আমাদের Die Verwandlung-এর ইতিহাস

পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের লোকেরা সেই ভোরের কথা স্মরণ করে, যেদিন সকালে প্রথম রিকশার ক্রিরিং ক্রিরিং বেল শুনবার আগেই তারা কুত্তার ডাক শুনতে পায়, এবং পৃথিবীর সকল কুত্তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে তারা আবারও পাশ ফিরে শোয় এবং ঘুমিয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে ভোরবেলা কুত্তার এই ডাক এবং এর বিপরীতে নাজিমউদ্দিন রোডের লোকের প্রতিক্রিয়া যথাক্রমে নাজিমউদ্দিন রোডের লোক এবং কুত্তার কাছে স্বাভাবিকতম ঘটনা বলে মনে হয়, ফলে রাস্তা বরাবর কার্জন হলের দিকে কুত্তা দৌড়াতে থাকে, লেজ গুটিয়ে, জিহ্বা বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে শহীদুল্লাহ হলের গেটে এসে খানিকক্ষণ বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, পা দিয়ে কান চুলকায়, এবং পরমুহূর্তেই ভেতরে ঢুকে পড়ে, পুকুরঘাটে যেতে যেতে তার গতি ধীর হয়ে আসে, কেননা এই সময়ে তার গত রাতের কথা মনে পড়ে, এবং ভোরবেলা উঠে আরিফুজ্জামান আরিফ নিজেকে বাদামি রঙের কুত্তা হিসেবে আবিষ্কার করে। 

সেই সকালে যারা শহীদুল্লাহ হলের পুকুরঘাটে আরিফুজ্জামানকে বসে লেজ নাড়াতে দেখে তারা বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যায়, এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলে, এমনটা যে ঘটবে তারা আগেই জানতো। ফলে ভাদ্রের এক সকালে ঘামতে ঘামতে ক্লাসে যাবার পথে বাদামি রঙের আরিফুজ্জামানকে দেখে ইশতিয়াক হোসেন চিৎকার করে ওঠে, ঐ যে আরিফ, ঐ যে বইসা আছে আরিফ! চিৎকার শুনে আরিফুজ্জামান আরিফ সচেতন হয়, এবং ইশতিয়াক হোসেনকে ডাকতে ডাকতে তার দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু সেই চিৎকারের অর্থ বোধগম্য না হবার ফলে ইশতিয়াকে হোসেন বিপন্ন বোধ করে, সে নিজেও দুর্বোধ্য চিৎকার করতে করতে ডিপার্টমেন্টে ঢুকে যায়, এবং সেখানে উপস্থিত মানুষেরা তাকে আলুথালু অবস্থায় প্রবেশ করতে দেখে বলে, হালারে কুত্তায় খেদাইসে! পরববর্তী বর্ষায় গ্লোরিয়া জিন্‌সে সদলবলে আড্ডা দেয়ার সময় সায়েফ ফাতিউর রহমানের এই ঘটনার কথা মনে পড়ে, এবং সবাইকে সচকিত করে সে হা হা করে হেসে ওঠে। তাকে হাসতে দেখে আশেপাশের মানুষেরাও হাসে, এরপর আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে, হাসোস ক্যা! কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই সায়েফ ফাতিউর রহমান বিষণ্ন হয়ে পড়ে, কেননা কুত্তা খেদানোর ঘটনায় তার সেই বিকেলের কথাও মনে পড়ে, যেদিন দোয়েল চত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে সে ভার্সিটির দোতলা বাসকে ছুটে যেতে দেখে, সে কুত্তাকেও ছুটে যেতে দেখে, এবং সেই রাতে বাসায় ফিরে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়, বস্তুত জ্বরের পূর্বের এবং পরের বেশ কিছুদিনের ঘটনাই তার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়, কেননা সে নিশ্চিত হতে পারে না ঠিক কোন ঘটনাগুলো বস্তুত সে ঘটতে দেখে। ফলে সায়েফ ফাতিউর রহমান হাসার অব্যবহিত পরেই বিষণ্ন হয়ে পড়ে, এবং, নাজিমউদ্দিন রোডের লোকেরা বলে যে, লাল বাস এবং কুত্তার ছুটে যাওয়ার সাথে সায়েফ ফাতিউর রহমানের এই বিষণ্নতার একটা গভীর সম্পর্ক আছে, ফলে তারা এক সকালে রিকশার ক্রিরিং ক্রিরিং শব্দেরও পূর্বে কুত্তার ডাক শুনে যখন জেগে ওঠে, তারা নিজেরাও বিষণ্ন বোধ করে, সাততলা জানালা গলে আসা আধহাত আকাশের দিকে তাকায়ে তাদের মনে হয়, এইটা ভোরও হয় নাই, কিন্তু এইটা রাতও না—এইটা ভোর ও রাতের মাঝামাঝি একটা ধূসর অবস্থা, যখন পুরান ঢাকার সারি সারি বাড়ি, শাঁখারি বাজারের সংকীর্ণ গলি, বেচারাম দেউড়ির আকাশ, মিটফোর্ড ঘাটের বুড়িগঙ্গা, এমনকি ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে ঘুমিয়ে থাকা মাতালের চেহারাটাও ধূসর দেখায়, এই ধূসরতা তাদের মনকেও ধূসর করে দেয় এবং তারা অন্ধ হয়—চক্ষুহীনের কালো অন্ধত্ব না, বোধিপ্রাপ্তের সাদা অন্ধত্ব না—বরং এর চাইতেও ভয়ংকর এক ধূসর অন্ধত্বে তারা নিমজ্জিত হয়, নোনাধরা দেয়ালের ভেতর পানি প্রবাহিত হবার কলকল শব্দ শুনতে শুনতে তারা নিজের অজান্তেই পাশ ফিরে শোয়, এবং ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে সেই সকালে আরিফুজ্জামানের দৌড়ের পুরো ইতিহাসটুকু তাদের জানা হয় না, তবু, কোনো এক বিকেলে তারা কার্জনের পুকুরঘাটে বসে তুমুল আড্ডা দিতে থাকে, এবং তখন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সাদিয়া আরেফীন নদীকে আসতে দেখা যায়, ঘাটের শেষধাপে এসে সে ধপাস করে বসে পড়ে, এবং পানিতে পা ডুবিয়ে পুকুরে অস্তগামী সূর্যের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। খানিকক্ষণ পর তার ব্যাগ থেকে ঢাউস আকৃতির একটা বই বেরিয়ে আসে এবং পুকুরঘাটে উড়ে বেড়ানো গোল্ড লিফের ধোঁয়া উপেক্ষা করে সাদিয়া আরেফীন নদী বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাতে শুরু করে; তখন, এফএইচ হলের মানুষজন বলে যে, তারা হলের আশেপাশে প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনতে পায়, এবং আরিফুজ্জামানকে ছুটে ঘাটের দিকে যেতে দেখে। ঘেউ ঘেউয়ের সাথে দৌড়াতে দেখে তাদের মনে এই আতঙ্ক হয় যে, আরিফুজ্জামান পাগল হয়ে গেছে এবং পুকুরঘাটে গিয়ে সে সম্ভাব্য সকল শত্রুকে কামড়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। ফলে তাদের কেউ কেউ ঘাটের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন হয়; কিন্তু ঘাটে এসে আরিফুজ্জামান শান্ত হয়ে পড়ে, এবং মৃদুগতিতে লেজ নাড়াতে থাকে। পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসলের লনে বসে মৃণ্ময় কুমার কুণ্ডু যখন এইসব ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করে, তখন সে দাবি করে, প্রধানত সাদিয়া আরেফীন নদীকে জর্জ অরওয়েল পড়তে দেখার ফলেই আরিফুজ্জামান শান্ত হয়ে আসে, কেননা লেজ নাড়াতে নাড়াতে সে নদীর দিকে এগিয়ে যায়, এবং মাথায় হাত বুলিয়ে অরওয়েল পড়ার প্রতি সমর্থন প্রকাশের চেষ্টা করে। এবং, মৃণ্ময় কুণ্ডু বেশ অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর লেখে যে, ছোট বোনের মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে আরিফুজ্জামান আবিষ্কার করে, থাবা উঁচু করে মাথায় হাত বোলানো সম্ভব না, এর চাইতে লেজ নেড়ে এবং জিভ দিয়ে ছোট বোনকে আদর করাটা অনেক সহজ, এবং গ্রহণযোগ্য একটা পদ্ধতি। কিন্তু তার আদর করার এই পদ্ধতি আর বিভ্রান্ত হয়ে সাদিয়া আরেফীন নদীর বারবার সরে যাওয়ার চেষ্টায় পুকুরপাড়ে এক হাস্যরসের সৃষ্টি হয়, কেমিস্ট্রি কিংবা গ্রাফিক্স ডিজাইনের ছেলেমেয়েরা প্রথমে হেসে ওঠে, এবং এরপর আরিফুজ্জামানের কবল থেকে সাদিয়া আরেফীন নদীকে মুক্ত করে। কিন্তু ইশতিয়াক হোসেন যখন প্রথমবারের মত দৌড়ানি খায়, কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারে না, কেবল ফিজিক্সের সামনে তার আলুথালু অবস্থায় ছোটার দৃশ্য মনে করে সায়েফ ফাতিউর রহমান হো হো করে হাসতে থাকে এবং কফির কাপে চুমুক দিয়ে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। জুলাই মাসের ঘোর বর্ষায় অন্ধকার হয়ে আসা শহরের দিকে তাকিয়ে তার একটা লাল বাসের কথা মনে পড়ে—ধীর, অথচ নিশ্চিত গতিময় ভঙ্গিতে বাসটার এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য বারবার তার মাথার ভেতর পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। একটা সময় সে ঘোরের জগতে চলে যায়, তার মনে হয় সারা শহরজুড়ে একের পর এক লাল বাস গম্ভীর ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং তার এই সাইকিডেলিক অনুভূতির ব্যাপারে ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসলের লনে বসে মৃণ্ময় কুমার কুণ্ডু বিশদ আলোচনা করে। পাণ্ডুলিপির মার্জিনে মৃণ্ময় কুণ্ডু মন্তব্য লিখে রাখে যে, এক বিকালে যখন সায়েফ ফাতিউর রহমান দোয়েল চত্বরে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছিল, তখন সে কার্জন হলের ভেতর থেকে দ্রুতগতিতে একটা বাদামি কুত্তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে, এবং রাস্তা বরাবর একটা লাল বাস সেই কুত্তার দিকে এগিয়ে যায়। সেই কুত্তা আদৌ লাল বাসের নিচে চাপা পড়েছিল কিনা সেই সম্পর্কে মৃণ্ময় কুণ্ডু জানতে পারে নাই, কেননা ঘটনাটাকে তুচ্ছ মনে করে কোনো পত্রিকা সেই খবর ছাপায় নাই, এবং সেই রাতেই সায়েফ ফাতিউর রহমান প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়, যার এক সপ্তাহ বাদে সেরে উঠে সে নিজেও বিভ্রান্ত বোধ করে—সেই বিকালে দোয়েল চত্বরে দাঁড়িয়ে আদৌ কী ঘটতে দেখেছিল। অবশ্য, গ্রাফিক্স ডিজাইনের তৎকালীন ছাত্রী রিয়াজুল জান্নাতের আলাপচারিতায় মৃণ্ময় কুণ্ডু জানতে পারে যে, সেই ঘটনার পর ক্যাম্পাসে সম্ভবত কোনো বাদামি কুত্তার অস্তিত্ব ছিল না। কেননা, সেই ঘটনার পরপরই একদিন টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ক্যাম্পাসে রিয়াজুল জান্নাত লক্ষ্য করে, সেদিন মিছিলের আশেপাশে কোথাও বাদামি কুত্তা দেখা যায় না; সন্ধ্যায় টিএসসিতে বসে সে যখন এ বিষয়ে ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তখন তাদের অনেকেই বিস্মিত হয়, এবং একজন বলে, মিছিলের আশপাশ ছাড়াও তো ক্যাম্পাসের অন্যান্য স্থানে বাদামি কুত্তা দেখা যেতে পারে; এতে উল্টো রিয়াজুল জান্নাতই বিভ্রান্ত বোধ করে, কেননা তার স্পষ্ট মনে পড়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই মিছিলের আশেপাশে একটা বাদামি কুত্তা দেখা যেতো, এবং একদিন বিস্তারিত আলোচনা করে তারা সিদ্ধান্তে এসেছিল যে, আকৃতিগতভাবে কুত্তা হলেও প্রকৃতির কোনো বিচিত্র খেয়ালে এর চিন্তাভাবনা অনেক মানুষের চেয়ে উন্নত, এবং আদর্শের দিক দিয়ে সে মূলত একজন মাওবাদী। বহু বছর আগের এসব গল্প বলার সময় রিয়াজুল জান্নাত এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করে, এবং মৃণ্ময় কুণ্ডু ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসলের সবুজ ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে লেখে যে, আরিফুজ্জামান আরিফের কুত্তায় পরিণত হওয়ার বিষয়টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তখন পর্যন্ত পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নাই। কাজেই বাদামি কুত্তার অন্তর্ধানের ব্যাপারে কেউ কেউ লক্ষ্য করলেও তারা এ বিষয়টা উপেক্ষা করে যায়, ফলে বর্ষার পর বর্ষায় সায়েফ ফাতিউর রহমান অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে থাকে, কফির কাপ হাতে হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, আরে ইশতিয়াক হোসেনরে তো কুত্তায় খেদাইসিল, এবং এ কথা উচ্চারণ করার সাথে সাথে সায়েফ ফাতিউর রহমান নিমজ্জিত হয় অতলস্পর্শী এক বিষণ্নতায়, ঘন বর্ষণে ফাঁকা হয়ে যাওয়া সড়কের দিকে তাকায়ে সে এই বিষণ্নতার কোনো আদি-অন্ত স্পর্শ করতে পারে না; এই শহরে যেমন প্রথমে অন্ধকার এবং এরপর বর্ষা নামে, তেমনই সায়েফ ফাতিউর রহমানের হৃদয়েও পর্যায়ক্রমে অন্ধকার এবং বর্ষা নামতে থাকে, এবং বহু বছর আগের একটা দৃশ্য যেন থিয়েটারের মত তার চোখের সামনে উপস্থাপিত হয়—যেদিন দোয়েল চত্বরে ভার্সিটির বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ায়ে থাকার সময় সে কার্জন হল থেকে দ্রুতগতিতে একটা কুত্তাকে ছুটে বের হতে দেখে, এবং একইসাথে দেখে একটা লাল বাসকে সুনিশ্চিত গতিতে কুত্তার দিকে আগায়ে যাইতে, যদিও বাসের তলায় কুত্তার চাপা পড়া কিংবা না পড়া নিয়ে বাকি সবাই অবিচলিত থাকে, কেননা কুত্তার মৃত্যু কখনই হিমালয়ের চাইতে ভারী হয় না, সেই মৃত্যুর তাৎপর্য হয় হালকা, বেলে হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা, তবু কেবল কৌতূহলবশতই সায়েফ ফাতিউর রহমান সেইদিকে তাকায়ে থাকে, তার মনে হয় অনন্তকাল ধইরা বাসটা তাদের সামনে দিয়ে যাইতেসে, কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে, এবং ঠিক এরপরেই সায়েফ ফাতিউর রহমানের আতঙ্ক হয় এই ভেবে যে, একবার বাসটা পেরিয়ে যাবার পর ভয়ংকর কিছু একটা দেখা যাবে কিংবা যাবে না, ফলে কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘামের ফোঁটা নিয়ে সে দ্রুত বিপরীত দিকে হাঁটা দেয়, এবং সেদিন বিকেলে দোয়েল চত্বরের ঘটনা তার অজ্ঞাতই থেকে যায়, এবং কোনো এক অজানা কারণে পরদিন থেকে ক্যাম্পাসে আর কোনো বাদামি কুত্তা দেখা যায় না, তারা হারায়, 

[শেষ]