এলোকথন (অশ্বিনী ২৪:৪)

আজ বেশ ক’দিন হল, আব্বু বাসায় নেই।

আব্বু বাইরে গেলে আমরা বড় একটা টের পাই না। ছোটবেলা থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। ব্যাপারটা মোটেও আশ্চর্যের না, কারণ আব্বু যখন দেশে থাকে, তখনও তার সাথে খুব একটা দেখা হয়—এমনটা দাবি করা যাচ্ছে না। একই বাসায়, একইসাথে থেকে কেন আব্বুর সাথে নিয়মিত দেখা হয় না—এটাই বরং আশ্চর্যের।

সেই ছোটবেলা থেকে দেখি, সকালবেলা উঠে আব্বু দৌঁড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, অফিস আছে। কিছু মানুষ থাকে না, কাজপাগল ধরনের? অমন একটা মানুষ। অফিসে গিয়ে সে জ্যান্ত মানুষের মতই কাজ করতে থাকে, ঝিমায় না। বরং আমি আস্তে হাঁটলেই উল্টো ধমক দেয়, ‘আই এ্যাম সিক্সটি ইয়ার্স ওল্ড, আমি পারলে তুমি পারবা না কেন?’

সক্কালবেলা বেরিয়ে ফেরে বিকেলবেলা। (ঘুমটা কি বেশি পেয়েছে? আসলে আব্বু তো ফেরে রাত এগারোটায়। একটা ঘোরের মধ্যে লিখতে গিয়ে ‘বিকেল’ লিখে ফেললাম।) যাকগে, আব্বু ফেরে রাত এগারোটায়। এবং তখনও জ্যান্ত মানুষের মতই বাসায় ঢোকে, আর যদি বাসায় দাদু থাকে, তবে তো কথাই নেই, কে বলবে রাত এগারোটার বেশি বাজে, এবং এই বাসায় সবচেয়ে ছোট মানুষটার বয়স বাইশ? আব্বু আর দাদু মিলেই ছোটদের অভাব পূরণ করে দেয়—রীতিমত উৎফুল্ল ভঙ্গিতে দুজন গল্প করতে থাকে। বহুবার এমন হয়েছে, দাদুর সাথে আব্বুর গল্প করার ভঙ্গিমা শুনে আমরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়েছি একেকজন।

রাতের খাবার আমরা আব্বু আসার পরেই খাই, এবং খাবার পরেই কেবল সে খানিকটা ক্লান্ত হয়। খবরে বিশেষ কিছু দেখালে চোখ বড় বড় করে দেখে, নয়তো ঘুম ঘুম চোখে টিভির সামনে বসে থাকে।

বসে থাকি আমিও, বারোটার খবর দেখার জন্য। বারোটা বাজার খানিক্ষণ আগে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে আসি, আব্বুর সাথে গম্ভীর ভঙ্গিতে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকি। বড় হওয়ার পর আজকাল…জানি না, ষোড়শ বর্ষে পুত্র মিত্রবদাচরেৎ হবার কথা, বানান ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু আমি মিত্র হতে পারিনি, কিংবা সেই সুযোগ ঘটেনি। কাজেই কথা বলার সময় অনেকখানিই সংকোচ কাজ করে আমার। তবু, মাঝেমধ্যে আব্বুর সাথে দু-চারটে কথা বলে ফেলি খবর দেখার সময়।

আমার আসলে এই নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

তবু ভাবছি, এটা কি চিরন্তন সত্যগুলোর মত একটা সত্য? এ বছর এইচএসসির রেজাল্টের পর একজনের কাছে শুনছিলাম তার আব্বুর কথা। ঘুরেফিরে আমাদের সবার অতীত কীভাবে যেন মিলে যায়, ওরটাও যাচ্ছিল। যেই মানুষটাকে কেউ ভয় পায়—তার কাছ থেকেই যখন একরাশ ভালোবাসা এসে হাজির হয়—তখন সবকিছু কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে।

আমার আসলে এই নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।