পেন্সিল


এক.

অরিত্র যখন তার ডিপার্টমেন্টের সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল, তখন বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শেষ বিকেলে কার্জন হলে অসংখ্য ছেলেমেয়ে থাকার কথা। সত্যি বলতে কী, ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ তারিখে একটু বেশিই থাকার কথা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রির সামনের রাস্তাটা পুরো ফাঁকা। অরিত্র একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল। পৃথিবীর প্রচলিত নিয়মকানুনে তার কোন আস্থা নেই, কিন্তু নিয়মের বাইরে কিছু দেখলে একটু অস্বস্তি লাগে। সোমলতা এখনো আসেনি, সেটা নিয়েও একটু অস্বস্তি লাগছে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখা যায়, কিন্তু বের করতে ইচ্ছে করছে না। সময়টা না দেখেও বলা যায়, এতক্ষণে সোমলতার চলে আসার কথা। সোমলতার সাথে দেখা হওয়ার আগের কিছুক্ষণ অরিত্র একটু অস্থিরতায় ভোগে। এই অস্থিরতা কীসের জন্য, সে নিজেও জানে না। যেই মানুষটার সাথে প্রতিদিন দু-তিনবার দেখা হয়, না চাইলেও জহিরের ক্যান্টিনে, পুকুরপাড়ে, কিংবা কার্জনের গেটে যার সাথে দেখা হতে বাধ্য, সেই মানুষটাকে ফোন দিয়ে ডেকে আনলে কেন এত অস্থির লাগে, অরিত্র ব্যাখ্যা করতে পারে না।

ডিপার্টমেন্টের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অরিত্র সামনে তাকাল, এবং হঠাৎ করেই মুগ্ধ হল! এতক্ষণ এই দৃশ্য চোখে পড়েনি কেন? সামনের বিশাল কড়ই গাছটা থেকে ছোট ছোট পাতা ঝরছে, বৃষ্টি হচ্ছে যেন। ফাঁকা রাস্তাটা ঢেকে গেছে সেই হলুদ পাতায়। কেমিস্ট্রির সামনের মাঠ পর্যন্ত পুরোটাই হলুদ পাতায় ঢাকা। আর খানিকটা দূরে একটা গাছ বেগুনি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে—বেগুনি আগুন লেগে গেছে যেন! সন্ধ্যে নামার আগে আগে চারিদিকে একটা মায়াবী অন্ধকার, তার মধ্যে হলদে-বেগুনি রঙ—দেখতে বড় সুন্দর লাগছে।

অরিত্র চোখ থেকে চশমাটা খুলল, এবং প্রায় সাথে সাথেই সোমলতাকে রাস্তা ধরে আসতে দেখা গেল। মেয়েটা কখনই চুল বাঁধে না, ইচ্ছে করেই। সারা বছর অবশ্য এই নিয়ে কোন সমস্যা হয় না, কিন্তু ফাল্গুন মাসে হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে তার চুল উড়তে থাকে। সে এক দেখার মত দৃশ্য, হঠাৎ বাতাস এলো, আর সিনেমার সস্তা একটা দৃশ্যের মত সোমলতার চুল উড়তে শুরু করল। এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হওয়া উচিত না, কিন্তু অরিত্র প্রতিবারই মুগ্ধ হয়। এবং তার ধারণা, সোমলতা সেটা ভালোমতই জানে।

অরিত্র বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুগ্ধ হওয়ার সময় এটা না।

সোমলতা লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে এলো। মোটামুটি উৎফুল্ল গলায় বলল, ‘হাঁ করে কী দেখছিস?’

‘গাছটা থেকে পাতা ঝরছে, দেখ? হলুদ পাতা!’

‘ড্যাম! তুই দিনদিন মিনিংলেস হয়ে যাচ্ছিস। গাছ থেকে পাতা ঝরবে না তো কি ওয়াইন পড়বে টুপটাপ?’

অরিত্র চুপ করে সোমলতার দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটার চোখ গাঢ় রুপালি। এমন একজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা যথেষ্ট অস্বস্তিকর।

‘আমি ভার্সিটি ছেড়ে দিচ্ছি’, প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল অরিত্র।

দুই.

‘বাড়া ষোলো টিয়া মামা।’

রাহাত হতাশ চোখে বাসের হেল্পারের দিকে তাকাল। পকেটে খুব বেশি হলে একশো বিশ টাকা আছে—এই টাকাটুকু দিয়ে তার সারাদিন চলা লাগবে। বিকালে শারমিনের আসার কথা, একটা করে আইসক্রিম খেলেও হুড়মুড় করে পকেটের টাকাগুলো বেরিয়ে যাবে। এই হারে টাকা খরচ হতে থাকলে এই জীবনে আর মুজতবা আলী সমগ্রটা কেনা হবে না। রাহাতের মনে হল, তার পুরো জীবনটা এভাবেই কেটে যাবে। সারাজীবন ধরে মুজতবা আলী সমগ্র কেনার টাকাটুকু জমানোর চেষ্টা করবে, আর সেই টাকাটা খরচ হয়ে যাবে হেল্পার, শারমিন, ঝালমুড়ির পেছনে।

‘ছাত্র ভাড়া মামা…’, দুর্বল গলায় প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল রাহাত।

‘কোন ছাত্র নাই। ছিটিং বাস।’

রাহাত বাসের সামনের দিকে তাকাল। সকালবেলা বাসটা মিরপুর রোডের বিশাল জ্যামে আটকে আছে। ‘ছিটিং’ বাসের সামনের দিকেও তিনটে মধ্যবয়সী লোক হ্যান্ডেল ধরে ঝিমোচ্ছে। ওরা কি ঘুমিয়েই গেছে? রাহাতের হঠাৎ এটা ছেলেমানুষী ইচ্ছে হল লোকগুলোকে ধাক্কা দিয়ে দেখার—ঘুমিয়ে গেছে কিনা।

রাহাত একবার ঘুমিয়ে গিয়েছিল অবশ্য। দাঁড়িয়েই। মহাখালীতে নামার কথা, তার ঝিমুনি যখন কাটলো তখন বাসটা এয়ারপোর্ট পার হয়ে উত্তরায় চলে গেছে!

সেই দুপুরে উত্তরায় নেমে খুব অদ্ভুত একটা দৃশ্য তার চোখে পড়ল। খিদে মেটাতে রাহাত সাহস করে মাসকট প্লাজায় উঁকি দিচ্ছিল। ঢুকেই অরিত্রর সাথে দেখা হয়ে গেল। দেখাটা অবশ্য প্রথমে একতরফাই হল। কুপার্সের একটা ছোট্ট টেবিলে বসে মাথা নিচু করে কী যেন লিখছিল অরিত্র। এতটাই মন দিয়ে লিখছিল যে, রাহাত পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর পরেও টের পেল না। পিঠের ওপর দুম করে একটা কিল বসানোর পর ঘোরলাগা চোখে রাহাতের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এরপর যেন চিনতে পারল—ও, রাহাত!

কিছু না বলে অরিত্রর খাতাটা টেনে নিল রাহাত। যা ভেবেছিল তা না, অরিত্র কিছু লিখছিল না। তবে আঁকছিল। তরুণ একটা ছেলের ছবি, রাহাত ঠিক চিনতে পারল না ছেলেটাকে। ছবিটা থেকে চোখ সরিয়ে অরিত্রকে জিজ্ঞেস করল, ‘উত্তরায় কী করছিস? বৃহস্পতিবার, আজ না তোদের ক্লাস থাকে?’

‘হুম, আছে। ক্লাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তাই চলে এসেছি।’

‘সারা শহর পার হয়ে তুই উত্তরায় এসে বসে আছিস? কার সাথে দেখা করবি?’

‘কারো সাথে না, এমনিই। ক্লাসে বসে থাকলে ছবি আঁকব কীভাবে?’

রাহাত স্থির দৃষ্টিতে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে থাকল। অরিত্রকে সে গত বারো বছর ধরে দেখছে—কোন কারণ ছাড়া ক্লাস বাদ দিয়ে তার ছবি আঁকতে বসার কথা না। কী হয়েছে ছেলেটার?

তিন.

বছরখানেক পরের কথা। ডিসেম্বরের সন্ধ্যা।

অরিত্র শহিদ মিনারের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে একটা চায়ের কাপ। সারা মুখে দাড়িগোঁফ, প্রায় দেড় মাস দাড়ি কাটা হয়নি। ইচ্ছা করেই কাটেনি সে। শীতের সন্ধ্যাগুলোতে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে হাঁটতে বড় ভালো লাগে, কিন্তু দাড়িগোঁফ না থাকলে নিজেকে সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী মনে হয় না।

সন্ধ্যা নামছে, এখন বাসায় ফেরা উচিত। কিন্তু অরিত্র ফিরবে না। আজ দ্বাদশী, আজ রাতেই তাকে সোমলতার ছবিটা আঁকতে হবে। কোথায় বসে আঁকবে—সেই সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি হচ্ছে দেখে ছবিটাও শুরু করা যাচ্ছে না। কার্জন? এফবিএস?

না, ওসব জায়গায় গেলে সোমলতার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যে কারো সাথেই দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এমন কোথাও বসতে হবে—যেখানে পরিচিত কেউ আসবে না, কেউ তাকে দেখবে না।

মোকাররমে বসা যায়। অরিত্র চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আগাতে আগাতে ঠিক করল, সেখানেই বসবে। মোকাররমের বারান্দাটা ঠাণ্ডা, একটু শীত লাগবে অবশ্য। কিন্তু শীতের জন্যই লোকজন একটু কম থাকবে।

শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে আজকে। অরিত্র গায়ের চাদরটা আরেকটু টেনেটুনে মোকাররমের বারান্দায় উঁকি দিল। বারান্দাটা আসলেই ফাঁকা, শুধু শেষ প্রান্তে এক জোড়া ছেলেমেয়ে বসে আছে। অরিত্র ইচ্ছে করেই সেদিকে তাকাল না, তাকালেই খামাখা মেজাজটা বিগড়ে যাবে। চুপচাপ ব্যাগটা মেঝেতে রেখে ঝুপ করে বসে পড়ল। সন্ধ্যা সাতটা বাজে, দ্রুত ছবিটা আঁকা শুরু করে দিতে হবে।

চার.

স্কেচের খাতার একটা ফাঁকা পৃষ্ঠা বের করে অরিত্র অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিল। প্রতিটা ছবি শুরুর করার আগে তার কেন যেন এই অনুভূতিটা হয়। একটু দিশেহারা লাগে, সাদা পৃষ্ঠাটা দেখে মনে হয়, এখানে কিছু করা সম্ভব না। ছবির প্রথম দুই-একটা টান দেয়ার সময় খুবই অস্বস্তি লাগে, হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অরিত্র জানে, খুব ভালোমতই জানে, একবার চোখ দুটো এঁকে ফেললেই ছবিটায় প্রাণ চলে আসবে। একবার সেটা করে ফেলতে পারলে বাকি ছবিটুকুর জন্য ভাবতে হবে না।

সাদা পৃষ্ঠাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অরিত্র একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। ধ্যান করছে যেন। সোমলতা, সোমলতা, এই সাদা পৃষ্ঠায় পেন্সিলে আঁকা সোমলতা…অরিত্রর কল্পনায় ধীরে ধীরে ছবিটা আসতে থাকল, গোলগাল একটা মুখ, কখনই হাসবে না—কিন্তু মনে হবে যেন মুখ টিপে হাসছে, চুল না বাঁধার কারণে মুখটা একটু এলোমেলো, আর চোখ, চোখ…সোমলতার চোখ দুটো কল্পনায় আসার সাথে সাথে অরিত্রর বুকটা কেঁপে উঠল।

ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই কি সে অপেক্ষা করছিল?

পেন্সিল দিয়ে প্রথম আঁচড়টা দিতে দিতে অরিত্র আবিষ্কার করল, শুধু বুক না, তার হাতও কাঁপছে। এবং এই কাঁপুনি কেবল শীতের জন্য না, এর উৎস অন্য কোথাও।

ছবিটা সত্যিকারের রূপ পাবে শেড দেয়ার সময়—কাজেই চেহারাটা খুব বেশি সময় নিয়ে না করলেও চলবে। অরিত্র আউটলাইনটা খুব দ্রুতই এঁকে ফেলল, অন্তত তার মনে হল দ্রুত এঁকেছে। তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলায় অবশ্য একটা লাভ হয়েছে, অনেক্ষণ সময় নিয়ে শেড দেয়া যাবে। আচ্ছা, রাত ন’টা পর্যন্ত আঁকলে কতক্ষণ পাওয়া যাবে? এখন কয়টা বাজে? মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে অবশ্য, বারান্দায় ওপাশে বসে থাকা জুটিটাকে গিয়ে কি সময় জিজ্ঞেস করা যাবে?

অরিত্র বাম দিকে তাকাল, এবং সাথে সাথেই একটা ধাক্কা খেল! বারান্দার ঐ প্রান্তে কেউই নেই—অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে সে আসার সময়ও ছেলেমেয়ে দুটো বসে ছিল। অরিত্রর গা একটু শিরশির করে উঠল। পুরো পৃথিবীটা হঠাৎ এত চুপচাপ হয়ে গেল কেন? রাস্তা, রাস্তা…ওপাশে দোয়েল চত্বরের রাস্তাটা কি আজ বন্ধ? মনে হয়। নাহলে একটা গাড়িও প্যাঁ-পোঁ করবে না?

খাতা-পেন্সিল সবই বারান্দায় রেখে অরিত্র তড়িঘড়ি করে রাস্তার দিকে আগাল। এবং বারান্দা থেকে নামার পরপরই তার মনে হল, সোয়েটারটা না আনা বড় ভুল হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষে কেবল একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে বের হওয়া কোন কাজের কথা না। শীতে রীতিমত হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে সে রাস্তায় নামলো, এবং আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল, পুরো রাস্তাটা ফাঁকা! আসলেই, রাত ক’টা বাজে এখন? ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের সামনে দুটো রিকশা দাঁড়িয়ে আছে—ওরা কি বলতে পারবে ক’টা বাজে?

অরিত্র ইতস্তত ভঙ্গিতে ম্যাথের সামনে গেল। রিকশাওয়ালাদের কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ডিপার্টমেন্টের ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ল। নীল রঙে জ্বলজ্বল করছে, রাত এগারোটা চল্লিশ মিনিট।

হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাসে অরিত্র আবার কেঁপে উঠল।

রাত এগারোটা চল্লিশে কি বাসায় ফেরাটা উচিত হবে? অরিত্রর চিন্তাভাবনা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল। যেহেতু যথেষ্ট রাত হয়েই গেছে, আরেকটু রাত হলেও নিশ্চয়ই ক্ষতি নেই। কিন্তু ছবিটা শেষ না করে আজ রাতে ঘুমোনোটা…না, একেবারেই ঠিক হবে না কাজটা।

অরিত্র প্রায় উদ্‌ভ্রান্তের মত দৌঁড়ে মোকাররমের বারান্দায় ফিরে এলো। যে করেই হোক, সে ছবিটা শেষ করেই যাবে।

একটা পেন্সিল নিয়ে অরিত্র শেড দিতে শুরু করল। খুব, খুবই হালকা করে গালের শেডটা দিতে হবে। সবাই একই ভুল করে—হুড়োহুড়ি করে কাজটা করে ফেলার চেষ্টা করে। অন্তত এই ছবিটায় হিজিবিজি পেন্সিল চালানো যাবে না, কোনভাবেই না! আচ্ছা, সোমলতার ঠিক ওপর থেকে আলোটা পড়লে মুখটা কেমন লাগবে? চোখের নিচে একটু ছায়া পড়বে, সেটা বেশি গাঢ় করে আঁকলে মনে হবে কালি পড়েছে—কয়েকবার করে, সাবধানে আঁকতে হবে চোখের নিচটুকু। আর গালের পাশ থেকে শেডটা মিশে যাবে, আহা, আঁকতে আঁকতে অরিত্রর চোখে প্রায় পানি চলে আসলো।

পাঁচ.

ঘরের বাতি নিভিয়ে সোমলতা চুপ করে শুয়ে ছিল। ঠাণ্ডাটা যেন লেপের নিচেও ঢুকে যাচ্ছে, কামড়ে ধরার চেষ্টা করছে। এই শহরে সাধারণত এতখানি শীত পড়ে না। সারা সন্ধ্যা পুতুলনাচের ইতিকথা পড়ার পর একটা ঘোর লেগে গেছে তার, হঠাৎ করেই মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কী যেন হয়, চোখে পানি চলে আসে। অনেকদিন পর আম্মুর মুখটা মনে করতে করতে সোমলতার আবার এমনটা হল। আবার কবে বাড়ি যাওয়া হবে, কে জানে! প্রতিদিনের ক্লাস, হইচই, সবকিছু বড় দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা, তার জীবনটাও কি পুতুলনাচের ইতিকথার ছোট্ট একটা গল্প? সে নিজেও যদি একদিন সব ছেড়েছুড়ে কারো সাথে চলে যায়, যাযাবরের মত দেশে দেশে ঘুরতে শুরু করে, আম্মু কি বেশি কষ্ট পাবে?

রাত বাড়ছে, দ্বাদশীর চাঁদটা বারবার মেঘের নিচে ঢাকা পড়ছে। সোমলতা জানে, যতক্ষণ ঘুম না আসছে, তার মন খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে থাকবে।

ছয়.

ছবিটা আঁকতে আঁকতে অরিত্রর অশরীরী একটা অনুভূতি হল, এই বারান্দায় সে একা না। অন্তত পনেরোজন মানুষ আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে, নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকে দেখছে। শহিদ মিনারে চা বিক্রি করে যেই মামাটা, সে সামনের জঙ্গলটায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। একটা গাছে হেলান দিয়ে ঠিক তার দিকেই দেখছে। দূরে মোকাররমের গেটের কাছে বাবা হাঁটছেন, দিশেহারা ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন বারবার। অরিত্রকে খুঁজছেন বোধহয়। চারুকলার বাঁশি বাজানো লোকটা সামনেই সিঁড়িতে বসে আছে। মূর্তির মত লাগছে তাকে, সবসময়ই লাগে। বারান্দার একদম শেষ প্রান্তে দিদি বসে, মাথা নিচু করে একটা বই পড়ছে। অরিত্র সেদিকে তাকাতেই আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরাল, ঠোঁটে অদ্ভুত একটা হাসি।

কে জানে, হয়তো প্রত্যেকটা মানুষই তার কল্পনা। রাত অন্তত সাড়ে তিনটা বাজে, এসময় এই মানুষগুলোর একসাথে মোকাররমে জড় হওয়ার কোন কারণ নেই। শীতে কাঁপতে কাঁপতে অরিত্র আবার ছবিটার দিকে মন দিল। সোমলতাও যেন হাসছে, ঠিক অরিত্রর দিকে তাকিয়ে। অরিত্রর আবারও বুক কাঁপতে শুরু করল, ছবিটা ঠিকমত শেষ হবে তো? চুলগুলো যথেষ্ট গাঢ় হয়নি, নাইন বি পেন্সিলটা বসাতেই হবে। সোমলতার চুল অনেক গাঢ়, জীবনানন্দ কি এই চুলকেই বিদিশার নিশা বলে ডাকতেন? হতে পারে। এমন চুল আঁকার জন্য সিক্স বি যথেষ্ট না। কিন্তু প্রচণ্ড শীতে হাত যখন জমে গেছে, তখন একটা ছবিতে নাইন বি বসাতে যথেষ্ট সাহস লাগে। একটু খামখেয়াল, একটা এলোমেলো স্ট্রোক পুরো চুলটা নষ্ট করে দিবে…

চাদরের নিচে জড়সড় হয়ে বসে অরিত্র আরেক দফা শেড দেয়া শুরু করল…সামনের বিশাল খোলা রাস্তাটা থেকে হু হু করে বাতাস আসছে…ঠাণ্ডায় মাথার ভেতরটাও যেন জমে যাচ্ছে…কিন্তু অরিত্রকে শক্ত থাকতে হবে…ছবিটা শেষ করতেই হবে…যে করেই হোক…

সাত.

সোমলতা সাধারণত সকালবেলাটা মোকাররম ভবনে আসে না। হল থেকে বেরিয়ে এক কাপ চা খেয়ে সোজা ডিপার্টমেন্টে চলে যায়।

তবু, সকাল সাতটা ছাব্বিশ মিনিটে ক্লাসে যাওয়ার সময় সোমলতা যদি ভুলেও মোকাররমে উঁকি দিত, খুব অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ত। বারান্দায় এক কোণে ছবি আঁকার জিনিসপত্র ছড়ানো, তার মাঝখানে অরিত্র বসে আছে। একাই। দেয়ালে হেলান দিয়ে, চোখ বন্ধ করে। কোলের উপর সোমলতার ছবিটা, আর ডান হাতে পেন্সিল। দেখে বড় মায়া হবে, মনে হবে, ছেলেটা যেন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে।