সন্ধ্যাপ্রদীপ

সেঁজুতি কোথায়, কে জানে। আমি জানি না। 

মেয়েটা কেমন আছে, সেটাই বা কে জানে! আমি জানি না। 

শেষ কবে বেচারার সাথে ঠিকমত কথা বলেছি মনে পড়ে না। তবে প্রথম যেদিন বলেছিলাম, বেশ মনে আছে সেই কথা। অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলাম বাচ্চাটার ওপর। মনে হচ্ছিল, এমন নেকু নেকু বাচ্চাদের সাথে কাজ করা বড় মুশকিল। পরে জেনেছি, এই বিরক্তিটা ছিল দ্বিপাক্ষিক। সেঁজুতিও ভেবেছিল, এইসব আঁতেল-টাইপ ভাইদের সাথে কাজ করবো কীভাবে! 

অনেক পরে, আমাদের যখন এই বিষয়টা নিয়ে কথা হয়, তদ্দিনে আমরা একটু করে বুড়ো হয়েছি, বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ঋদ্ধও হয়েছি, এবং আমরা গেছি অলৌকিক কিছু প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, ফলে দ্বিপাক্ষিক বিরক্তির কথা শুনে আমি হেসে ফেলি, এবং সেঁজুতি হাসে তার ত্রিগুণ, হেসে কুটিকুটি হওয়ার আগ পর্যন্ত সে থামতে চায় না! 

আমার মনে পড়ে না, যেই মেয়েটার ওপর আমি অত্যন্ত বিরক্ত ছিলাম, সে কীভাবে অত দ্রুত আমার ডান হাত হয়ে উঠেছিল। হিসেব কষে এসব বের করা যায় না, আমি বারবার বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু এই বিভ্রান্তির মাঝেও আমার বারবার মনে পড়ে সেইদিনের কথা, যে রাতে সেঁজুতি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একটা ঘোরের জগতে চলে যায়। আমি তাকে মেইল দিয়ে ধমকাই, বলি, তুই বিশ্রাম নে। এবং এরপর বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করি, সেঁজুতি লম্বা হয়, সেঁজুতি লম্বা হতে থাকে, সেঁজুতির মাথা ঘরের ছাদ ফুঁড়ে যায়, সেঁজুতি আকাশ স্পর্শ করে। এবং সেঁজুতি নির্বিকার থাকে, যেন প্রতিনিয়তই দু-চারজনের মাথা আকাশের সাথে ঠোক্কর খায়—এইসব কোনো ব্যাপারই না! 

আমি বিস্ময় এড়াতে পারি না, ফলে ডায়েরিতে বারবার করে লিখি, অদ্য আমি একজনকে লম্বা হইতে দেখিয়াছি, নিজ চক্ষে দেখিলাম, সে ছাদ ফুঁড়িয়া আকাশ স্পর্শ করিল। আমি মানুষজনকে ধরে ধরে বলি, সেঁজুতি বিরাট লম্বা মেয়ে, এই মাটি থেকে একদম ঐ আকাশ পর্যন্ত! 

এবং আমি অভিভূত হয়ে থাকি, কেননা আমাকে ঘিরে অলৌকিক সব ঘটনাবলি ঘটতে থাকে। রীতিমত দস্তখত করে আমি মৃত্যু-পরোয়ানা নেই, কাগজে সই করে লিখে দেই যে, এই ছেলেটা মরে গেছে—অতঃপর আমার শবদেহ নিয়ে এই শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাই। আমি লক্ষ্য করি, মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন, কিন্তু এর চাইতেও কঠিন মৃত্যুকে ক্রমাগত অগ্রাহ্য করতে থাকার প্রক্রিয়া।

এবং এরপর, আমি দেখি সেঁজুতিদের, যারা এক ধরনের মেলানকোলিয়ার মধ্যে আবর্তিত হতে হতে মৃত্যুকে গ্রহণ করে। মমতামিশ্রিত মেলানকোলিয়ার রূপ যে কী আশ্চর্যরকমের সুন্দর—এটা কি কেউ জানে? 

অবশ্য যার নামের অর্থ সন্ধ্যাপ্রদীপ সে যে জানবে এটা আশ্চর্যের কিছু না। সন্ধ্যা সে ধরে নেয় হয়েই আছে, এরপর অন্ধকার দূর করে। মমতামিশ্রিত মেলানকোলিয়ার অর্থ সেঁজুতি বুঝবে না তো কে বুঝবে? 

আমি একবার ঠাট্টা করে সেঁজুতিকে বলছিলাম, তুই একটা সংসারী হবি! আমার ধারণা ছিল গৃহী হওয়া খুবই খেপে যাওয়ার মত কথা। পরে দেখি, সেঁজুতি আগ্রহের সাথে তথ্যটা গ্রহণ করলো—সে সংসারীই হবে! 

কেন যেন মনে হয়, ধীরে ধীরে চোখ খুলে যাচ্ছে। এবং মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস জন্মে যাচ্ছে, সেঁজুতিরা সংসারীই হবে, এবং সেঁজুতিরা থাকবে বলেই আশেপাশের ব্যাড়াছ্যাড়া মানুষগুলোও বেঁচে থাকবে, চৈত্র-চৈত্র ধরে চারশো বছরের সিমেন্টের জঙ্গলটা বেঁচে থাকবে। 

সেঁজুতিরা কখনই বুদ্ধ হবে না। কিন্তু এরা হবে সেই অশ্বত্থের মত—যার আশ্রয়ে বসে দু-তিনজন অনায়াসে বুদ্ধত্বলাভ করবে।