এলোকথন (জ্যেষ্ঠা ২৬:৩)


“A human being is essentially
a spirit-eye.
Whatever you really see,
you are that.”

তাই যদি হয়, এবং যদি আমি চোখে কেবল অন্ধকারই দেখি—

তাহলে আমি কী?

আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়—একেকটা কথা আমার দিকে আঙুল তুলে কী নির্মম অট্টহাস্য করে!

ইউ আর দ্যাট, ইউ আর দ্যাট।

একটা ইটালিক ধাঁচে লেখা শব্দ এভাবে আঙুল তাক করে থাকতে পারে? এতখানি নির্দয়ভাবে একটা মানুষকে বিদ্ধ করতে পারে?

এইসব মুহূর্তে আমার কানে বৃষ্টির শব্দ আসে।

এটা কি একটা রোগ? আমার কেবল দুটা জিনিস মনে হতে থাকে। এক, আমি বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এবং দুই, আমি একটা সমুদ্রে আছি।

লিখেছিলাম, কোথায় কোথায় যেন। বহুবার। আমি মরে যাওয়ার পর কাগজপত্তর ঘাঁটতে গেলে ওসব বের হবার কথা। এই পাগলডা—হ্যায় গভীর আন্ধারে ডুইবা গ্যালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাইতো, আর হালায় ভাবতো হ্যায় সমুদ্দুরে ভাইসা আছে। একডা নৌকায় কইরা ভাসতেসে। হেই নৌকার পাশ দিয়া পড়তেসে গা বৃষ্টি।

ইউ আর দ্যাট।

আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।

কিন্তু আর দশটা মানুষের মতই আমি জানি, মানুষ বাঁচে না।

তখন আমার ইচ্ছা করে, নিজেরে বৃষ্টির মত, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত একখানে থেইকা আরেকখানে প্রবাহিত কইরা দিতে।

এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে। 

মানুষের তো এই ইচ্ছাই করে।

তখন সে বাচ্চা দেয়। কোটি কোটি বাচ্চা দিয়া পৃথিবীটা ভরায়া ফালায়। ভাবে, আমি থাকুম না, কিন্তু আমার বাচ্চা থাকবো। ঐ হালার হইবো বাচ্চা, সেই হালার পুতের হইবো আরও বিশটা বাচ্চাটা। এইসব নাতিপুতির গুষ্ঠীর মইদ্যে আমি থাকুম, আমার জিন থাকবো।

জিন তো বলে না, বলে যে, আমার রক্ত থাকবো। বংশের রক্ত। উঁচা বংশের উঁচা রক্ত। এইজন্য তখন আবার নিচা বংশের সাথে তারা বিয়া দিতে চায় না। উঁচা-নিচা রক্তের মিশ্রণ ভালো না।

কিন্তু যে করেই হোক, তারা চায় নিজের অস্তিত্বের ভগ্নাবশেষ পৃথিবীতে রেখে যেতে। নিজেকে যখন রাখা যাচ্ছেই না—তখন অস্তিত্বের একটা খণ্ডই নাহয় থাকলো। মন্দ কী।

এই একটা বোধ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খেলা করতে থাকে।

মহাপুরুষদের মধ্যে করে কিনা, জানি না। তাঁরাও কি চান নিজেকে এইভাবে বৃষ্টির মত, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত, এক জায়গা থেকে,

অন্য,

জায়গায়,

ছড়ায়ে দিতে?

ক্যাডায় জানে। মহাপুরুষগো কথা বাদ দেই, আমাগো কথা কই। আমরা যে কেবল বছর বছর বাচ্চা উৎপাদন করেই তৃপ্ত হই—তাও না। কারো কারো ইচ্ছা করে—বিখ্যাত হয়া নিজের নাম পৃথিবীতে রাইখা যাইতে। আমরা যখন ছুডু আছিলাম, তাবত দুনিয়া আমাগো শিখাইসিল—হেই হেই কাজ কইরলে পৃথিবী তোমাগো নাম মনে রাখবো। কাজেই হেইডা কর, হুইডা কর—ইত্যাদি।

আমি অস্তিত্বের সংকটে ভুগছি। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি তাহলে এটাই—কোনোভাবে নিজেদের অস্তিত্বের একটা-দুটা অংশ রেখে যাওয়া? আলফ্রেড নোবেল নাই—কেবল তার নামটা আছে? দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সাত মণ্ডল মরে গেছে—কেবল তার নাতির নাতিরা কালেভদ্রে তার নামটা একবার উচ্চারণ করে—এ-ই?

হয়তো এটা একেবারে জীবনের উদ্দেশ্য না। এটা স্রেফ আমাদের জন্মগত একটা বোধ।

একটা তাড়না—আমি থাকবো না, তবু আমি থেকে যাবো। আমি চোখ খুললেই নিজেকে এই বোধের পেছনে দৌড়াতে দেখি, এবং—

আহা,

আহা রে,

ইউ আর দ্যাট।

আমি দেখি, ক্রমাগত চারিদিকে নিজের অস্তিত্বের ছাপ মেরে যাচ্ছি, আর—

ইশ—

ইউ আর দ্যাট।

মানুষ নিজেকে আরও একভাবে রেখে যায়। সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্টভাবে—নিজের প্রিয় মানুষের ভেতরে।

A human being—

আমি দেখি একজনের ভেতরে আরেকজনকে বেঁচে থাকতে। এবং সেটা দুজনের জীবিত অবস্থাতেই। কেননা মানুষ কেবল প্রিয় মানুষের মধ্যে নিজের ছাপ দেয় না—প্রিয় মানুষের ছাপও নিজের ভেতরে নিতে পছন্দ করে—

is essentially a spirit eye—

তখন আমার মধ্যে এক ধরনের মায়া জন্ম নেয়—আমাদের উত্তরবঙ্গের ভাষায় যাকে বলে ময়া—আমার মধ্যে সেই ময়া জন্ম নেয়, মনে হয়, হুম, অই যে, অইখানে-অইখানে আমি বেঁচে থাকবো, অই বেদীর অই দেবীতে আমার পূজার ভগ্নাবশেষ থাকবে, একটা ধূপ কি আগরবাতির গন্ধ, দেয়ালে দেয়ালে আমার মন্ত্রোচ্চারণের প্রতিধ্বনি, মেঝেতে আমার সদ্য বসে থাকার উষ্ণতা, দু-একটা চুল,

কিন্তু, তবু তো অন্য পূজারী এসে বসবে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে—

Whatever you really see—

এবং তখন আমার অস্থিরতা বাড়তে শুরু করে, এবং তখন আমি বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই, এবং তখন আমার মনে হয় আমি একটা সমুদ্রে ডুবে আছি, তখন আমি চারপাশে একটা গভীর, নরম, সুস্বাদু অন্ধকার দেখি—

you are that.