এলোকথন (কৃত্তিকা ২৪:১)

এক.

কিছুক্ষণ আগে একটা হুমকি পেয়েছি।

চুপচাপ বসে ছিলাম। হঠাৎ করেই ধমকটা খেলাম। আজ রাতেই কিছু একটা না লিখলে আমি নাকি শেষ! শ’খানেক মাইল দূরে বসে এত সহজে হুমকি দেয়া যায়—কে জানতো।

কী আর করা। যা মনে আসে, লিখে ফেলি।

সমস্যাটা হল যে, মনে অনেক কিছুই আসে। সেই যে, words are flowing out like endless rain into a paper cup. কাজেই লিখতে গিয়ে বারবার দ্বিধায় পড়তে হয় আমাকে।

গত কয়েক সপ্তাহে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমার আফসোস হচ্ছে যে, আবারও ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে আমার। যদি থাকতো, তবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে যেত। এমনও তো দিন গেছে, লেখার তোড়ে রীতিমত আমার হাত কাঁপতে শুরু করেছে—শব্দগুলো যেন মাথাতেও আনার দরকার হচ্ছে না—চিন্তা থেকে সরাসরি আমার আঙুলে চলে যাচ্ছে, আর আমি লিখে ফেলছি।

কে জানে, হয়তো সামনেই অমন দিন আবার আসবে।

আজ অথৈ ফোন দিয়েছিল, অনেকদিন পর। প্রায় প্রতিদিনই ভাবি, পিচ্চিটাকে ফোন দিব। সেই কবে একবার সঞ্জীবের একটা গান শুনতে বলেছিল, সেই কথাটুকুর উত্তর না দিয়ে আমি যে ডুব দিলাম, আর খোঁজ নেই।

অথৈ ফোন দিয়ে প্রথমে এই কথাটাই জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায় হারিয়ে গেছি।

আমি কী উত্তর দিয়েছি—ঠিক মনে পড়ছে না। তবে হারিয়ে যে গেছি—এতে সন্দেহ নেই।

দিনগুলো বড় কেজো হয়ে যাচ্ছে। কাজ, এবং কাজ। ডুবে যাচ্ছি কাজের মধ্যে। এগুলো ছাড়া বাঁচতেও পারতাম না আমি, তবে এত বেশি দ্রুতগতি, ‘ছুটছে মোটর ঘটর ঘটর চলছে গাড়ি-জুড়ীর’-র মত অকারণ তাড়া—এসবের ওপরে খানিকটা বিরক্ত লাগছে। আমার জন্ম দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্‌-এর জন্য। মোটরে চড়ে ছোটার জন্য না।

তবু, মোটরে চড়তে হয়। কেবল দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্‌ গেয়ে দায়িত্ব শেষ করা যায় না।

দুই.

যাকগে এসব কথা।

সন্ধ্যা থেকে পড়াটড়া বিশেষ হয়নি আজ। বাসায় কী যেন রান্না হয়েছিল, আম্মু বলল ভাইয়াদের বাসায় দিয়ে আসতে। তাই নিয়ে গেলাম ওখানে।

বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ পদ্ম ফোন দিয়ে চেঁচামেচি শুরু করল। আমি সেদিন যে তাকে এত্ত বড় চকলেটের বারটা দিয়ে আসলাম—সেটা নাকি আন্টি ডাকাতি করে গপগপ করে খেয়ে ফেলেছে!

আমার হাসতে হাসতে রীতিমত বিষম খাওয়ার অবস্থা। পদ্মকে বললাম, ‘আন্টিকে দে, বকে দেই।’ আন্টি ফোন ধরেই উল্টো বকে দিল। আমরা নাকি নানুর জন্য ফুল আর পদ্মর জন্য চকলেট নিয়ে যাই, আন্টির জন্য কিছু নেই! কাজেই ডাকাতিই ভরসা।

কী আর করা, আন্টিকে সমর্থন দিতেই হল। আসলেই তো, ডাকাতি না করলে চকলেট পাওয়ার উপায় তো দেখছি না।

পদ্ম ফোন দেয়ার ঘণ্টাদুয়েক আগে আন্টি নিজেই ফোন দিয়েছিল। তখন নাকি দুজনের মারামারি-পর্ব এবং এরপরে পদ্মর গাল ফুলিয়ে বসে থাকা কর্মসূচি চলছিল।

তিন.

আমার খুবই ঘুম পাচ্ছে আসলে। লিখতে লিখতেই মনে হচ্ছে উল্টে যাবো।

তাতে সমস্যা নেই কোন, কারণ গত কিছুদিনে হিজিবিজি হিজিবিজি অনেক কিছু লিখেছি। সেগুলো এক এক করে তুলে দেয়া যায়।

চার.

[এটা হিজিবিজি এক। বরিশাল থেকে ফেরার সময় লঞ্চে বসে লেখা।]

এই মুহূর্তে আমি আর আকিব বসে আছি কীর্তনখোলার ঠিক মধ্যখানটায়।

এই পাশে বসে আমি লিখছি। আকিব ছেলেটা অন্যপাশে বসে একটা ফোন নিয়ে মৃণ্ময়ের সাথে বকবক করে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা উপেক্ষা আমার গম্ভীর মুখে লেখা উচিত ছিল। আকিবের কথার তোড়ে গম্ভীর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বারবার ফিক করে হেসে ফেলতে হচ্ছে।

তবু, অনেক কথা মনে পড়ছে। একের পর এক।

গত দুদিন টানা বৃষ্টি হয়েছে, কীর্তনখোলায় প্রচণ্ড স্রোত আজ। লঞ্চটা বেশ ভালোই দুলছে।

জলযান নিয়ে যেহেতু ভীতি আছে, ভয় পাওয়া উচিত ছিল আমার।

আমার ভয় লাগছে না। বেশ ভালো লাগছে।

অনেক আগে, কী মনে করে যেন বলেছিলাম, ‘ভালো লাগা’ মানে নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ না। একইসাথে আনন্দ, দুঃখ, মায়া, এমনকি নস্টালজিয়া—অর্থাৎ সবকিছু।

রিফাতের ধারণা, আজকের দিনটা ঘুরেফিরে ভিভা লা ভিদায় এসে ঠেকছে।

কথাটা সত্যি হলেও হতে পারে। বিকেল থেকে যখন এলোমেলো ঘুরছিলাম, ছেলেটা একটু পরপরই আনমনে ভিভা লা ভিদা গাইছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, গানটা কি মাথায় ঢুকে গেছে?

রিফাত হেসে ফেলল। বলল, গানের সলোটা মাথায় ঢুকে গেছে।

শুধু হেসেই সন্তুষ্ট থাকলো না, আমাকে প্রায় জোর করেই গানটা আবার শোনাল।

লঞ্চটা এত বেশি দুলছে যে, আমার শাহাদুজ্জামানের একটা লেখা মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। কোন একটা লেখায় তিনি বলছিলেন, নাইন ইলেভেনের সময় যখন নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে থাকা মানুষগুলো বুঝতে পারল তারা মরে যাচ্ছে, তখন শেষমুহূর্তে প্রায় সবাই প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করেছিল। কেউ ফোন দিয়েছে। কেউ মেসেজ। সবাই বলছিল, ভালোবাসি।

মরে যাওয়ার আগমুহূর্তে আমাদের শেষ চিন্তাটুকু কী এখানেই এসে ঠেকে? ভালোবাসি!

সবক্ষেত্রে কিন্তু তা-ও না। শাহাদুজ্জামানই লিখছিলেন, বাংলাদেশের কোথায় যেন ঠিক এমন একটা ঘটনা ঘটল, তখন মৃত্যুর আগমুহূর্তে মানুষগুলো ফোন দিয়ে বলছিল, আমাকে ক্ষমা করে দিও।

দুটো ভিন্ন জায়গায়, দুটো ভিন্ন সময়ে কি মানুষের দর্শন এতখানিই আলাদা হয়?

স্ট্যাটিসটিক্‌স কথা বলে। সে অনুসারে মৃত্যুর আগমুহূর্তে আমার ‘ক্ষমা কোরো’ জাতীয় কথা বলা উচিত।

কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে, আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে না।

এমনিই মনে হল আমার, নৌকাডুবি যদি হয়েই যেত, তবে শেষ কথাগুলো কাদের সাথে বলতাম?

আমার ধারণা, যে দু-চারজনের সাথেই হোক না কেন, ওদের বলতাম, ভালোবাসি।

যাকগে এসব কথা। এই কথাগুলো লিখছিলাম লঞ্চের কেবিন অন্ধকার করে। আকিবের নাকি মনে হচ্ছিল, এই ঝড়ের রাতে ঘরটা অন্ধকার করেই আমাদের গান গাওয়া উচিত।

পাঁচ.

[হিজিবিজি দুই। বরিশাল থেকে ফিরে সেই সকালে লেখা। ঘুমিয়ে যাবার আগমুহূর্তে।]

গতকাল রাত থেকে কেবলই লিখে যাচ্ছি, অল্প অল্প করে।

আজ ভোরে যখন ঢাকায় ফিরলাম, এই শহরের আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। সদরঘাট থেকে বেরিয়েই একটা বাস পেয়ে গেলাম, কাজেই আমি আর আকিব হুড়মুড় করে সেখানে ঢুকে পড়লাম। ততক্ষণে অবশ্য যথেষ্টই ভিজে গেছি। ভিজে চুপসে গেলাম আরেকটু পরে। যখন বাসটা আমাদের শাহবাগে নামিয়ে দিল। আকাশভাঙা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলে অবশ্য এ-ই হওয়ার কথা।

নিজের ইচ্ছায় বৃষ্টিতে ভেজা যথেষ্ট আনন্দের একটা ব্যাপার, কিন্তু কেউ যখন শুকনো থাকতে চায় তখন ভিজে জবজবে হয়ে যাওয়া খুব একটা সুখকর ব্যাপার না।

তবু,

রাস্তাগুলো…

গতকাল রাত থেকে কেবলই বিভ্রম হচ্ছে, বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তাগুলোকে আফ্রেমভের ছবির মত লাগছে। তুমুল বৃষ্টির এক পর্যায়ে রাস্তাগুলো ঝাপসা আয়নার মত হয়ে যায়। বড় মায়া লাগে দেখতে। এমনকি পৃথিবীর যা কিছু অসুন্দর—সেসবও সেই ঝাপসা আয়নায় বাধা পেয়ে সুন্দর হয়ে ফিরে আসে।

ছয়.

[হিজিবিজি তিন। ঢাকায় বসে লেখা, গত সপ্তাহে সম্ভবত।]

মায়া, মায়া।

এই মমতাই আমাদেরকে খেল।

বরিশাল থেকে আমরা যে রাতে ঢাকায় ফিরছিলাম—সে রাতে বেশ ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত একটার দিকে রিফাত পাগলটা বলল, লঞ্চের কেবিনে বসে ভালো লাগছে না, বাইরে বের হবে। মাথায় গামছাটা জড়িয়ে একেবারে লঞ্চের সামনে গিয়ে বসে পড়ল। খানিকক্ষণ পর বের হয়ে দেখি, প্রচণ্ড বাতাস, আর তার মাঝে বসে ছেলেটা গলা ছেড়ে গাইছে। এই ঝড়ের রাতে এসে মেঘনাও যেন দ্বিধায় পড়ে গেছে। একের পর এক ঢেউ এনে ধাক্কা মারছে, যেন বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছে, সবকিছু ওলটপালট করে দিবে কিনা।

রিফাতের মতে, নদীটা আমাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। নদীগুলো সবার মা, অথচ তার সাথেই নাকি আড্ডাটা জমে বেশি।

আমি আর ছেলেটাকে বললাম না যে, এই নদীগুলো, শহরের রাস্তাগুলো, চায়ের দোকানগুলো—সবাই আড্ডা দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। আমরা কেবল কথা বলতে জানি না দেখে। যদি দুটো সেলফি তুলেই একটা শহরকে ছেড়ে দিয়ে আসি—তবে কথা বলব কীভাবে?

কাজেই আমার অসম্ভব মজা লাগল, যখন বরিশালের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে রিফাত ছেলেটা প্রায় সবার অজান্তেই মাটিটুকু স্পর্শ করল। কী যেন বিড়বিড় করে বলছিল, পুরোপুরি মনে নেই। এই ঘাস, এই মাটি একবার হাত দিয়ে স্পর্শ না করলে শহরটাকে চেনা বাকি থেকে যাচ্ছে—এমন কিছু একটা বলছিল বোধহয়।

ঠিক সপ্তাহখানেক আগে তটিনীও একই কথা বলছিল আমাকে। গত উনিশ বছর ধরে আমি যেই রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি—সেখানে এসে। বলছিল, খালি পায়ে না হাঁটলে রাস্তাটাকে চেনা যাচ্ছে না...

আচ্ছা, আমার সাথে ঘুরেফিরে ঠিক এই মানুষগুলোর দেখা হয়ে যায় কীভাবে?

আমরা যেমন বলি, শহরও আমাদের সাথে কথা বলে। বলতে বলতে একটা মায়ায় আটকে ফেলে।

সাত.

[হিজিবিজি চার। ঢাকা। বরিশাল থেকে ফেরার পর।]

আমার জন্ম শহরে, বেড়ে ওঠাও এই শহরে। কাজেই পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আমি একটা শহরমানব।

সমুদ্র আমাকে টানে, কিন্তু একটা ছোট্ট শহরও যেই মমতাটুকু দিয়ে জড়িয়ে ধরে—তার সমান মমতা পৃথিবীর সব সমুদ্র মিলেও দিতে পারে না।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, যেই সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ থেকে ফিরছিলাম, সেদিন অনেকখানিই বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেমানুষী একটা ইচ্ছে হচ্ছিল শহরটায় থেকে যাওয়ার। মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, অথচ সেটার কোন দরকার ছিল না। কেবল একটা ইচ্ছে ছিল, সেই জায়গাটুকুতে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার।

আমি একটা মেইল পেয়েছিলাম সেই রাতে।

সেই শহরটারও ইচ্ছে ছিল আমাকে ধরে রাখার।

ব্যাপারটা কী অদ্ভুত না? শহরটা এক দিনেই আমাকে বেঁধে ফেলেছিল, আমি নিজেও আটকা পড়তেই চেয়েছিলাম, অথচ সব ভেঙেচুরে বেরিয়ে আসলাম।

জন্মগতভাবেই প্রতিটা মানুষের মধ্যে একজন দার্শনিক বাস করে, কিন্তু দিনেদিনে যুক্তি আমাদের গ্রাস করতে থাকে। যুক্তির কাছে আমরা অসংখ্যবার পরাজিত হই। আমরা বাধ্য হই সবকিছু ভেঙেচুরে বাস্তবে ফিরে আসতে।

আট.

[হিজিবিজি পাঁচ। হুম ঢাকা, মনে হয় গত সপ্তাহ।]

বরিশাল থেকে ফেরার সময়টুকু ঘুরেফিরে মাথায় আসছে বারবার। রিফাত বলছিল শূন্যতার কথা। বলছিল, ফিরতে ইচ্ছে করছে না।

কোন কারণ নেই আসলে।

এ্যানি নির্ঘাত ঠাট্টা করে বলবে, সেই শহরের কাউকে ভালো লেগে গেছে!

কিন্তু আমি জানি, এই শূন্যতার জন্ম অন্য কোথাও।

সেই যে, ‘হঠাৎ ফিরে দেখি, নিজের মুখোমুখি—শূন্য, ভীষণ শূন্য মনে হয়’—অমন কিছু একটা।

প্রতি বছর জগদীশ বসু ক্যাম্প শেষ হওয়ার পরেও এই অনুভূতিটা হয় বটে, কিন্তু সেটার কারণ আলাদা। সত্যি বলতে কী, সেই বোধের সাথে আর অন্য কিছুর তুলনা করা মুশকিল, কেননা জগদীশ বসুর চারদিনে আমাদের যেই পুনর্জন্মটুকু হয়—সেটা এখন আর কোথাও সম্ভব না। আর কোথায় কে বলবে, ‘এক কোটি বছর হয়, তোমাকে দেখি না!’

কাজেই, এই যে বরিশাল থেকে ফেরার আগমুহূর্তের ছেলেমানুষীটুকু—সেটাকে আমি কেবল শূন্যতা নামেই ডাকতে চাই।

শূন্যতারও নাকি একটা ভাষা আছে।

কে বলেছিলেন এটা? শঙ্খ ঘোষ?

কেবল শহরের কথাই তো না, শূন্যতার কথাও তো কেউ কেউ শুনতে পায়। রিফাতও পেয়েছিল বুঝিবা। নাহলে কেন বরিশাল থেকে ফেরার আগমুহূর্তে সে লঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে?

আকিব আর রিয়াদ যেতে চাচ্ছিল না। কে-ই বা যেচে ঠাণ্ডা লাগাতে চায়। শেষে রিফাত মৃদু গলায় বলল, কেউ না গেলেও আমাকে বেরোতে হবেই।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, চল।

দেখি যে, এক এক করে আকিব, রিয়াদও বের হল।

টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা রাস্তায় নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই রীতিমত আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। আকিব তাড়াহুড়ো করে কোথায় যেন মাথায় গুঁজলো। গুঁজে আবার ভাই-ভাই-আসেন-আসেন বলে হাঁকডাকও শুরু করল। রিয়াদ কোথায় ছিল খেয়াল করিনি।

কিন্তু রিফাত…রিফাত তখনও নির্বিকার ভঙ্গিতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে।

এবং, হয়তো আশ্চর্য না যে, কিছুক্ষণ পর আকিবও রাস্তায় নেমে এল। আসলেই, পাগলামো কি আসলেই গ্র্যাভিটির মত?

আরও কিছুক্ষণ পর, যখন আমরা ভিজে কাক হয়ে গেছি, ঠাণ্ডা বাতাসটা গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে, তখন আমার পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। এটা অক্টোবর না? হুম, সেই ঘটনাটাও বছর দুয়েক আগের এক অক্টোবরের।

দুই বছর আগের লেখাটুকু হুবহু তুলে দেই এখানে?

And it was all yellow.

আমার চশমার পাওয়ার ভয়াবহ। আট সাড়ে আট বোধহয়। একটা সময় এই নিয়ে যথেষ্ট মনটন খারাপ হত। But.…now I see the funny side. বেশ কয়েকদিন আগে, বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। কার কাছ থেকে যেন কয়েকটা কাঠগোলাপ পেয়েছি, সেগুলো হাতে নিয়ে। শহীদ মিনারের সামনের রাস্তাটা যখন পার হচ্ছি, রাস্তার মাঝখানে এসে বুঝতে পারলাম, চশমা ভিজে পুরো ঝাপসা হয়ে গেছে, এটা এখন মোছা লাগবে। চশমা খুললাম, এবং সাথে সাথেই সেই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা বের করে ফেললাম— এই বিশাল রাস্তায় আমি একাই দাঁড়িয়ে আছি! মানে, উপরে ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝরছে, আর নিচে আমি তিন-চারটা কাঠগোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে। একা। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত। ক্লাস এইটের একটা ছেলে ভালোবাসার প্রস্তাব পেলে যেমন বোকার মত তাকিয়ে থাকে, সেরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে।

বহুদিন, বহুদিন কারো মুখে একটা কথা শোনা হয় নি। শেষ পর্যন্ত আমাকে একজন গাঢ় আকাশটা দেখতে বলেছিল, বৃষ্টির অপেক্ষায় বসে থাকা গাঢ় ছাই রঙের আকাশ।”

স্মৃতিটার পুনরাবৃত্তি করতেই আমি চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিলাম।

রাতেরবেলা ঝাপসা শহরটা যে এত সুন্দর দেখাবে—কে জানতো! প্রায় সাত পাওয়ারের চশমা খুলে নেয়ার কারণে আলোর উৎস ছাড়া কোন কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায় না। কাজেই মনে হয়, চারপাশে ঝলমল করে অনেকগুলো আলো জ্বলছে কেবল। আর নিচের রাস্তায় তার চেয়েও ঝাপসা আলো প্রতিফলিত হয়ে আসছে।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, আফ্রেমভের কোন এক ছবির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি…

নয়.

[হিজিবিজি ছয়। ক’দিন আগে লেখা বোধহয়।]

খাপছাড়া, এলোমেলো কথাবার্তা লিখে যাচ্ছি।

আমি মাঝেমধ্যেই ভাবি, এই যে আবর্জনাগুলো লিখি প্রতিনিয়ত, এগুলো নিয়ে কী করা যায়। হাতে যেসব লিখেছি—তার প্রায় সবই ছিঁড়ে ফেলেছি। গত শীতে এমনও হয়েছে, কোন এক সন্ধ্যায় ল্যাবটেস্ট শেষ করে বের হয়েছি, ব্যাগের মধ্যে লেখাগুলো ছিল তখন। ল্যাবটেস্টের দিতে দিতেই ভাবছিলাম, পরীক্ষাটা শেষ হলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ব, আর সবকটা লেখা ছিঁড়ে আকাশে উড়িয়ে দিব।

এবং করেওছি। দারুণ শীত ছিল সেই সন্ধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওদিকে যেহেতু লোকজন কম, ঠাণ্ডাটা আরও বেশি লাগছিল।

জানি না কেন, এইসব শীতের রাতে অনেকখানি নস্টালজিয়া এসে ভর করে। এতখানিই ভর করে যে, আমি একটা ঘোরের জগতে চলে যাই। হয়তো সেজন্যেই, সেই রাতে উদ্‌ভ্রান্তের মত হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাঝখানে চলে গিয়েছিলাম। লেখাগুলো কুচিকুচি করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। প্রায় সাইকিডেলিক একটা অনুভূতি—রাতের আকাশজুড়ে কাগজের টুকরো উড়ছে, তোমার চারপাশে, আর বৃষ্টির ফোঁটার মত একটা-দুটো করে টুকরো নেমে আসছে।

কিন্তু, যেই লেখাগুলো হাতে লেখা হয়নি—সেগুলো?

দশ.

[হিজিবিজি সাত। হুম, ক’দিন আগেই লেখা।]

আজ সন্ধ্যার একজন ভালো মানুষের সাথে দেখা হয়েছে আমার।

পরিশিষ্ট.

নে, এবারে প্রাণভরে পড়।

এলোকথন, অর্থাৎ যার মাথা নেই-মুণ্ডু নেই। এগুলো পড়ে লাভ আছে কোন? এই সময়টুকু ঘুমোলেও ঢের বেশি কাজে দিত না?

যতসব পাগলের দল!