এলোকথন (ফিরে আসা চৌদ্দ)

“Lay her a-hold, a-hold! Set her two courses: off to sea again, lay her off.”

মুশকিল, এই সময়ের বৃষ্টিটা বড় মুশকিলে ফেলে দিচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টিটা হয়েই যাচ্ছে। এই একটু আগে বিষম বেগে বৃষ্টি নামলো—পুরো পৃথিবীটা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যেন।

আমার জন্য মুশকিল, কারণ বৃষ্টি হলে পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয় না। খুব, খুবই ইচ্ছে হয় লিখতে। অথচ একগাদা পড়া জমে আছে। নিলয়কে (আমাদের ক্লাসের নিলয়) কথা দিয়েছি, ঠিকমত পড়াশোনা করব।

আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। চৌদ্দ সালে ঠিক এভাবেই বৃষ্টি হত। আমরা এইচএসসি দেই সে বছর। প্রত্যেকটা কথা যেন স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে। ঠিক আমাদের প্র্যাকটিকাল পরীক্ষাটা শেষ হল, আর সেই বছরের বৃষ্টিটাও শুরু হল।

এইচএসসির পরের সময়টুকু মানুষ একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটা রেস, এই রেসটা মানুষকে অবিশ্বাস্য একটা ঘোরের জগতে নিয়ে যায়। আমরা সেই ঘোরের মধ্যে বাস করতাম।

আহা! সেই দিনগুলো!

মানে, কল্পনার বাইরে একেকটা দিন গেছে। তখন ছবিটবি আঁকতাম না, কিছুই করতাম না। শুধু পড়তাম, মন ভালো থাকলে পড়তাম, আর মন খারাপ থাকলে…হুম, তখনও পড়তাম। আর বৃষ্টি হত বাইরে। জানালার পাশে বসে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে পড়তাম। কেমিস্ট্রির সেই অর্গানিক চ্যাপ্টারগুলো! মনটাই ভালো হয়ে যেত পড়তে পড়তে।

যেদিন থেকে আমাদের ভর্তি কোচিং শুরু হল, সেদিন আমার ঝাঁপিয়ে জ্বর আসলো। আমার মনে আছে, ক্লাসের সামনে বসে একটা ভাইয়া বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমাদের প্রচুর পড়া লাগবে, হ্যানত্যান, আর ক্লাসের পেছনে আমি জ্বরের ঘোরে কাঁপছি। ক্লাসটা যখন শেষ হল, আমি প্রায় জোম্বি অবস্থায় চলে গেছি। কোনমতে টলতে টলতে বাসায় ফিরে ধাপাস করে সোফার উপর শুয়ে পড়লাম। প্রায় সপ্তাহখানেক আমি শুয়েই থাকলাম। ওদিক থেকে অনিক খোঁজ নিচ্ছে, এ্যালানা মেসেজ দিচ্ছে, পড়ার চাপে ওদের বারোটা বেজে যাচ্ছে, আর আমি একশো বছরের বৃদ্ধের মত শুয়ে আছি, যেন ওটাই আমার একমাত্র ঠিকানা।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ছয়টার সময় দৌঁড়ে উদ্ভাসে যাওয়া লাগতো। তখনও বৃষ্টি। সর্বনাশ, বৃষ্টি থামতোই না। মেসাল ফোন দিয়ে ঘুম থেকে তুলতো, অথবা আমার ঘুম আগে ভাঙলে আমি তাকে ডাকতাম। এরপর দুজন মিলে আমাদের এলাকার বিখ্যাত ভাঙা রাস্তাগুলো ঠেলে একটা লেগুনায় গিয়ে উঠতাম। কখনও তাসফিনকে পেয়ে যেতাম, তিনজন মিলে পড়া নিয়ে বকবক করতে করতেই যেতাম, সিরিয়াসলি, আমার জীবনে আর কিছুই ছিল না। (গান শুনতাম শুধু, আর কিছু না। কেন এমন ছিলাম?)

মেসালের সেই বিখ্যাত উক্তি এখনও মনে আছে। “ফিজিক্সের এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা নাই, এটা হয়, তাই হয়।”

আমার উল্টোপাল্টা লিখতে ভালো লাগছে। এই লেখা আর দশজন পড়বে না, কাছের মানুষজনই কেবল পড়বে। কাজেই মনে যা আসে, আমি লিখে যাব।

"Nobody feels any pain
Tonight, as I stand by the rain
But everybody knows
That baby's got new clothes
But lately I see her ribbons and her bows
Have fallen from her curls..."

আহা, বব ডিলান ছেলেটা আর যাই হোক, গলাটা চমৎকার ছিল।

অবশ্য, চৌদ্দ সালের সেই সময়টায় আমি বব ডিলান শুনতাম না। প্রচুর শুনতাম রবীন্দ্র।

এবং এভাবেই, এক সন্ধ্যায় আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেল।

বৃষ্টি হচ্ছিল সেই সন্ধ্যায়। আমি, খুব সম্ভবত কেমিস্ট্রি পড়ছি, আর ল্যাপটপে হালকা সুরে রবীন্দ্র বাজছে। দেবব্রত বিশ্বাসের গলায়। এই গানগুলোর অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, হঠাৎ করেই গানের একেকটা কথা মাথায় ঢুকে যায়, আর বের হয় না।

চৌদ্দ সালের সেই সন্ধ্যায়, অন্ধকার নামার মুহূর্তে আমার মাথায় একটা গানের কয়েকটা কথা ঢুকে গেল।

"হয়তো সে তুমি শোনো নাই,
সহজে বিদায় নিলে তাই
আকাশও মুখর ছিল যে তখনও, ঝরঝর বারিধারায়।"

আর এরপর, এরপর…

"আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে
জনমের মত, হায়, হয়ে গেল হারা।"

লাইন দুটো শোনার পর আমি অনেক্ষণ, অনেক অনেক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। কথাটা শুধু সত্যি না, কথাটা খুব বড় রকমের সত্যি।

আহা! সব স্মৃতিগুলো ফ্ল্যাশব্যাক করা শুরু করছে, মাঝেমধ্যে রীতিমত মহাপ্লাবনের মত স্মৃতিগুলো আসতে শুরু করে, মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়…

মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই সময়টায়, এই এইচএসসির শেষের দিকে, আমার যখন ম্যাথ পরীক্ষা চলে, তখন ভাষা প্রতিযোগের ক্যাম্পে ডাক পেলাম। জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মত একটা ক্যাম্পে ডাক পাওয়া, আমার রীতিমত মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। আমি ক্যাম্পে যাবোই, এবং মা যেতে দিবেই না, খুব নরম গলাতেই আম্মু বলল, যেতে দিবে না।

আমি…

আচ্ছা, ক্যাম্পটাও কিন্তু হচ্ছিল আমাদের এলাকারই একটা জায়গায়।

যেই তিনদিন ক্যাম্প হল, সেই তিনদিন টানা বৃষ্টি হল। যারা ভাগ্যবান, তারা ক্যাম্পে গেল। আমার মত কিছু দুর্ভাগা বাসায় বসে বসে ম্যাথ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকল।

যেদিন ক্যাম্প শেষ হয়…হাস্যকর, সেই সন্ধ্যাতেই আমার বাসায় ক্যাম্পে আসার জন্য চিঠিটা আসলো। ক্যাম্পে কী কী আনতে হবে, বিছানার চাদর, ব্রাশ, টুথপেস্ট, আর সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি বোকার মত বসে থাকলাম।

এত কথা, এত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার!

গুনগুন করে একটা সুর গাইতাম আমি, আপুর ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টি হলেই সেই সুরটা মাথায় ঘুরতো…

আর তামান্না! ওরা…এই যে টানা দুই বছর আমাকে ওরা সাপোর্ট দিয়ে গেল, ওদের দরকারের সময় আমি ডুব দিলাম। ছোটখাট ডুব না, বিশাল ডুব…

আর এই যে এই বৃষ্টিটা, টানা যে বৃষ্টিটা হয়ে যাচ্ছে, সেটা চৌদ্দ সালের পর আর আসে নাই…

আমার একগাদা এ্যাসাইনমেন্ট শিকেয় তুলে রেখে আমার এখন কেবল সেই কথাগুলো মনে করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আচ্ছা, রাহাতের মামা যে বলেছিলেন, ‘কী পেলাম আর কী পেলাম না—এসব ভাবলে মিউজিক হবে না’—এবং এই কথাটা বলে উনি যে রবীন্দ্রভারতীতে চলে গেলেন, ওনার মত সাহসটা কি করা উচিত ছিল?

রবিশঙ্করদের সান্নিধ্য, আলী আকবরের মত মানুষদের কাছে পাওয়া…

আজকাল খুব বেশি ইচ্ছে হচ্ছে লিখতে। সম্ভবত আগে কখনই এতখানি তীব্র ইচ্ছা হয়নি। আমি জানি আমি লিখতে পারি না, কিন্তু কম্পিউটার সায়েন্সও তো পারি না—সেটা তো ঠিকই পড়ে যাচ্ছি।

গতকাল রাতে অনেকদিন পর ‘পূর্ব-পশ্চিম’ বইটা খুললাম। আবারও মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। সুনীল কীভাবে লিখতেন এত সুন্দর? এমন একটা উপন্যাস লিখতে পারলে আমি আপাতত বর্তে যেতাম। আহা, পিকলু মারা যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে অস্থির হয়ে বসে আছে, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ কবিতাটা অর্থ বের করার চেষ্টা করছে, কিন্তু চিন্তাভাবনা বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, আর ওদিকে তুতুল…

পিকলুর হঠাৎ খেপে যাওয়া কবিতা লেখার জন্য…

পুরো উপন্যাসটা আবার মনে পড়া শুরু করল, বিশাল সেন্টি খেলাম আবারও। সুষ্মী আপুকে সেই নিয়ে একটা মেসেজ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, ভেবেছিলাম আজ বলব ব্যাপারটা। আপু মাত্রই ‘সেই সময়’ শেষ করেছে, এবং ফোর্থ ইয়ারের পড়া শেষ করেছে—তার এই অনুভূতিটা ভালোমতই বোঝার কথা।

শেষপর্যন্ত বকবক করতে করতে এই কথাটাই বলা হল না।

আমি জানি না শেষপর্যন্ত কী হবে, কিন্তু এই যে বৃষ্টি, এইসব নস্টালজিয়া, আমার খুব ইচ্ছে করে একটা ভালো উপন্যাস লিখে যেতে।

খুব, খুব বেশিরকম ইচ্ছে করে।