এলোকথন (অশ্বিনী ২৪:৩)

লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ।

আজকাল লেখার ইচ্ছেটা আসে ছাড়াছাড়াভাবে। ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক না, কারণ আমি কাজ করতে করতে মারা যাচ্ছি। জানি না, হয়তো সাতসকালে উঠে দৌঁড়ে বাসা থেকে বের হই। ভার্সিটিতে যতক্ষণ পারি ক্লাসনোট তুলি। যেদিন টানা পাঁচটা ক্লাস থাকে সেদিন শেষ ক্লাসটুকুতে সবাই কলাপ্‌স করে। মাথা আছড়ে বেঞ্চে পড়ে যায়। আমি চারদিকে তাকাই, দেখি সবাই মরে যাচ্ছে, অথবা গেছে, সেই কবে! কনকের মত দু-একজন তবু বেঁচে থাকে, নিলয়ের মত দু-একটা পাগল এখনো স্বপ্ন দেখে, তবু বাকিরা তো মরে গেছে। আমি নিজেও কলাপ্‌স করি কখনো, বেঞ্চে মাথা রেখে আক্ষরিক অর্থেই স্বপ্ন দেখি। গত কিছুদিন যেসব স্বপ্ন দেখেছি—তার মাথামুণ্ডু কিছুই নেই। একদিন দেখলাম, মুনির স্যার এসে কংগ্রেসের এক্সপেরিমেন্টের জিনিসপত্র সব ফেলে দিয়েছেন। আমার বড় ভয় হয়, আমি একদিন এসব স্বপ্ন দেখে ক্লাসেই চিৎকার করে জেগে উঠবো। কায়কোবাদ স্যার এসে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বলবেন, ‘ইউ আর সো স্মার্ট, ক্লাসে ঘুমোলেই তোমার পড়া হয়ে যায় তাই না?’

ক্লাস থেকে বেরিয়ে দৌঁড়ে অফিসে যাই, এবং আবারও কাজ শুরু করে দেই। আগ্রহের সাথেই করি, সুতরাং কাজের মাঝে ডুবে থাকলে টের পাই না চারপাশে কী ঘটছে। আমার চেতনা ফিরে আসে সবকিছু শেষ হবার পর, এবং তখন মনে পড়ে, সারাদুপুর কিছু খাইনি, খিদেয় রীতিমত অজ্ঞান হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, আমি ক্লান্ত হয়ে যাই, অনেক কষ্টে লিফটে উঠে পদ্মদের বাসায় গিয়ে হাজির হই।

আবারও বাসার প্রসঙ্গ চলে আসলো। get back home, আমরা তো ঘুরেফিরে কেবল বাসাতেই…মানে, দিনশেষে একটা আশ্রয়ে এসে দাঁড়াতে চাই। একটুখানি মমতা, সামান্য একটু মমতার আশায়। পদ্মরা বাসায় নেই দেখে আমি সেদিন ফিরে আসছিলাম। নানু জোর করে আটকে রাখলো। জোর করেই চা খাওয়ালো—মগ ভর্তি চা (কারণ আমি ওভাবেই খেতে ভালোবাসি)। সেই চা-টাও আবার উনি নিজেই বানালো, মামুন ভাইকে বানাতে দিলো না।

খিদের কথা বলছিলাম না? সেদিন একটু বেশিই খিদে পেয়েছিল বটে, আমি বোধহয় পাগলের মত বিস্কুট খাচ্ছিলাম। তাই দেখে নানু চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তোমার খুব খিদে পেয়েছে তাই না? দাঁড়াও’—এই বলে আরও কী কী যেন বের করে আনলো—আমাকে ওসব খেতে হল।

সেটা কখন? সেটা অনেক অনেক রাত, আরেকটা ক্লান্ত রাত। এই যেমন, আজ যখন সুরভী আন্টির সাথে বসে সামনের প্রোগ্রামটার প্ল্যান করছি, তখন প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। আন্টি, আমি—দুজনেই অসম্ভব ক্লান্ত। তবু কী যেন একটা মায়া কাজ করে আমাদের ভেতরে, কাজেই আমরা সোজাই দাঁড়িয়ে থাকি, এবং চাঁদে পাওয়া মানুষের মতই কাজ করতে থাকি। যেই বিন্দুতে এসে আর দশটা মানুষ ধসে পড়ে যায়—ঠিক সেই বিন্দুতেই সেঁজুতি হাসতে হাসতে খেলতে পারে। যেই লোভে পড়ে আর দশটা মানুষ নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়—সেটাকে অগ্রাহ্য করে মোজো এসে অফিসে বসে থাকে—এটাও কি এই মায়ারই একটা অংশ না?

এই ছেলেমেয়েগুলো আছে দেখে আমি এখনো ভরসা পাই। এক পা আগানোর পর আরেক পা এগোতে ইচ্ছে করে।

কিন্তু, কেজো বাড়ির পাশে মেজো বাড়ি, আমরা তবু রোদ্দুর কাড়ি।

সেই যে বলছিলাম, দিনশেষে আমার নিজের সত্ত্বাটাকে তো বিসর্জন দিতে পারি না।

দিনশেষে আমার এক এক করে ফ্ল্যাশব্যাক হতে থাকে। অদ্ভুতভাবে ঘটনাগুলো মনে পড়ে যায়। আমি হিসেব মেলাই—আজ আমি আকিবকে ফোন দিয়েছি, এবং হ্যাঁ, ছেলেটাকে একবারও জিজ্ঞেস করিনি তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছে। কাজের কথা শেষ হওয়ামাত্রই ফোনটা কেটে দিয়েছি, কারণ আমার তখন অফিসে অসংখ্য কাজ করা বাকি। আরিফ, তটিনী—সবাই ফোন দিচ্ছিল, আমি নির্মম ভঙ্গিতেই বলেছি, কাজ করছি, সেই ভঙ্গি শুনে কাজ করতে করতেই তামান্না হেসে ফেলেছে, এবং আমি নির্বিকার ভাব করে পরমুহূর্তেই কাজে নেমে পড়েছি, এবং সত্যিই, পরমুহূর্তেই আমি ভুলে গেছি তাদের অস্তিত্ব।

এটা অবশ্যই ‘আমি’ না। এবং এটা সেই ‘আমি’—যার আশঙ্কা হয়তো সবাই করেছে একটা সময়ে। আবির আমার ছবি আঁকার খাতায় লিখেছে, যেন কখনো বদলে না যাই, রিয়া তার ব্লগে লিখেছে, এ্যানি মেইল করেছে যেন না বদলে যাই—এবং আমি ঘুরেফিরে আশ্চর্য হয়েছি, কারণ রিয়ার জানার কথা না আবির আমাকে এই কথাটা বলেছে, কিংবা এ্যানির জানার কথা না রিয়া বলেছে, কাজেই আমি ধরে নিয়েছি যে, তারা আলাদা আলাদাভাবেই আমাকে নিয়ে একই চিন্তা করেছে, হয়তোবা একই আশঙ্কা থেকে—যদি কোনোদিন আমি বদলে যাই!

ক্যাট স্টিভেন্‌সের সেই গানটার মত?

“If I ever lose my eyes
If my colours all run dry
If I ever lose my eyes
Oh if…I won’t have to cry no more.”

সত্যি বলি, আমারও না, বিষম ভয় হয়—যদি কোনোদিন ঘুম ভেঙে দেখি, আমার আঁকতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আমার হারমোনিকাটায় সুর তুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আমার কিচ্ছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আমার মন খারাপ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না, রিয়ার অকারণ বকবক শুনে ‘মেয়েটা পাগল একটা’ বলে বিড়বিড় করতে ইচ্ছে হচ্ছে না, যদি কোনোদিন, যদি কোনোদিন, হতেই পারে, একদিন ঘুম ভেঙে দেখবো আমার রাস্তায় হাঁটতে ইচ্ছে হচ্ছে না, অকারণে ছাদে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না, এত বড় বড় মেইল লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না…তখন?

যদি দেখি, সারা পৃথিবীতে কেবল কাজ আর কাজ?

যদি দেখি, আবিরের সাথে আমি কেবল কাজকর্ম নিয়েই কথা বলছি, অথচ বলছি না যে, কেন প্রতি সেপ্টেম্বরে আমাদের খানিকটা অস্বস্তি লাগতে শুরু করে?

আমার ভয় হয়, আমার বড় ভয় হয়।