কাকচক্ষু বুড়িগঙ্গা

আমার মাঝেমধ্যে সমুদ্রে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। 

আমি বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই। অন্ধকার ঘরে বসে, রৌদ্রোজ্জ্বল রাজপথে দাঁড়িয়ে, দুঃখতম দুঃখের ভেতরে আমি প্রবল বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই। 

এবং আমার ইচ্ছে করে সমুদ্রে ডুবে যেতে। সমুদ্রের গভীর, সুস্বাদু অন্ধকারে এক ঘাস হয়ে জন্মাতে। 

আমি রক্তের কথা শুনি। আমি রক্ত দেখি। একসময় আমি অন্ধ হয়ে যাই, পুরো পৃথিবীর গায়ে লেগে থাকা ছোপ ছোপ রক্ত আমাকে অন্ধ করে দেয়, আমি চিৎকার করে চোখ থেকে রক্ত মোছার চেষ্টা করি। 

আমি গাড়লদের রাস্তার ড্রেনের পাশে বসে মাথার খুলিটা খুলে ফেলতে দেখি। ড্রেন থেকে আবর্জনা তুলে তুলে মাথায় ভরতে দেখি। আমি দেখি তাদের হা হা করে মানুষের দিকে তেড়ে যাইতে, মানুষের বাচ্চার দিকে তেড়ে যাইতে। আমি দেখি তাদের মানুষ চাবায়ে খায়ে ফেলতে, আমি শুনি তাদের— 

না, এরপর আমি আর শুনতেও পারি না, কেননা আমার মনে হয় আমার সারা গায়ে কালি লেগে গেসে। 

স্কুলব্যাগ ঘাড়ে একটা পিচ্চিকে দেখলে আমার অথৈয়ের কথা মনে পড়ে, কিংবা কে জানে, হয়তো ফারহার কথাই মনে হয়, কিংবা হতে পারে সেটা রাহাত, হয়তো সৌমিক। ফলে বছরের একেকটা সময় পত্রিকা খুলে আমি আতঙ্কে অধীর হয়ে যাই, ঘরে-বাইরে আশ্চর্যরকম ছটফট করতে থাকি। 

প্রতিদিন অথৈ মরে, প্রত্যেকটা দিন সৌমিক মরে পড়ে থাকে। ছোপ ছোপ কালি আমার সারা গায়ে লেগে যায়, আমি পাগলের মত ঘষে ঘষে সেই কালি মোছার চেষ্টা করি, এবং একসময় আমি অন্ধ হয়ে যাই, পুরো জগতটা আমার সুলেখার চাইতেও কালো কালিতে ঢেকে যায়। 

চ্যাপলিনের মত জীবনকে ক্লোজআপের ট্র্যাজেডি আর লং শটের কমেডি হিসেবে আমি দেখতে পারি না, কেননা লং শটেও ফারহা-রাহাতের মৃত্যু, আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু আমার চোখে ট্র্যাজেডি হিসেবেই আসে। ফলে আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করে, সমস্ত পৃথিবী বিদীর্ণ করে দিতে ইচ্ছে করে। 

এবং, এইসব দিনরাত্রে আমার আহমাদের কথা মনে পড়ে, 

একটা, দুটো, তিনটা, একশোটা লাশ ভাসবে। তারপর? একদিন লাশ ভাসবেনা। একদিন তুমুল বান আসবে, বুড়িগঙ্গার পানি আবার নির্মল, কাকচক্ষু হয়ে যাবে।