এলোকথন (জ্যেষ্ঠা ২৬:১)

“There is but one truly serious philosophical problem, and that is suicide. Judging whether life is or is not worth living amounts to answering the fundamental question of philosophy. All the rest—whether or not the world has three dimensions, whether the mind has nine or twelve categories—comes afterwards.”

আলবেয়ার কামু তাঁর বিখ্যাত দাঁতভাঙা প্রবন্ধটা শুরু করেছেন এই কথাগুলো দিয়ে। সেই প্রবন্ধ আমি পুরো পড়িনি। কিন্তু, বেঁচে থাকাটা আদৌ অর্থবহ কিনা—এটা আমি প্রায়ই ভাবি।

একেকটা সময় আসে—যখন এই একটা চিন্তা আমাকে চিরে ফালাফালা করে দিতে থাকে। আমি টুকরো টুকরো হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ি। টেবিলের তলে, বিছানার ওপরে, বুকশেলফের কোণায়, আমার ঘরের ফ্যানের ঢেউয়ে আমার টুকরো ভাসতে থাকে।

আমি মুখ্যু মানুষ। নির্বাণ পেতে এখনো অনেক দেরি। মানুষ কেন বেঁচে থাকে, মরে যাওয়ার আগে তার কী কী করে যাওয়া উচিত—এর কিছুই আমি স্পষ্ট করে বলতে পারবো না।

তবে হ্যাঁ, আমি জানি—আমি কীসের আশায় বেঁচে থাকি।

আমি যখন ছোট—তখন একজন লিখেছিল—নোবেল ছেলেটা ভালোবাসার কাঙাল। একটু ভালোবাসা পাইলে সে নিজেরে বিক্রি করে দেয়।

সেই বয়সে বেশ রাগ হয়েছিল কথাটা পড়ে।

এখন আর হয় না। কারণ আমি জানি—ঐ একটা জিনিসের জন্যই আমি বেঁচে থাকি, এবং কোথাও ঐ একটা জিনিস পেলেই আমি নিজেকে কাগজের দরে বেচে দেই।

কিংবা কে জানে, হয়তো বিকিয়ে না দিয়ে বিলিয়েই দেই।

সমস্যা হল, আত্মাকে বিলাতে হতে আগে তার যোগ্য হতে হয়। একেবারে নির্বাণলাভ হয়তো না, কিন্তু অন্তত আলোর রাস্তাটা তো খুঁজে পেতে হয়!

আমি ঘুরে মরছি কানাগলিতে। এদিকে কোন যে অলিতে, কোন গলিতে টুকরো-টাকরা আত্মা ফেলে এসেছি—কে জানে।

ফলে আমি অন্ধের মত এই অন্ধগলির দেয়াল হাতড়াই। ভাবি, আরেকটু এগোলেই নির্বাণ।

কপাল!

হয়তো কোনোদিন বড় রাস্তা খুঁজে পাব। হয়তো এই গলিতেই মাথা ঠুকে মরবো। গলিতেই পড়ে থাকবো—কেউ কোনোদিন সন্ধান চাইবেও না। কত যুগ গেছে, কত মানুষ গলিতে-গলিতে মরে উধাও হয়ে গেছে—তাতে কী এসে যায়?

খুব অভাববোধ করি একেকটা সময়ে। জীবনে ঘা খেতে খেতে এখন অনুভূতি নাই—তাই ভাবি, চুলোয় যাক অনুভূতি—বুদ্ধ হব, নির্বাণলাভ করবো—ইত্যাদি।

কিন্তু আমি তো জানি, নির্বাণ তো কোনো চাট্টিখানি কথা না। ও যদি হত—তবে তো সবাই বুদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াতো।

আর, আমি তো জানি, আমি কীসের জন্য বেঁচে থাকি। কীসের আশায় আমি নিজেকে শতবার করে বিলিয়েছি।

আরও বিলাবো। আমার এই নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। ভালোবাসা কখনো অপাত্রে যায় না। পাত্রেই যায়। সেই পাত্র একসময় ফুটো হয়ে গেলে আমাদের মনে হয়—তবে কি সবটুকু অপাত্রে ঢাললাম কিনা।

আমার সবকটা পাত্র গেছে ফুটো হয়ে। ফুটোও না, আঠারো সালের এক রাতের ঐ একটা ঢিলে সবকটা পাত্র ভেঙেচুরে ভুস করে পড়ে গেছে। বাকি যা ছিল—উনিশ সালের আরেক ঢিলে ফুস।

কিন্তু, এরপর?

বহুদিন ধরে অল্প অল্প করে তৈরি করা একটা বাস্তবতা (কেননা সেটাকে আজ রাতে আমি ইলিউশন নামে ডাকবো না) যখন এক লহমায় ভ্যানিশ যায়—তখন মানুষ কী করে – কী করে?

অসংখ্য পাত্র থেকে অমৃতসুধা নিতে নিতে, আর সেখানে সুধা দিতে দিতে বড় বদঅভ্যাস হয়েছিল আমার। যেন জীবনটা এতই মজার—নাও সুধা নাও, আর ইচ্ছেমত ঢেলে দাও।

আমি নিজের দিকে তাকিয়ে হাসি। এখন আরও মজা। পাত্রই নাই। তাই সুধা ঢালাঢালির কারবারও নাই। দিনরাত বসে বসে গোঁফে তেল দাও, আর ভাবো—ঐ দেখা যায় নির্বাণ, এই বুঝি নির্বাণ আকাশ থেকে পড়লো!

কপাল!

আমার মধ্যে সমান্তরালে আকাঙ্ক্ষা ও ত্যাগের অনুভূতি কাজ করে। আমি ভালোবাসা পেলে নিজেকে বিক্কিরি করে দেই—এটা আমি অস্বীকার করতে পারি না। যেকোনো র‍্যান্ডম মানুষ আমাকে আইসক্রিম খেতে বললে আমি তার কাছে আদ্ধেক বাঁধা হয়ে যাই—সবই সত্যি।

কিন্তু একইসাথে আমার মধ্যে এই বোধও কাজ করে যে—এর কোনোকিছুই আমার প্রাপ্য না। দুঃখের কারণ আমাদের আকাঙ্ক্ষা—শাক্য তথাগতের এই চিন্তা আলোচনায় না আনলেও আমার মনে হয়—এইসব ভালোবাসা, এইসব র‍্যান্ডম আইসক্রিম, একটা দৈব স্পর্শ—কোনোকিছুই আমি ডিজার্ভ করি না।

তখন মনে হয়, একটা সন্ন্যাস খুব দরকার। চুপ করে বসে থাকা। ভালোবাসা যেহেতু আমার প্রাপ্য না—সেটার বাঁধন থেকে নিজেরে মুক্ত করা।

তবু না,

তবু,

বিশ্বাস কর, তবু আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

কেন যাই? কারণ, মানুষ অতীত ভোলে না। আসিফ ছেলেটা যখন কথা বলে—এই বদের হাড্ডির ওপর আমার প্রচণ্ড মায়া কাজ করে। আমার মনে পড়ে, এই ছেলেটা আমানউল্লাহ আমানকে জড়ায়ে ধরে কীভাবে হাউমাউ করে কাঁদছিল—এবং তখন আমি ভালোবাসার অনুভূতি থেকে নিজেরে ছাড়াইতে পারি না।

হয়তো তবু ছাড়ায়ে ফালাই। তখন রিয়া একদিন ফোন দেয়। আমি দশবার ফোন ধরি না—সে এগারোবারের মত ফোন দিয়ে আমাকে পায়। বকাঝকা করে বলে—কেন ফোন ধরি না, তার কথা বলার আছে—ইত্যাদি। এবং রিয়াকে প্রতিবকা দিতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি—আমি এই সংসার থেকে মুক্ত হইতে পারতেসি না।

তখন আমি বুঝতে পারি—আমি একটা চক্রের মধ্যে আটকা পড়ে গেছি।

কিন্তু আমি এ-ও জানি—মানুষ তখনই প্রকৃত অর্থে মোক্ষের দিকে ছোটে—যখন তার আর সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

আমার ধারণা—আমার পথ সবই রুদ্ধ হয়ে গেছে। এই পৃথিবীর সাথে সরু কয়েকটা সুতা দিয়ে ঝুলে আছি। কেবল আরেকটা ঘা খাওয়ার অপেক্ষা। তবেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়।

তবে কিনা—এরপর সোজা নির্বাণ, নয়তো মৃত্যু। এটাই ভয় আরকি।

“কী হবে গতি, বিশ্বপতি,
শান্তি কোথায় আছে
তোমারে দাও, আশা পুরাও,
তুমি এসো কাছে।”