আমি

বিশ বছর বয়সের একটা ছেলেকে কী বলা যায়? অবশ্যই পিচ্চি না। এবং কোনোভাবেই বৃদ্ধ না। আমি মাঝামাঝি কিছু একটা। একটা সময় মোটামুটি স্বাভাবিক ছেলে ছিলাম। প্রায় বছরখানেক হল, আমার মাথায় অদ্ভুত কিছু সমস্যা দেখা দিসে। যেসব সমস্যা থাকলে বিশ বছরের একটা ছেলেকে পাগল বলে ডাকা যায়— সেসব সমস্যা আমার ব্রেনের অলিতেগলিতে, নিউরনের ঘুপচিতে বাস করে।

একসময় অবশ্য স্বাভাবিক ছিলাম।

এখন বুঝতেসি, মানুষ পাল্টায়। আমি নিজেই সারাজীবনে কয়েক দফা পাল্টাইসি। শেষবার পাল্টানো শুরু হইসিল এরকম কোনো একটা সময়। আশ্বিনের প্রথম দিকে। নিতান্তই হঠাৎ করে, একদিন বসে বসে পড়তেসিলাম, হঠাৎ মনে হল—আমার এখন হুমায়ূন আহমেদের একটা ছবি আঁকা লাগবে। সাথে সাথে পেনসিল নিয়ে বসে গেলাম....এবং ছবি আঁকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। কিন্তু নেশাটা ধরে গেল। এরপর একটা বছর গেসে, আর আমি বহুদিন, বহুরাত এ্যামনে পার করসি। সামনে একটা সাদা কাগজ। হাতে কার্বনের টুকরা।

এইসব এখন না বলি। আমি গরু, যথেষ্ট আগ্রহ নিয়েই ঘাস খাই, কিন্তু সেটাই হয়তো আমার একমাত্র পরিচয় না। কিংবা, খ্যাপার স্বভাবই হচ্ছে পরশপাথর খুঁজে ফেরা, কিন্তু তার জীবনেও একটা গল্প আছে, কেউ হয়তো ওটার খোঁজ করে না।

ঐ লোকটারও একটা গল্প আছে, যে ঘোড়ায় চড়ে এলডোরাডো খুঁজতে বের হইসিল....

আমার পরিচয়টা যথেষ্ট সাদাসিধে। এমনিতে নাম নোবেল, ভাইবোনরা আদর করে নোবলু বলে ডাকে। প্রায়ই ডাকে। কিংবা বিলবিলু। মাত্র মাসকয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইসি, এখনো প্রথম বর্ষে পড়তেসি। আমার জন্ম ঢাকায়, জন্ম থেকেই এখানে ঘোরাফেরা করতেসি। হয়তো এইজন্যেই জাদুর শহরটার প্রতি অদ্ভুত এক মায়া কাজ করে আমার মধ্যে।

আমার মোটামুটি সবকিছুই ভালো লাগে। ঝালমুড়ি ভালো লাগে। মুখোমুখি এক কাপ চা খেতে ভালো লাগে। রিকশায় বসে হাসতে ভালো লাগে। ঝোড়ো বাতাসে চুলের উড়াউড়ি ভালো লাগে। বৃষ্টিভেজা মাটির ঘ্রাণ ভালো লাগে। জলের গান ভালো লাগে। বিটলস ভালো লাগে। গৃহত্যাগী জোছনা ভালো লাগে। আকাশভরা নক্ষত্র ভালো লাগে।

আমি একটা খ্যাত। সারাজীবনে অনেক কিছু করার চেষ্টা করসি...আমার সবই ভালো লাগসে...কিন্তু কোনোটার পিছেই লেগে থাকি নাই। ফুলে ফুলে উড়ে মধু খাইসি শুধু, কোনো ফুলেই বাসা বাঁধতে পারি নাই। ছোটবেলায় গণিত উৎসবে যাইতাম। এরপর একসময় রুবিক্স কিউবের নেশা ধরলো। তারপর ছবি আঁকার নেশা। গিটার। ধ্রুপদী গান। প্রোগ্রামিং। কসমোলজি। আমার সবই ভালো লাগসে। কিংবা...আমার সবকিছু আলেয়ার মত লাগসে। আমি সবকিছুর পিছে হন্যে হয়ে দৌঁড়াইসি...কাছে গিয়ে দেখসি নাই...কিচ্ছু নাই...

অতঃপর, জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝতে পারসি, আমি একটা সাদামাটা খ্যাত....

আমি এক জীবনে অনেক মানুষ দেখসি। অনেক মানুষ। আমার মানুষ ভালো লাগে। আমি আগ্রহ নিয়ে একেকজনকে দেখি। সবাই অদ্ভুত একেকটা উপন্যাস। মোজার্টের একেকটা সিম্ফোনি। যেই মেয়েটা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়তেসে, সে আসলে প্রতি রাতে লুকিয়ে কাঁদে। আমি জানি না কেন। যেই ছেলেটাকে সবচেয়ে সাধারণ মনে হয়, সে আসলে প্রমিথিউস, সুযোগ পেলেই চারদিকে আগুন ছড়ায়ে দিবে। কেউ কেউ আনমনে গাওয়া একটা সুরের মতন, সেই সুর শুনলে হয়তো চোখে পানিই চলে আসবে। আর কেউ কেউ রবিবাবুর কবিতার মত, মায়ায় ভরা ছন্দ দিয়ে তৈরি।

আমার বরাবরই মানুষজনকে ভালো লাগসে।

আমি যখন পিচ্চি ছিলাম, আম্মু আমাকে সামনে বসায়ে কবিতা শোনাতো। সঞ্চয়িতার কবিতা। রবীন্দ্রনাথের মায়া থেকে বের হওয়া যথেষ্ট কঠিন, আমিও বের হতে পারি নাই। রবীন্দ্রনাথ একটা বিশাল আকাশ, আর আমি সেই আকাশে উড়ে বেড়াইতেসি। ভালো লাগতেসে আমার।

আমার মাঝেমধ্যে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, আমি বোধহয় সুরগুলোর রঙ দেখতে পাই। আকাশজুড়ে শিমুল তুলার মত সুর উড়তে থাকে, আর আমি সেগুলোর রঙ দেখি। ডি সেভেন দেখতে অনেকটা গাঢ় লাল, একটু বাদামি ভাব আছে। ই মেজর দেখতে আকাশী নীল।

মাঝেমধ্যেই মনে হয়, কোথায় যেন মিষ্টি একটা সুর ভেসে বেড়াচ্ছে....

আমি জানি না আমি কী করতেসি। আমি জানি না আমি কই যাইতেসি।
I don’t have too much plans, I just do things….