যাকে আমি মেইল দেই না

​​প্রিয় "ইয়ে",

সম্বোধনটা যথেষ্ট গুরুতর হয়ে গেছে রে। "ইয়ে" বলে কাউকে ডাকাটা খুবই ইয়ে দেখায়। কিন্তু তোর নামটা না লিখে কী যে লেখা যায়—সেটা ভেবে পেলাম না। বল তো কী লেখা যায়?
​​
আমার সম্বোধনের মত তোর অভিযোগটাও গুরুতর, আমি আর মেইল দেই না। অভিযোগটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, কারণ সেটা একশোভাগ সত্যি। মেইল দেয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে না? আমরা আবারও সস্তা হয়ে যাওয়া শুরু করেছি। তুই একটুখানি, আর আমি অনেকখানি।

আমি কিন্তু পারলে ফেসবুকটা বন্ধ করে দিতাম। আবারও মেইল-মেইল আর ফোন-ফোন খেলতাম। মাসকয়েক আগের ঐ দিনগুলো কী চমৎকার ছিল, জানিস? হাতে​​গোণা পাঁচ-সাতজনের সাথেই কথা হত কেবল। কিন্তু যাদের সাথে হত, একদম একশোভাগ খাঁটি কথা হত। মানে, অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার ছিল​​—​মনে কর, ​​অর্ণবের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই, এবং নেই মানে একেবারেই নেই, শূন্য। আর পদ্মর সাথে যোগাযোগ আছে—সেটার ​অর্থ হল, ​কয়েকদিন পরপর​ বাসায়​ বসে​ আড্ডা, আর কয়েকবার করে ফোনে​ চেঁচামেচি। 

প​দ্মদের বাসায় কতদিন যাই না জানিস?

আবার ফেসবুকটা বন্ধ করে দিতে পারলে ভালো হত কিন্তু। সবার কাছ থেকে পাওয়া ছোট ছোট চ্যাটের পরিমাণ কমত বটে, কিন্তু দুই-একজনের কাছ থেকে পাওয়া বড় বড় মেইলগুলো ফিরে আসত।

তোর সেই মেইলটা অবশ্য মারাত্মক ছিল। ওটা যখন খেয়াল করি, তখন আমি সম্ভবত ক্লাসে। উমম....হ্যাঁ ভার্সিটিতে ছিলাম তখন। মেইলটা পড়ার পর সারাদিন খিক খিক করে হেসেছি। কিন্তু কী বলব বুঝতে পারিনি। সেই রাতে ফোনে কথা না বলে যথেষ্ট ভালো করেছিলি, সম্ভবত তোর চেয়ে আমিই বেশি ঝামেলায় পড়ে যেতাম।

না, কানটান লাল করে ফেলতে হবে না। ঐ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য এই চিঠি লিখছি না।

এমনিই লিখছি। মাঝেমধ্যে কেবল লিখে যেতেই মজা লাগে। চিঠি লিখে যেতে আরও বেশি মজা লাগে।

খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার জানিস? সাধারণ একটা কথা কাউকে চিঠিতে লিখে দেখ, সাধারণ কথাটাই কেন যেন খুব বেশি সুন্দর লাগতে শুরু করবে। এই জিনিসটা আমি খেয়াল করি কয়েকদিন আগে। দিনাজপুরে যেই দুপুরে প্রচণ্ড ঝড় হল, সেদিন বিকালবেলা আমি আর আবির বসে বসে লিখছিলাম। বৃষ্টির পর বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব ছিল, আর দিনাজপুরের শান্ত পরিবেশ—ভালো লাগছিল লিখতে। পরেরদিন রাতেরবেলা ঘুমানোর আগে দেখলাম, আমার বিছানায় আবির তার ডায়েরিটা ফেলে রেখেছে। জিজ্ঞেস করলাম, আগেরদিনের লেখাটা পড়তে দিবে কিনা। বলল, দিবে। আমি উৎসাহ পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পুরো নোটবুকটাই পড়ে ফেলতে পারব কিনা! আবির হেসে ফেলল, সে পুরোটা পড়তে দিবে না।

স্বাভাবিক, আমি নিজেই আমার লেখাগুলোতে পারলে তালাচাবি মেরে রাখি। সব লেখা সবাই পড়ে ফেললে বিপর্যয় ঘটে যাবে। সর্বনাশ, আমার ডায়েরি যদি তোকে পড়তে দেই, তুই রীতিমত ঝাড়ু নিয়ে ছুটে আসবি আমাকে পিটুনী দিতে। তুই একা না, কয়েকজনই আসবে ঝাড়ু নিয়ে। (শুধু জুনায়েদ ভাই খালি হাতে আসবে। ওনার হুংকারই যথেষ্ট, ঝাড়ু লাগবে না।)

কথার শাখাপ্রশাখা ছড়াতে ছড়াতে কোথায় যাচ্ছে, দেখছিস? যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, সেই রাতে আবিরের ডায়েরিটা খুলে আমার মজা লাগলো। আমি যেই কথাগুলো লিখছিলাম, আবির আমার এক হাত দূরে বসে প্রায় একই কথা লিখে গেছে। কিন্তু তার চেয়েও জোস ব্যাপার​—আবির সেই কথাগুলো লিখেছে একটা চিঠিতে। সেই চিঠিও এটার মতই, কাকে লেখা সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সেটা একটা চিঠি, এবং ঠিক এই কারণেই সম্ভবত লেখাগুলো পড়তে খুব বেশি ভালো লাগছিল। (ভালো লাগা মানে কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ না। একইসাথে আনন্দ, কষ্ট, মুগ্ধতা, বিস্ময়, কৌতূহল​—সবকিছুই।)

চিঠি একটা ভালো জিনিস।

রাত একটা বেজে গেছে প্রায়! এই সময়টায় মাথায় অনেক কিছু আসার কথা, অনেক কিছু লিখতেও ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু আমাকে এখন পড়তে যেতে হবে। ভার্সিটিটা খেয়ে দিচ্ছে রে। ভয়ংকর সব এ্যাসাইনমেন্ট। আমার কিন্তু সিএসই পড়তে এখনও মজা লাগে, কিন্তু আমার আপত্তিটা কোন জায়গায়, জানিস? এই যে দিনরাত এমনভাবে সিএসই পড়তে হচ্ছে, পড়ার চাপে আমরা নিজেদের চিন্তাভাবনাকেই বিসর্জন দিচ্ছি।

একটা মানুষ অনেক ভালো সায়েন্স পারে, সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়, কিন্তু সে তার প্রিয় মানুষদের সাথে দেখাও করে না, দিনরাত নিজেকে নিয়েই থাকে—এমন মানুষ হয়ে লাভ আছে?

ভার্সিটি চেষ্টা করছে আমাকে আবেগশূন্য একটা ভালো ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। আর আমি চেষ্টা করছি মানুষ হতে। দেখা যাক কে জেতে।

এবার পড়তে বস। গাধা। সারাক্ষণ নেটে ঘাঁটাঘাঁটি। পড়াশোনা নাই তোর? মূর্খ হয়ে থাকবি সারা জীবন?

ইতি,
নোবেল