এলোকথন (বিরলের ডায়েরি)

[এলোকথন অর্থ কী? সম্ভবত, এলোমেলো কথাবার্তা। এই কথাগুলো কেবল নিজের ডায়েরিতেই লেখা উচিত, এর বাইরে না।
তবে ভরসা এই যে, যেসব লেখা আমার নিজের জন্য, সেখানে আরও কয়েকজন মানুষের দাবি আছে।]

১৫ এপ্রিল, শনিবার

বিকাল ৫:৩৭

ঘুমাইনি।

ভাগ্যিস ঘুমাইনি!

অথচ জেগে থাকার তেমন কোন কারণ ছিল না। সারারাত ট্রেনে এসে এবং সারাদিন ক্যাম্পে চেঁচামেচির পর একটা কথাই সত্য মনে হয়—ঘুম। সেই সাথে আজকে দিনাজপুরের আবহাওয়াটাও ঘুম ঘুম, চারিদিকে কেমন শান্তির একটা ভাব। সকালে অবশ্য ভালোই গরম ছিল। দুপুরে খাবার পর থেকে সবকিছু কেমন যেন দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করল। আমরা যখন সায়েন্টিফিক পেপারের লেকচারটা দিতে শুরু করেছি, আকাশটা একটু একটু করে কালো হচ্ছে। ঝড় আসার ঠিক আগে আগে বিদ্যুৎ চলে গেল, আর চারপাশ এমনই অন্ধকার হয়ে গেল, ক্লাসরুমে আর কাউকেই দেখা যায় না। খারাপ লাগছিল না ওভাবে ক্লাস নিতে। কারই বা খারাপ লাগে ওসব মুহূর্তে? ওদিকে বৃষ্টির ঝাপটা আসছে, আমি একবার করে ক্লাসের বাইরে যাচ্ছি, ফিরে এসে আবিরের কাছ থেকে ফ্লোর নিচ্ছি, তখন আবার আবির ক্লাসের বাইরে যাচ্ছে! Alternating lecture.

পরে ঝড়টা যখন মোটামুটি প্রলয়ের রূপ নিতে শুরু করল, তখন ক্লাস নেয়া বন্ধ করতে হল। প্রচণ্ড ঝড় মানুষকে যে শুধু অশান্ত করে—তা কিন্তু না, ঝড় মানুষকে শান্তও করে। আমি দুটো রূপই দেখলাম। একদল ছেলেমেয়ে তীব্র আনন্দে চেঁচামেচি শুরু করল। আর ঠিক তাদের পাশাপাশিই, খুব অল্প কিছু ছেলেমেয়ে একেবারে চুপ হয়ে গেল। ক্লাস সিক্সের যেই মেয়েটা একটু আগে গুনগুন করে ‘তোমার খোলা হাওয়া’ গাইছিল—সে মোটামুটি উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে লাগল। আবির বারান্দার সিঁড়িতে চুপ করে বসে পড়ল—কে জানে কী ভাবছে ছেলেটা? আমি ফাঁকা ক্লাসরুমটার পেছনের একটা টেবিলে বসে দেখতে লাগলাম মানুষগুলোকে, আমার মানুষ ভালো লাগে। [ক্লাস সিক্সের ঐ পিচ্চিটার নাম মুক্ত বিহঙ্গ দত্ত। এবং আশ্চর্য হয়েছিলাম, যখন আবিষ্কার করলাম সে বিধান স্যারের মেয়ে। স্যার অসাধারণ একজন মানুষ, তার মেয়ে অসাধারণ হবে—এটাই স্বাভাবিক।]

যাকগে, ঝড়টা যখন শেষ হল, তখন স্কুলের নিচু অংশটুকু প্রায় প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হল, সেখানে স্রোতও যথেষ্ট আছে, বাতাসের জন্যই সম্ভবত। ‘কাগজের নৌকা, কেউ বানিয়েছে তা—চুপচাপ ভাসিয়েছে জলে’—আমিও সেই জলে একটা নৌকা ভাসিয়ে দিলাম। ক্লাস থ্রি-তে পড়ার সময় আমাদের স্কুলে ভাসাতাম।

সেটা দুহাজার চার সালের কথা, এই তেরো বছর আমি কোথায় ছিলাম?

বৃষ্টিটা শেষ হওয়ার পর যে শুধু ঠাণ্ডা পড়ল—তা না, বেশ ভালোই ঠাণ্ডা পড়ল। মীম ভাই তার হাফহাতার জামার নিচে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকল। আমরা স্কুল থেকে বেরিয়ে এক কাপ করে চা খেয়ে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম।

এবং আমি ভাবছি…

নাহ, মীম ভাই বুঝবে না। বুঝবে না আবিরও, এই যে দিনাজপুর, আমার হারানো দিনাজপুর—এই শহরের প্রত্যেকটা ঘটনা আমারে টানতেসে, প্রত্যেকটা ছোটখাট ঘটনায় আমার নস্টালজিয়া। চায়ের দোকানের খালা যে ‘তুমি তুমি’ করে ডাকবে—সেখানে নস্টালজিয়া। রিকশাওয়ালার মুখ দিয়ে বের হওয়া প্রত্যেকটা উচ্চারণ, মাটির চুলার ঘ্রাণ—নাহ, এই শহরের প্রত্যেকটা কণা আমারে পুরান কথা মনে করায় দিতেসে—ট্রেন থেকে নামামাত্র আমি আবিরকে জিজ্ঞেস করসিলাম, কোন ঘ্রাণ পাচ্ছে নাকি—নাহ, ওটা কেবল আমাকেই একশোরকম স্মৃতি মনে করাইতেসে, আর আমি হাতড়ায়ে যাইতেসি।

এই দিনাজপুরের একটা গ্রামে খলিল নানাভাই থাকত। একটা চৌকিতে বসে। আমাদের ধারণা ছিল, অনাদি অনন্তকাল ধরে উনি চৌকিতেই বসে থাকবে, গাছ, ফুলার রোডের শেষ মাথার কড়ই গাছটা যেমন অনন্তকাল ধরে দাঁড়ায় আছে, কেবল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, ঠিক সেইরকম খলিল নানাভাইও অনন্তকাল ধরে ওখানে বসে থাকবে, ফুলবাড়ির ছোট্ট একটা গ্রামের ছোট্ট একটা চৌকিতে।

অনন্তকালের অর্থ যে সাতানব্বই বছর—সেটা আমরা বুঝেছিলাম উনি মারা যাওয়ার পর।

সন্ধ্যা ৬:১৮
প্রসঙ্গের বাইরে চলে যাচ্ছি। ল্যাপটপের কিবোর্ডের উপর আমার তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, স্বীকার করছি। যাকগে, বর্তমান পরিস্থিতিটা বলি। ঘন্টাদুয়েক আগে বাংলোতে ফিরে আমরা আবিষ্কার করলাম, বিছানার উপরে একটা আস্ত লেপ! তো, প্রথমেই মীম ভাই ক্লান্ত উটের মত সেই লেপের নিচে ঢুকে গেল। তাই দেখে আবির গেল লেপের অন্য অংশ দখল করতে। দুজন মিলে একই লেপের নিচে ঢুকে যাওয়ার অংশটুকু ব্যাখ্যা না করাই ভালো অবশ্য। এই ঘটনাটুকু সেন্সর্ড রেখে আমরা মিনিট পনেরো পরে চলে যাই—যখন আবির নাক ডাকাতে শুরু করেছে, এবং মীম ভাই চোখ বন্ধ করে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। ব্যাপারটা দেখে আমার নিজেরও মনে হল, এখন যৌবন যার ঘুমোতে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়—আমিই বা নিদ্রাদেবীর বর থেকে বঞ্চিত থাকি কেন? কাজেই শুয়ে পড়লাম, এবং শুয়ে পড়ামাত্র মনে হল, এত সুন্দর বিকেলটা খামোখাই ঘুমিয়ে নষ্ট করব। কোন মানে হয়?

ভালো লাগছে, ঝপ করে গোসল করে, নামাজ পড়ে বাইরে বারান্দায় এসে যখন লিখতে বসেছি, তখন এই শহরে বিকেল নামছে।

বিকেল শেষ হওয়ার আগেই অবশ্য ওরা ঘুম থেকে উঠে পড়ল। আবির ঘুম জড়ানো চোখে বারান্দায় এসে দেখল, আমি বেশ আরাম করে পা তুলে বসে লিখে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘দাঁড়া আমারও লেখার আছে।’ একটু পর দেখি, গোসল-টোসল করে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে সেও বারান্দায় হাজির। আমি এইপাশে বসে ল্যাপটপে লিখছি, আর সে অন্যপাশে, তার ডায়েরিতে। (আচ্ছা, হাতে লিখলে বোধহয় বেশি মায়া থাকে, তাই না? ল্যাপটপে এতখানি থাকে না। আমার হাতে লেখার অভ্যাসটা থাকলে ভালো হত, এখন মনে হচ্ছে।)

মীম ভাই কিছু করার না পেয়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। ছেলেটা ভালো অবশ্য। সবসময়ই শান্ত গলায় কথা বলে। গতকাল রাতে যখন তাড়া খেয়ে স্টেশনের দিকে দৌঁড়াচ্ছিল, তখনও শান্ত গলাতেই কথা বলেছে। যেন খুবই আরামে আছে এমন ভঙ্গিতে বলেছে, ‘নোবেল ট্রেনটা কি চলে গেল? আচ্ছা যাও, আমি ট্রেনটা মিস করছি।’

আহা, গতকাল রাত থেকে কত ঘটনা ঘটেছে?

আহা, নিবারণ, নিবারণ। ভর করো নিবারণ চক্রবর্তী, ভর করো আমার ‘পরে।

সন্ধ্যা ৬:৪৯
বসেই আছি। আর এলোমেলো লিখে যাচ্ছি।

তাতে খুব একটা দোষও দেয়া যায় না। এলোকথন তো এলোমেলো লেখারই জায়গা!

গতকাল সন্ধ্যায় এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে পৌঁছে রীতিমত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আমি স্টেশনে আসি না, কখনই আসি না। শেষবার যখন ট্রেনে চড়েছিলাম তখন বোধহয় স্কুলের ছাত্র। আর স্কুলে থাকতে আমার মাথায় এতখানি সমস্যা ছিল না—কাজেই স্টেশনের ব্যাপারটা তখন ধরতে পারার কথা না। প্রায় বছরদশেক পরে গতকাল যখন স্টেশনে ঢুকলাম, রীতিমত চোখ ধাঁধিয়ে গেল। জলজ্যান্ত একেকটা গল্প চোখের সামনে ভাসছে—‘সে ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে।’

ক্লান্ত লাগছে। ঘরে ফিরে এসেছি অনেক আগেই, বিছানায় বসে লিখছিলাম। আবির এখনও লিখেই যাচ্ছে লেপের নিচে ঢুকে (শুনতে অদ্ভুত লাগছে, দোসরা বৈশাখে লেপ), মীম ভাই অন্য বিছানাটায় আরেকটা লেপের নিচে বই পড়ছে, আর আমি…আমি…ঘুম পাচ্ছে…দেখি বিছানায় রাখা একগাদা বইপত্র-কাগজকলম সরিয়ে শুতে পারি কিনা…

রাত ১১:১৪
পুরো খেয়ে দিলাম!

সন্ধ্যার পর এমনিই হাঁটাহাঁটি করছিলাম। শহরটার এক প্রান্তে বসে আমরা চা খাচ্ছি—এমন সময় জুবায়ের ছেলেটা ধরে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবার খাইয়ে দিল—একটু পরে নাকি দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

কী আর করা। তথাস্তু বলে খেতে গেলাম।

খাওয়ার পর তিনজন আবারও হাঁটা দিলাম, যতদূর যাওয়া যায়। মূলশহরের বাইরে আসার পর ভালো লাগতে শুরু করল। অন্ধকার রাস্তা, দুই পাশে ভুট্টার খেত, এবং…হাজার হাজার ব্যাঙ! চোখে দেখা যাচ্ছে না, ডাক শোনা যাচ্ছে কেবল। বলিহারি, ব্যাঙ এভাবে ডাকে?

ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না কারোরই। রাস্তার এক পাশে তিনজন মিলে বসে ছিলাম চুপ করে।

গল্প করছিলাম কি? হুম, সেটাও করছিলাম।

কাল ক্যাম্পের পিচ্চিগুলো রিসার্চের কাজ শুরু করবে। আমি এখনও ওদেরকে পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। ঢাকা শহরে জন্মেছি দেখেই কিনা কে জানে, ঢাকার পিচ্চিগুলোকে খুব দ্রুতই ধরে ফেলতে পারি। ঢাকার বাইরের মানুষদের ক্ষেত্রে সময় লাগে একটু।

খানিক্ষণ আগে রিয়া একটা কথা বলেছে—কী উত্তর দিব বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা, উত্তর না দিয়েই আমি ঘুমিয়ে যাব। 

১৬ এপ্রিল, রবিবার

বিকেল ৫:১৯
ডায়েরি খোলার সাথে সাথেই আবির-মীম ঘুম বিছানা ছেড়ে উঠলো।

যাই, বাইরে থেকে ঘুরে আসি। এই বিকেল বাসায় বসে থাকার জন্য না।

রাত ৮:৩৪
ঘরে ফিরেই আবির-মীম বিছানায়। কী মুশকিল!

এখন অবশ্য দুজন হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আবির লেপের নিচে বসে একটা বই পড়ছিল, খুব মন দিয়ে। লিখতে লিখতেই আবিষ্কার করলাম, ওটা আসলে ছবি তোলার জন্য পোজ! এই ছেলেটাকে নিয়ে কী করা যায়?

এই ডায়েরি শুরু করার আগে আবিরের আগেরদিনের লেখাটা পড়ছিলাম। মজা লাগলো—আমরা পাশাপাশি বসে প্রায় একই লেখা লিখে গেছি।

সন্ধ্যায়, খুব অদ্ভুত—টানা একগাদা মানুষ ফোন দিচ্ছিল। আচ্ছা, পরে বলি। খেতে যাচ্ছে সবাই।

রাত ১০:১৯
ভুতুড়ে। ক্যাম্পের দ্বিতীয় দিন, ক্যাম্প শেষ হওয়ার আগেই সমুদ্রে ডুবে যাওয়াটা যথেষ্ট ভুতুড়ে।

আর, ডোবার অনুভূতিটা কেমন যেন অদ্ভুত। জমজমাট একটা আড্ডার মাঝখানে তোমাকে চুপ করে বসে থাকতে হবে। এবং একটা আড্ডার মাঝখানেই চুপ করে বসে থাকতে হবে, একা একা না।

মজা লাগলো, যখন কাউকে ফোন না দিতে সন্ধ্যা থেকে একের পর এক ফোন আসতে শুরু করল। কোন কারণ ছাড়াই।

অদ্ভুত না? ঠিক এই মুহূর্তেই আজরা ফোন দিয়ে বলবে, ‘তোমাকে স্বপ্নে দেখসি, কিন্তু স্বপ্নটা ভুলে গেসি। কেমন আছো ভাইয়া?’

ঠিক আজ সন্ধ্যাতেই এই ফোনটা আসতে হত?

অথবা…অথবা আরিফের ফোনটা? তার তো ফোন দেয়ার কথা না, অন্তত যেই মুহূর্তে ওমর-লোহা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

অথবা, তটিনী…নাহ, জানি না, কিন্তু…কিন্তু, এই ঘটনাগুলোর কি কোন যোগসূত্র নেই? কোন কারণ ছাড়াই একইসাথে ঘটা কি সম্ভব ছিল?

রাত ১১:০২
গল্প বলছিল, মীম ভাই গল্প বলছিল। সব মানুষকেই বোধহয় একটা সময়ে গল্প বলার নেশাটা পেয়ে বসে। আমরা শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি—তখন ওনাদের স্কুলজীবনের প্রসঙ্গটা আসলো। ওদের পুরো হোস্টেলটা ছিল একটা পরিবারের মত। একটু কাছের মানুষ হলেই ছোটরা বড়দেরকে তুই-তুই করে ডাকছে—সুন্দর না? মীম আর ইবরাহিম ভাই যে একই ঘরে থাকত—সেটা আমি জানতাম না। এবং তারা যে ক্লাসরুমের পেছনে দুটো বিছানা পেতে সেখানেই কলেজের দুটো বছর কাটিয়েছিল—সেটাও জানতাম না! সকালবেলা ক্লাস শুরু হওয়ার আগে নাকি ইবরাহিম ভাইয়ের বাবা (প্রিন্সিপাল স্যার) এসে মৃদু গলায় ডাকতেন, ‘এই মীম ওঠো, নাস্তা খেয়ে আসো, যাও!’

মৃদু গলা শুনলেই আমার কেন যেন ট্রেনের কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে (হুম, এবং সাথে সংশপ্তকে মালুর বাবার কথাও)। ট্রেনে ঘুমাচ্ছিলাম। প্রায় সবাই ঘুমাচ্ছিল। রাত তিনটার দিকে। এমন সময় ঘুম ভাঙলো এক ফেরিওয়ালার ডাকে। মৃদু, সুরেলা গলায় ডাকতে ডাকতে যাচ্ছে, ‘মিষ্টি, রসমালাই, রসকদম…মিষ্টি, রসমালাই, রসকদম…’। রীতিমত পরাবাস্তব একটা কণ্ঠ—রাত তিনটার সময় যারা ট্রেনি ফেরি করে বেড়ায়—তারা সবাই কি এমন জাদুকরী কণ্ঠেই ডাকে?

আজও বৃষ্টি হয়েছে। সত্যি বলতে কী, ভালোই বৃষ্টি হয়েছে। যেই স্কুলে ক্যাম্পটা হচ্ছিল সেটা ভেসে মাঝখানে রীতিমত একটা পুকুর হয়ে গেছে। সেই পুকুর এতটাই বড় যে, আবির ভাই পুকুরের অন্য পাড় থেকে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলেছে।

১৭ এপ্রিল, ২০১৭

বিকাল ৫:৫০
নিরীহ মুখ করে ইউএনও অফিসে বসে আছি আমরা তিনজন।

রাগ লাগছে, এক ধরনের অসহায় রাগ। ওদিকে দিনাজপুর ম্যাথ ক্লাবের পিচ্চিগুলো সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে আছে, আর আমরা এদিকে এখনো বিরলেই আটকে আছি। ইউএনও অফিসে কিছু বলাও যাচ্ছে না, কারণ সবাই ব্যস্ত আগামীকালের প্রোগ্রাম নিয়ে।

আচ্ছা, সারাদিনের কথা বলি। আজকের দিনটা হয়তো মনে রাখা যায়, যেই সম্মানটুকু পেয়েছি সেই জন্য। জানি, আমাদের যোগ্যতা বলতে কিছুই নেই, তবু এই এলাকার শিক্ষকদের কাছ থেকে যে এতখানি শ্রদ্ধা পেয়েছি—সেটা আমাদের কল্পনারও বাইরে।

আদর্শ স্কুলের হেডস্যার একরকম জোর করেই ওনার স্কুলে নিয়ে গেলেন। চা খাওয়ানোর জন্য। ওদিক থেকে আনোয়ারুল কাদির ভাই বারবার করে খোঁজ নিচ্ছেন আমরা ঠিক আছি কিনা, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা! মুনতাসীর স্যার যে আমাদের ‘ভাইয়া’ বলে ডাকছেন—সেটা নাহয় ছেড়েই দিলাম, বাজারে যখন ঘুরছিলাম রিসার্চের কিছু জিনিস কেনার জন্য, দোকানীরা প্রায় সবাই ‘বাবা’ আর ‘তুমি’ বলে ডাকছিল—এটাও কি অনেক বেশি মন ভালো করে দেয়ার মত না?

এত ভালো কেন এই এলাকার মানুষগুলো?

গতকালের মত আজও রাহাত এসে হাজির। ওদের বাসায় নাকি আজ রাতে খেতেই হবে।

আজ রাতে কতকিছু করতে হবে?

ওদিকে ম্যাথ ক্লাবের পিচ্চিগুলো বসে আছে…আর আমরা এদিকে…

পরিশিষ্ট

আমরা যখন ম্যাথ ক্লাবে পৌঁছাই, তখন প্রায় সন্ধ্যে সাতটা! আমি ভেবেছিলাম এত দেরিতে ক্লাবে এসে বড়জোর পাঁচ-ছয়জনকে দেখব। কাজেই ক্লাবে ঢুকেই একটা ধাক্কা খেলাম—ঘরভর্তি ছেলেমেয়ে বসে আছে, আমাদের দিকে তাকিয়ে খুব হাসছে!

একবার ওখানে ঢুকলে ভালো না লাগার তেমন কোন কারণ নেই। মীম বসে বসে সুনীল পড়ছে, সোহানের হাতে জুলভার্ন, আনাস বরাবরের মতই খেপে আছে, হিল্লোল চুপ করে এক কোণায় বসে, আর নিলয় সবগুলো দাঁত বের করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

এতফি! এটা একটা পিচ্চির নাম। ‘এতফি’ অর্থ, যে সব রাগ ধুয়ে মুছে পানি করে দেয়।

আলী ভাই সম্ভবত আধ্যাত্মিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিছু মানুষের জন্মই কি হয় অন্যদের তুলে ধরার জন্য? ওনাদের নিজেদের জন্য কী থাকে? নাকি অন্য মানুষের প্রাপ্তিতেই ওনাদের শান্তি?

ও আচ্ছা, সোমলতা, রনি, আসিফ—ওরাও ছিল।

এই মানুষগুলোর মাঝখানে এসে দাঁড়ালে ভালো না লাগার কোন কারণ নেই।

আবারও ঘুম পাচ্ছে...

দিনাজপুরের ঘটনাটুকু শেষ হয়েছে আরেকজন মানুষকে দিয়ে—রাহাতের মামা। প্রথমে ভেবেছিলাম ওনার কথা এখানেই লিখব...পরে মনে হল, উনি কোন গল্পের অংশ না, উনি নিজেই একটা গল্প...

কাজেই, কোনদিন যদি সুযোগ হয়…

আপাতত এটুকুই...