এলোকথন (কিংবা, দিনাজপুরিয়ান নক্ষত্র)

হাজীপাড়া, ঠাকুরগাঁও

২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫, রাত ৯টা ৩০ মিনিট:

কী নিয়ে লিখতে বসলাম নিজেও জানি না। কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে, এই আরকি। আমাদের এদিকে একটা গোরস্থান আছে। গোরস্থানটা শহরের একটু বাইরে। চারপাশে বেশ ফাঁকা, আর আলো কম। আমি সন্ধ্যার পরে সেখানে গিয়েছিলাম, ভিতরে ঢুকতে তো সাহস হয় না, বাইরের অন্ধকার রাস্তাটাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। (কারো মনে এখনও সন্দেহ থাকলে বলে ফেলছি, হু, তারা দেখার জন্যে। এই পাগল রাতেরবেলা অন্ধকার একটা ফাঁকা জায়গা আর কেন খুঁজে বের করবে!) আমি যখন পৌঁছেছি, একপাশ থেকে আমার রিজেল উঁকি দিচ্ছে। মানুষ হয়ে জন্মানোর বেশ কিছু অদ্ভুত দিক আছে। ছাগল হয়ে জন্মালে জীবনের সমীকরণটা অনেক সহজ হয়ে যায়, ঘাস দেখলে খুশি হবে, দড়ি দেখলে মন খারাপ করবে। আর এই যে মানুষ, সে যে কীসে খুশি হয় আর কীসে মন খারাপ করে....আমি নিজেই নিজেকে এদ্দিনে বুঝলাম না। অন্ধকার আকাশ, পুরো আকাশ নক্ষত্রে ছেয়ে গেছে, আমার হয়তো খুশিই হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমার অদ্ভুত এক ধরনের মন খারাপ হল। নিজেও ঠিক জানি না কেন। হয়তো ফুপীর জন্য। ফুপীর আসলে মৃত্যুর বয়স ছিলো না। ও বয়সেও মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখে। সায়েন্স ল্যাবের মোড়ের অন্ধ লোকটার হয়তো জীবনের শেষ আশাটাও বিক্রি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ফুপীর সেই অবস্থা ছিলো না। অথবা, বিজ্ঞান জয়োৎসবে থাকতে পারছি না—মন খারাপটা সেজন্য। আমার মানুষজন তো সব ওখানে। হতাশ হয়ে ইবরাহিম ভাইয়াকে ফোন দিলাম। গুরুত্বহীন কথা, কী করছেন, কেমন হল সারাদিন—এইসব। ইবরাহিম ভাইয়াকে নাকি সব পিচ্চি পছন্দ করে। অন্যেরা কেন করে জানি না, আমি কেন করি সেইটা বলতে পারি। ভাইয়া বুঝতে পারছে এখানে একা বসে আছি দেখে আমার মন খারাপ। সেটা কথা না, সেটা যে কেউই বুঝবে। কিন্তু সে আমাকে যেই কথাটা বলল সেটা সবাই বলবে না। আমি কথাবার্তা বলে ফোন রেখে দিচ্ছি, তখন ভাইয়া তাড়াতাড়ি থামালো, এই দাঁড়া দাঁড়া! ঐখান থেকে অরায়নটা দেখতেসিশ না? ওটা আমরাও এখান থেকে দেখি, তুই আমাদের সাথে কানেকটেড। (বহু, বহু পুরাতন একটা আবেগ। নতুন কিছু না। কিন্তু শুনতে এত চমৎকার লাগে!) আমি হেসে ফেললাম। মনটন ভালো হল একটু।

চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে, আমি ফোনটা রেখে দেয়ার সাথে সাথে আকাশে তাকিয়ে দেখি, একটা তারা ছুটে যাচ্ছে! আগে কখনো উল্কা দেখি নি আমি, কাজেই অসম্ভব এক আনন্দে আমার মনটা পূর্ণ হল। উল্কা দেখলে নাকি প্রার্থনা করতে হয়? আমার এত চমৎকার লাগলো, আমি প্রার্থনা করার মত কিছুই খুঁজে পেলাম না। কিন্তু কেন যেন আমার মাথায় ঐ কথাটা বারবার করে আসলো, ভাঙা রেকর্ডের মত, Dear god, make us a bird, so that we can fly far, far away from here. Dear god, make us....আর এদিকে উল্কাটা হারিয়ে গেল। এবং প্রায় সাথে সাথেই আরেকটা উল্কা দেখলাম! আমি মুগ্ধ হয়ে খালি দেখি, উল্কাটা টরাস পার হয়ে পাশে ওটা কী ছাই একটা কনস্টেলেশন ছিল, সেটাও পার হয়ে আরো দূরে চলে গেল, এবার অবশ্য আমি ভুল করলাম না, স্পষ্ট গলায় বললাম, আরও পিচ্চি, আরও! [পরে জেনেছি, ওগুলো অবশ্য উল্কা না, আর্টিফিশিয়াল স্যাটেলাইট]

বাইরে কনকনে শীত, এতক্ষণ থাকা হয়তো ঠিক হয় নি। এখন জ্বর-জ্বর লাগছে, চাদর কম্বলের নিচে বসে লিখছি। হয়তো বাইরে আরও অনেক্ষণ থাকতাম, আব্বু একরকম বকা দিয়েই বাসায় আনলো। যাকগে, বাসায় ফেরার আগে একটা ভালো কাজ অবশ্য করে ফেলেছি। আরো কয়েকটা কনস্টেলেশন চিনেছি, গুগল স্কাই ম্যাপ দিয়ে। এক পাশে একটা তারা বিশাল হয়ে জ্বলছিল, ম্যাপে খুঁজে দেখি ওটা ক্যাপিলা। (ইউরেনাসকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু চিনতে পারলাম না। ওটা কি ভালোমত দেখা যায়? ওমর? কিংবা অন্য কেউ?) যাকগে, পরে একটু বেশিই ঠাণ্ডা লাগছিল, নতুন যেসব তারার সাথে পরিচিত হয়েছি তাদেরকে হাই-হ্যালো বলে চলে আসলাম। (শাফিন ভাইয়া রাস্তায় নতুন কুকুরের সাথে দেখা হলে হ্যালো বলে, আমি নক্ষত্রকে হ্যালো বললে আশা করি দোষ না!)

ফুপী হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েই মারা গেছে। প্রায় সাড়ে তিন মাস আইসিইউতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা কেমন কষ্টের, আমি জানি না, হয়তো কখনও জানবোও না। সবার একই কথা মনে হচ্ছে, হয়তো আরও কষ্ট পাওয়ার চেয়ে....হয়তো এটাই ভালো হয়েছে, আল্লাহ ভালোর জন্যেই করেন সব। নানু যখন মারা যায়, আমার খুব বেশি অবিশ্বাস্য লেগেছিল। কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু নানুর মৃত্যুর ধাক্কাটা সামলাতে আমার দুই-এক বছর লেগেছিল। ব্যাপারটা এমন না যে, আমি টানা দুই বছর মন খারাপ করে ছিলাম। এই দুই বছরে আমি সবকিছুই করেছি, কিন্তু হঠাৎ-হঠাৎ বুকের ভিতর একটা ধাক্কা লাগতো, মনে হত নানুর মৃত্যুটা আসলে সম্ভব না। ফুপী চলে যাওয়ার পর এমন কিছু হয় নি। আমরা সবাই গত সাড়ে তিন মাস ধরে একটু একটু করে তৈরি হয়েছি, দুঃসংবাদটা শোনার জন্য।

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫, সকাল ৮টা ৩০ মিনিট:

গতকাল সকালের কথা বলি। গতকাল সকালে কিছু করার ছিলো না, তাই ভাবলাম, একটু ভাব নিয়ে হাঁটাহাঁটি না করলে আর চলছে না। কাজেই গায়ে চাদর জড়িয়ে এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভাইবোনদের ওখানে গেলাম। বললাম, আমি প্লেটো, আমার শিষ্য হয়ে কেউ বের হতে চাইলে আয়। অর্থহীন হাঁটাহাঁটি করব। এত বড় পার্টটা নেয়ার পরেও আমার পিছে পিছে একজন বের হল, ভেবেছিলাম একাই হাঁটবো। যাই হোক, অলিন্দকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শহরের একটু বাইরে চলে গিয়েছিলাম। (মানে, গোরস্থানের ওখানেই আরকি। ওদিকে যাওয়ার নতুন রাস্তা বের করতে গিয়ে প্রথমে হারিয়ে গিয়েছিলাম। পরে কীভাবে যেন রাস্তা খুঁজে পেয়েছি। অবশ্য এইসব অবশ্যই ভালো লাগে, হাতে একটা চায়ের কাপ নিয়ে শহরের রাস্তায় হারিয়ে যেতে, আর গল্প করতে করতে আবার চেনা রাস্তায় ফিরে আসতে। এই শহরের রাস্তায় যেহেতু ট্রাম চলে না, অনেকখানি নিশ্চিন্ত মনে হাঁটা যায়।) গোরস্থানের পাশে বিশাল এক খেত, সব ধূ-ধূ করছে। ভাবলাম, রাতে হয়তো এখান থেকে ভালো তারা দেখা যাবে, আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। খেতে নেমে দুই-চারটা ছাগলকে হাই হ্যালো বলার পর দেখি, খেতের ওপাশে মোটামুটি ছোট একটা নদী। শীতে পানি কমে গিয়ে....আচ্ছা তখন আমার এই কথাটা মনে হয় নি কেন? এখন লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, হু, এটাই তো রবিবাবুর নদী, হাঁটুজলও না অবশ্য, পায়ের পাতার একটু ওপরে পানি ওঠে, আর নিচে এত পরিষ্কার বালি, সূর্যের আলোয় সব চিকচিক করছে, কোথা নাই কাদা, উমম....না কাশবন ছিলো না পাশে, কিন্তু চলে বাঁকে বাঁকে—এটা তো আর মিথ্যা না....আচ্ছা যাই হোক, আমি আর অলিন্দ কাছে গিয়ে দেখি রবিবাবুর ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে। অলিন্দ তখন বলল, তোমার চূড়ান্ত পাগলামি হবে এই নদীতে নামা, এই কাজ কইরো না। আমি বললাম, হ্যাঁ এটা পাগলামি, কিন্তু আমি অবশ্যই এটা করতে যাচ্ছি। এত সুন্দর লাগছে দেখতে, নিচের বালি পর্যন্ত চিকচিক করতে দেখা যাচ্ছে। এখানে না নামা রীতিমত পাপ। আয়, নামি। চায়ের কাপটা এই পারে রেখে নেমে যাই, কেউ নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে।

পায়ের পাতা সমান পানি, এত চমৎকার স্রোত, আমাদের দুইজনেরই খুব ভালো লেগেছিল জিনিসটা। আচ্ছা আমার তখন একটা কথা মনে হয়েছিল, এ্যানির একটা কথা। ওর নাকি খুব ইচ্ছে নদীর মাঝখানে বসে জোছনা দেখার, যেই জোছনা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমি ভাবলাম, সবকিছু তো পেয়েই গেছি, চমৎকার একটা নদী পেয়েছি, যদ্দূর জানি এটা পূর্ণিমা না হলেও পূর্ণিমার পরেরদিন, আর ঠাকুরগাঁয়ের আকাশ, আহারে, গোরস্থানের ওখানে আলোর অর্থহীন স্ক্যাটারিং নেই, এত পরিষ্কার সবকিছু, এই জিনিস আমি কীভাবে হারাই— মধ্যনদীতে জোছনা! আজ রাতেই মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে আধিভৌতিক জোছনা দেখে ফেলা যায়, শুধু একটাই সমস্যা। ঠাণ্ডা!

রাতেরবেলা যখন গিয়েছিলাম, চাঁদ ওঠার আগেই গিয়েছিলাম, চাঁদ উঠলেই তো ওপাশের সব নক্ষত্রের মৃত্যু, তাই আমি আগে আগে গিয়ে তারা দেখেছিলাম, সেটা তো বললাম। কিন্তু তারা দেখার পর, বাবা রে, সে কী ঠাণ্ডা, চাঁদ ওঠা পর্যন্ত সেখানে থাকার আর সাহস পেলাম না। চাদরটা মাথায় পেঁচিয়ে কোনোমতে দাদুবাড়ি ফিরলাম, ফিরে দেখি আব্বুরা চার ভাই ঘরের মধ্যে হিটার চালিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, সোজা হিটারের মধ্যে ঢুকে গেলাম। (এটা হচ্ছে just gotta get right outta here-এর উল্টোটা।) এ্যানীয় জোছনা আর দেখা হল না, কে জানে, হয়তো পরেরবার। শিবলী ভাইয়ার ভাষায়, ব্যাপার নাহ, নেক্সট টাইম!

পরিশিষ্ট:

আমি নিজেও জানি না পরিশিষ্টটাই শেষ কিনা, এখানে কোনো কাজটাজ নাই, আমার লিখতে ভালো লাগছে। গতকাল রাতে লেখা শুরু করেছিলাম, মাঝখানে খাওয়া-ঘুম-মানুষজন—সবকিছুই করেছি, সকালে উঠে এখন আবার লিখছি। বসে বসে চাচা-চাচী-ভাই-বোনদের সাথে গল্প করছি আর টাইপ করছি। তো, ভোরে শুধু আমি আর দুই চাচী উঠেছিলাম। তখন ছোটচাচী তিন কাপ চা বানিয়ে এনে হতাশ গলায় বলল, আব্বু তোমার অত রাতে একা গোরস্থানে যাওয়া ঠিক হয় নাই। সেজ চাচীও সায় দিলো, রাতের বেলা গেলে নাকি জ্বীনের আসর হয়। তখন মানুষ পাগল হয়ে যায়। এটা নাকি স্বাভাবিক না, এই কাজ জ্বীনেরা করে—ইত্যাদি। আমি বলতে যাচ্ছি, আমি তো এমনিই পাগল, তখনই ছোটচাচা এসে স্ট্রাইক করলো! ঘুম থেকে উঠে দরজার সামনে দাঁড়ালো, কিছু একটা বলবে—এরকম ভাব। আমরা কথা থামিয়ে চোখ বড়-বড় করে চাচার দিকে তাকাচ্ছি, সে কী বলে অপেক্ষা করছি।

অনেক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে চাচা বলল, আমি বোধহয় বড় হয়ে জ্বীন হব।

পরিপরিশিষ্ট:

এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নাই আসলে। গোরস্থান তো আমাকে খেয়ে ফেলতেসে না, আর দুষ্ট জ্বীনের চেয়ে আসলে দুষ্ট মানুষ নিয়েই দুশ্চিন্তাটা বেশি। আমি এমনিতে অবশ্য বেশ ভীতু, কিন্তু অন্ধকার একটা আকাশে নক্ষত্র দেখার সুযোগ— হতে পারে সেটা গোরস্থানের পাশে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সেটা কৃত্তিকার নিচে। পুরো আকাশ নির্লজ্জের মত নিজেকে মেলে ধরেছে, এই সুযোগ অন্তত আমি মিস করতে পারি না!

শুধু জোছনাটা...

ব্যাপার নাহ, নেক্সট টাইম!

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫, সকাল ১১টা ৩০ মিনিট:

পরিপরিপরিশিষ্ট:

এক জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছি, আবার অনেক কিছুই পাই নি। আমার খুব ইচ্ছা, এক রাতে একটা বিশাল খেতের মাঝখান দিয়ে হাঁটবো। অমাবস্যার রাত, আকাশে শুধু নক্ষত্র থাকবে, আর কিছু না। নক্ষত্রের আলোয় আমার হাঁটা লাগবে। এই পাগলামিটা আমার মধ্যে ভর করেছে রবিবাবুর ঐ কবিতাটা থেকে। ঐ যে, ঠাকুরমা দ্রুততালে ছড়া যেত পড়ে। আর...

“ফিরিছে সে চিরপথভোলা
জ্যোতিষ্কের আলোছায়ে—
গলায় মোতির মালা, সোনার চরণচক্র পায়ে।।”

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫, সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট:

পরিপরিপরিপরিশিষ্ট:

একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম। আজকে দুপুরে আবার একই জায়গায় গিয়েছিলাম। নদীর এইপারে-ওইপারে অনেকখানি জায়গা একাই চষে বেড়ালাম। একেবারে বিরান প্রান্তর না হলেও জায়গাটার মাঝে অদ্ভুত একটা বৈরাগ্য আছে। কিন্তু যেই আশ্চর্য জিনিসটা দেখলাম, সেটা কেন আমাকেই দেখতে হল জানি না। আমার মাথা এমনিতেই নষ্ট। অথবা, আমার মাথা নষ্ট দেখেই আমি এসব দেখে আশ্চর্য হই।

আমি দেখলাম, সেই বিরান প্রান্তরে একটা ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে।

পরিপরিপরিপরিপরিশিষ্ট:

বিরান প্রান্তর আমার ভালো লেগেছে। এই ভালো লাগার ব্যাপারটা হয়তো একটু বেশিই নতুন। কোথা থেকে শুরু হয়েছে সেটাও অনুমান করে ফেলতে পারি। ফুপীকে আমরা সেদিন দিনাজপুরে রেখে এসেছিলাম। দাদু অনেক কান্নাকাটি করেছিল অবশ্য। গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে দাদু যার সাথে ছিল, তাকে রেখে আসতে হবে, হোক সেটা দাদাভাইয়ের পাশে, তবু এই ব্যাপারটা মেনে নেয়া কঠিন। সবাই বুঝছে পারছে, ফুপী গত সাড়ে তিন মাস যে পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছিল তার চেয়ে হয়তো এটাই ভালো, তবু ব্যাপারটা মেনে নেয়া কঠিন। যাকগে, মাটি দেয়ার পর সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, আমি আর ছোটচাচা মসজিদে গেছি। নামাজ পড়ে বের হয়ে, আমার কী যেন মনে হল, আমি বাড়ির দিকে রওনা না দিয়ে ঠিক উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলাম। দিনাজপুরের যেই জায়গায় আমাদের বাসা, ওটা একেবারেই একটা গ্রাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দেখি, রাস্তাটা বাঁক নিয়ে অনেকদূরে চলে গেছে, আর বাঁকের অন্য পাশে বিশাল এক খেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে তো, প্রায় পুরো জায়গাটাই ফাঁকা। সন্ধ্যার পর সেই খেতের মাঝখানে আল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো আমার মনে হল, আমি এরকম কিছুই চেয়েছিলাম। একটা বিরান প্রান্তর।

পরিপরিপরিপরিপরিপরিশিষ্ট:

এতখানি কাব্যভাব হয়তো ভালো না। আজ রাতে ঢাকা রওনা দিতে হবে। যদিও এই মুহূর্তে কানে চন্দ্রবিন্দু গুঁজে লিখছি, কিন্তু এই পিএলে ঢাকা শহরের অর্থ কী— সেটা আমি জানি। পিএলের ঢাকা ধূসর। সেই ঢাকায় শহীদুল্লাহর খিচুড়ি থাকে না। কেমিস্ট্রির ঘাস থাকে না। শহীদ মিনারের চা থাকে না। জাদুঘর-বকুলতলা-শাহবাগ-দৃক—কিছুই থাকে না। কিন্তু...

There should be laughter after pain
There should be sunshine after rain
So why worry now?
(–Dire Straits)

মোহাম্মাদপুর, ঢাকা

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫, রাত ৯টা ৪৫ মিনিট:

আহারে, দিনাজপুরে আমাদের বাসা যেখানে, সেটা পুরোপুরিই একটা গ্রাম। সেখানে রাত নামে, পলাশীর মোড়ের মত আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া রাত না, সত্যিকারের রাত। নিল টাইসন বলেছিলেন, আমরা আকাশের তারাকে মাটিতে নামিয়ে এনেছি, তাই রাতেরবেলা আমরা আর নক্ষত্র দেখি না। আমাদের ফুলবাড়ির মানুষজন হয়তো কম্পিউটার চেনে না, আর্টসেল শুনে মাথা ঝাঁকায় না, মাথা ঝাঁকালে এনট্রপি বাড়ে না কমে—সেটাও জানে না, কিন্তু তারা এখনো আকাশের নক্ষত্র মাটিতে নামিয়ে আনে নি। সেই গ্রামে আমি ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে হাজির হলাম।

সেই গ্রাম, বিশাল এক প্রান্তর, নিচে আমি একা, আর আকাশে ছড়ানো মিলিয়নবর্ষী নক্ষত্র।

আবারও, কয়েকশো বিলিয়ন নক্ষত্রের মাঝে আমি হারিয়ে গেলাম।