বাংলা গদ্যসাহিত্যে নন-হোমোজিনিটি

হোমোজিনিয়াস কী 
“নোবেল, দয়া করে ওদের হাত-পা ধরে একটা জিনিসই বলবি, লেখাগুলো যেন হোমোজিনিয়াস হয়!” 

ইবরাহিম ভাই এই কথাটা বলসিল, বেশ অনেকদিন আগে। যেহেতু হোমোজিনিয়াস লেখার জন্য সে হাত-পা পর্যন্ত ধরতে বলসে—কাজেই বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা একটু গুরুত্বপূর্ণই হবে। 

হোমোজিনিয়াস শব্দটা অনেক অর্থই বোঝাতে পারে। তবে সহজ করে বললে বলা যায়, লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একইরকম হলে সেই লেখাটা হল হোমোজিনিয়াস লেখা। 

একইরকম মানে কী! 

এটার অর্থ বেশ ব্যাপক। যেমন, 

আমি এই লেখায় করসি, গেসি, খাইসি-র মত শব্দ ব্যবহার করতেসি, অর্থাৎ আমি লিখতেসি কথ্যভাষায়। শেষ পর্যন্ত যদি আমি কথ্যভাষাতেই লিখতে থাকি—তাহলে এই লেখার শুরু থেকে শেষ একইরকম, অর্থাৎ হোমোজিনিয়াস। 

আরেকটা উদাহরণ দেই— 

ইংরেজি S-এর মত উচ্চারণ বোঝাতে আমরা এবং —দুটোই লিখি। আকিব লেখে , আমার পছন্দ । ফলে ওর আর আমার সংলাপগুলো হয় এমন—

আকিব: ভাই আমার কাজ শেষ হইছে, ক্যাম্পাসে আসতেছি। কী করতেছেন?
আমি: কিছু করতেসি না, একটু আগে পরীক্ষায় বাঁশ খাইসি। চলে আয়।

আমি যেহেতু এই লেখায় আমার পছন্দমত করসি, গেসি, খাইসি বানানে লেখা শুরু করসি—একটু পরে চাইলেই করছি, গেছি, খাইছি লিখতে পারবো না। যদি শেষ পর্যন্ত করসি, গেসি, খাইসি বানানে লিখে যেতে পারি—তাহলে লেখাটা হবে হোমোজিনিয়াস। 

হোমোজিনিটি কেন দরকার 
কেউ যদি আমার ঘরে বেড়াতে আসে—ঘরটা এলোমেলো হলেও তো সে বসতে পারবে, কথাবার্তাও বলতে পারবে। তবু বিশেষ কেউ এলে আমরা ঘর গুছায়ে রাখি। কেন রাখি এটা ঠিক ওভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন। হয়তো মানুষের আদিম সৌন্দর্যবোধের সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে। গোছানো ঘরে এসে ঢুকলে হয়তো আসলেই আমাদের ভালো লাগে। 

কোনো লেখা হোমোজিনিয়াস হলে সেই ব্যাপারটাকে বলে হোমোজিনিটি। এবং হোমোজিনিটি হচ্ছে একটা গোছানো ঘরের মত—ফলে হোমোজিনিটি না থাকলেও লেখা পড়া যায়, বোঝা যায়। তবু ইবরাহিম ভাই রীতিমত আমাকে অন্যদের হাত-পা ধরতে বলসিল এই হোমোজিনিটির জন্য, এবং এর কারণও ঐ একটাই—গোছানো ঘরের মত হোমোজিনিটির সাথেও সৌন্দর্যবোধের একটা সম্পর্ক আছে। অগোছালো ঘরে যেমন সবাইকে বসতে দেয়া যায় না—অমনই লেখা হোমোজিনিয়াস না হলে সবাইকে সেই লেখা পড়তে দেয়া যায় না। 

হোমোজিনিয়াস লেখার একটা সুন্দর উদাহরণ হিসাবে সুনীলের সেই সময়-এর কথা মনে করা যায়। লেখক সচেতনভাবে চেষ্টা করসেন সংলাপগুলা হোমোজিনিয়াস করতে। নিজের বর্ণনার সময় প্রমিত ভাষা ব্যবহার করসেন, কিন্তু থাকোমণি প্রত্যেকটা জায়গায় তার গ্রাম্য উপভাষায় কথা বলে গেসে, ঢাকার জমিদার (নাম ভুলে গেসি) কথা বলসে ঢাকাইয়া ভাষায়, এবং লর্ড বীটন বলসেন সাধু ভাষায়! আমার কোনো জায়গার কথা মনে পড়ে না যেখানে এর ব্যত্যয় ঘটসে, এবং এই হোমোজিনিটির কারণেই উপন্যাসটা গঠনগত দিক থেকে অসম্ভব সৌন্দর্যময়। 

হোমোজিনিটি কি আসলেই দরকার? 
এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ভাবতেসি। বাংলা সাহিত্যের যেই ক্ষুদ্র অংশ আমি পড়সি—তার পুরোটুকুই হোমোজিনিয়াস লেখা (অবশ্য, যেসব বইয়ের প্রুফরিডার মাতাল অবস্থায় প্রুফ দেখসেন—তার কথা আলাদা)। 

কিন্তু আমরা যেই ভাষায় কথা বলি—সেটা নিজেই হোমোজিনিয়াস না। যেমন, শাফিন কেমিস্ট্রির প্রশ্ন কঠিন করলে আমি তাকে এই বলে গালি দেই যে, শালা বাচ্চাগুলাকে মারে ফেলসে। কিন্তু প্রশ্ন যদি খুব বেশি কঠিন হয়, তখন আমি বলি, হালায় বাচ্চাগুলারে মাইরা ফালাইসে! অর্থাৎ অবস্থাভেদে আমার মুখ দিয়ে কখনো প্রমিত ভাষা, কখনো ঢাকা-উত্তরবঙ্গের মিশ্র ভাষা, এবং কখনো বিশুদ্ধ ঢাকাইয়া ভাষা বের হয়! 

এই একই অনুভূতি নিঃসন্দেহে লেখার সময়েও কাজ করে। যেমন কিছুদিন আগে ক্যারেন আর্মস্ট্রং সাহেবের এক বই সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমি শুরু করসিলাম প্রমিত ভাষায়। কিন্তু তৃতীয় বাক্যে গিয়ে এত বেশি হতাশ লাগলো যে, ভাষাটা ঢাকাইয়া হয়ে গেল—

“ভালো বই। ক্যারেন বাহুবলীন্দ্র মশাই ঋদ্ধ লোক, কোনোদিকে না তাকিয়ে খেলে দিয়েছেন। ফলে কিছু জায়গা মাথা ছুঁয়ে, কিছু মাথার ওপর দিয়ে, এবং বাকি সব সপ্ত আকাশের উপ্রে দিয়া উইড়া গেসে—আমি হাঁ কইরা তাকায়া দেখসি ঐসব শব্দরে অজানা উড়ন্ত বস্তুর মত উইড়া যাইতে।”

এসব ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে লেখাকে হোমোজিনিয়াস বানাতে হয়। কিন্তু, সেটা করতে চাইলে বাক্যগুলো হয়ে যায় এমন—

“ভালো বই। ক্যারেন বাহুবলীন্দ্র মশাই ঋদ্ধ লোক, কোনোদিকে না তাকিয়ে খেলে দিয়েছেন। ফলে কিছু জায়গা মাথা ছুঁয়ে, কিছু মাথার ওপর দিয়ে, এবং বাকি সব সপ্ত আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে গেছে—আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছি ওসব শব্দকে অজানা উড়ন্ত বস্তুর মত উড়ে যেতে।”

সুন্দর দেখায় কি এভাবে লিখলে? হয়তো দেখায়। সৌন্দর্যবোধ খুব আপেক্ষিক—কাজেই কোনটা আদৌ সুন্দর—এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কিন্তু যে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নাই সেটা হল এই যে, জোর করে হোমোজিনিয়াস বানানোর পর বাক্য তিনটার যেই চেহারা হইসে—সেটা আমি বলতে চাই নাই! 

হুম, দুইটা ভাষাই বাংলা, একটা শব্দও এদিক ওদিক হয় নাই—তবু হোমোজিনিয়াস বানানোর পর লেখাটা যা হইসে—আমি মোটেও সেটা বলতে চাই নাই! 

সুতরাং নন-হোমোজিনিয়াস লেখায় হয়তো বাক্যের গঠনটা বড় বেআইনি হয়ে গেসে, কিন্তু বাক্যগুলা আমার চিন্তার আরও কাছাকাছি আসতে পারসে, এবং আমি অসম্ভব শান্তি পাইসি খটাখট টাইপ করে লেখাটা শেষ করার পর। 

এবং বিপরীতক্রমে, বাক্যগুলোর হোমোজিনিয়াস অবস্থা দেখে আমার এখনও অস্বস্তি লাগতেসে—যেন আমার কথাগুলাকে কেউ জোর করে বেঁধে রাখার চেষ্টা করতেসে। 

নন-হোমোজিনিটি 
হোমোজিনিয়াস লেখার কার্যকারীতা অনস্বীকার্য, কিন্তু আমার মনে হয়, নন-হোমোজিনিটির ব্যাপারটা গদ্যসাহিত্যে কতখানি কার্যকর—সেটা ভেবে দেখা যায়।

আমার ইচ্ছা আছে, কিছুদিন নন-হোমোজিনিয়াস গল্প লিখে দেখার।