিয়ত কেন ক্লাসে-অফিসে-কারখানায় দৌঁড়াইয়া মরিতেছি? এবং এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না পাইবার যন্ত্রণায় সে উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া যাইবে, উন্মাদের মত বইপত্র পড়িবে, গান শুনিবে, আর্ট দেখিবে, রাস্তায় লোকজন পাইলে তাহাদিগকে ধরিয়া জিজ্ঞেস করিবে, জীবনের অর্থ তো পাইতেছি না, তুমি কি জানো জীবনের অর্থ কী? 

কেহ যদি এমতাবস্থায় তাহাকে ধরিয়া বলে, হে মানব, তোমার কী হইয়াছে ব্যক্ত কর—তখন সে কোনোক্রমেই বলিতে পারিবে না কোন অনুভূতিখানি তাহাকে এইভাবে পাগল করিয়া দিতেছে। 

আমরা এতদিন ভাবিতাম, বোধের স্বরূপ বোধহয় এমনই। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে সেই ধারণায় অনেকখানি নতুন মাত্রা যোগ হইয়াছে। 

উক্ত দিনে আমরা একত্রে খাদ্যগ্রহণ করিতেছিলাম। তৎক্ষণে পেটুক এবং ভোজনরসিক—এই দুখানি শব্দ আমাদের টেবিলে আসিয়া পড়িল। কোনো এক বালক বলিয়া উঠিল, সকল ভোজনরসিক পেটুক না হইলেও, সকল পেটুকই ভোজনরসিক। তখন আমরা ভাবিয়া দেখিলাম—কথাখানি মোটেও সত্য নয়, কারণ সকল পেটুক খাদ্যের মর্ম বোঝে—ব্যাপার অমন নয়। প্রকৃতপক্ষে তাহাদের মধ্যে এক ধরনের বোধ সৃষ্ট হয় যে, আহারের যোগ্য-অযোগ্য সকল বস্তুই খাইতে হইবে। 

অর্থাৎ পেটুকদের চিন্তাভাবনার সীমা ভোজনরসিকদিগের অপেক্ষা নিচে সীমাবদ্ধ, কাজেই তাহারা কেবল বোঝে যে ‘খাইতে হইবে’, কিন্তু কেন খাইতে হইবে উহা তাহারা বলিতে পারে না। এই কারণে খাওয়ার এই ইচ্ছা তাহাদের নিকট এক ধরনের বোধ। 

কিন্তু ঠিক একই ইচ্ছা কিন্তু ভোজনরসিকদিগের নিকট বোধ নয়। তাহারা স্পষ্ট, এবং খুব স্বচ্ছভাবেই বলিতে পারে—কী খাইতে চায় এবং কেন খাইতে চায়। সুতরাং ভোজনরসিকদিগকে আমরা পেটুক অপেক্ষা উর্ধ্বস্তরের বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি। 

অর্থাৎ বোধের স্বরূপখানি এমন যে, নিম্নস্তরের প্রাণীরা উহা সহজে ভাষা দিয়া প্রকাশ করিতে পারে না। তাহারা কেবল তাড়িত হয়, এবং কিছু একটা করিবার (খাওয়া, মারামারি করা, উপন্যাস লেখা ইত্যাদি) চেষ্টা করে। আরেকটু উর্ধ্বস্তরে উঠিলে মানুষ সেই বোধখানি ভাষায় প্রকাশ করিতে পারে, এবং তাহার নিকট জীবনের অনেক অর্থই স্পষ্টতর হইতে শুরু করে। 

এবং অবধারিতভাবেই, সেই উর্ধ্বস্তরের মানুষের নিকটও কিছু কিছু অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য হইয়া পড়ে—যা তাহারা প্রকাশ না করিতে পারিয়া তাহাকে বোধ নামে অভিহিত করে।