এলোকথন (জ্যেষ্ঠা ২৬:২)

“Breathe, breathe in the air
Don’t be afraid to care
Leave, but don’t leave me
Look around, choose your own ground.
Home, home again
I like to be here when I can.” 

কে যেন কবে বলেছিল, আর কবে যেন কোথায় পড়েছিলাম—ঘর হচ্ছে এমন একটা জায়গা—তুমি যখনই সেখানে যাবে—তারা তোমাকে গ্রহণ করে নিবে। 

কিন্তু, আমি ভাবি—এই গ্রহণটা কি কেবল একপাক্ষিক? একটা জায়গা তোমাকে গ্রহণ করলো, কিন্তু তুমি তাকে নিতে পারলে না। তাহলে কি সেই জায়গাটাকে ঘর বলা যাবে? 

আমার তো মনে হয় না। 

আমার কাছে ঘর হচ্ছে এমন একটা জায়গা—যেখানে দিনের যেকোনো সময় তুমি নিশ্বাস নিতে পারবে। 

যদি মুহূর্তের জন্যেও দম আটকে আসে—তখনই আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধবে। ওটা কি ঘর? 

আর যদি প্রতিনিয়ত দম আটকায়—তখন আমি নিঃসন্দেহ হব। ওটা ঘর না। 

আমার কাছে ঘর আর আশ্রয়—এই দুটা প্রায় প্রতিশব্দ। প্রায়ই একটার পরিবর্তে আমি অন্যটা ব্যবহার করতে পারি। 

একবার গভীর রাতে আমি শেরেবাংলা হলে ঢুকেছিলাম। প্রথম যেই রাতে আমি হলে থাকি। সে রাতে ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে কেবলই ভাবছিলাম, কোথায় যাই, কোথায় যাই। শেষে হলে গিয়েই ঢুকলাম। কনকের ঘরে একটা বিছানা খালি ছিল। সেখানে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

ঘুমাবার আগে আমার জায়গাটাকে খুব আপন মনে হয়েছিল। আমি বিছানাটাকে জড়িয়ে ধরতে বিছানাটাও বিপরীতক্রমে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল—একটা ঘরে আছি। 

আমি জীবনে একজনেরই হাত ধরেছিলাম। প্রথম যখন ধরেছিলাম—আমার কিছুই মনে হয়নি। আমি কেবল ভাবছিলাম—কই, সবাই যে এত কাব্য করে—কই, আমার তো অমন কিছু হল না। শুধু ভালো লাগলো। সকালবেলা এক কাপ চা নিয়ে বসতে যেমন ভালো লাগে, ঠোঁটের সামনে কাপ ধরে বুকভরে সেই চায়ের ঘ্রাণ নিতে যেমন ভালো লাগে—অমন গভীর এক নিশ্বাসে যেন বুকটা ভরে গেল। 

যখন আমি ঘরে বসি (কে জানে শেষ কবে বসেছি), তখনও অমনই ভালো লাগে। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারার মত একটা ভালো লাগা। 

আমার খুব নিশ্বাস নিতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে, টানা কেবল শ্বাস নিয়েই চলি। প্রাণভরে চিৎকার করি, উদ্বাহু হয়ে নাচি। 

অমন মুহূর্তে আমার দম আটকে আসে। হাঁসফাঁস করতে করতে মাথার ওপরে তাকাই। দেখি, চালটা ফুটো হয়ে গেছে। সামান্য বর্ষাতেই পানির ফোঁটা ঢুকে পড়বে। আর কায়দামত একটা ঝড় এলে ধসে পড়বে আস্ত চালটাই। 

ফলে আমার মনে পড়ে—আমার কাছে ঘর আর আশ্রয়—এই দুটো প্রায় প্রতিশব্দ। ঘর তোমাকে এই নিশ্চয়তাটুকু দিবে যে, তোমার মাথায় প্রতিনিয়ত বৃষ্টির পানি পড়বে না। ঘর তোমাকে এই বলে আশ্বস্ত করবে যে, ঝড়ে ছাদ ভেঙে পড়বে—এই আশঙ্কায় তোমার সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকতে হবে না। 

আমি ছোটবেলায় এই নিয়ে ডায়েরি লিখেছিলাম। সেই বয়সে—যখন মানুষ লেখে সোজাসুজি। যা দেখেছি, যা শুনেছি, যা বুঝেছি—লিখেছি। 

আমার নিজের প্রতিই মায়া লাগে ক্লাস এইট-নাইনের ঐ ডায়েরিটা পড়লে। চাল যে ফুটো হয়ে গেছে—সেটা তখনও বুঝিনি। কিন্তু গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছিল ঠিকই। জোর বৃষ্টি এলে কাপড়ও ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছিল। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লিখেছিলাম—দুচ্ছাই, কী যে বৃষ্টিটা পড়ছে এই ঘরে—শুকনো কাপড়টা আমার কেমন করে ভিজে গেল দেখ দেখি! 

আহারে, তখন যদি ছাদের দিকে তাকাতাম? চেষ্টা করেছিলাম নিশ্চয়ই তাকানোর। চোখ ফোটেনি দেখে তাকিয়েও দেখতে পাইনি। 

কিন্তু, এখন যদি চোখ ফুটি-ফুটি করেও থাকে—তবে তাতেই বা লাভটা কী হচ্ছে? কেবল এই জানছি যে, সবকিছু যখন ভেঙে পড়ে—তখন মানুষ মাথার ওপর ঐ একটা ছাদেরই নিশ্চয়তা চায়। শালার সেটাও যদি ভাঙি-ভাঙি করে—তখন, তখন? 

মাঝেমধ্যে নিজেদেরকে ক্লাসিকাল টেক্সটের একেকটা চরিত্র মনে হয়। কী অসহায় একেকজন এই নিয়তির কাছে! সবই যেন জানি, তবু কিছু করার নাই। চোখ বন্ধ করে পরিণতির হাতে নিজেদের সঁপে দিচ্ছি। 

চাইলে হয়তো নিজের হাতে অনেক ভাঙা-গড়া যায়। এখনো তো হাড় শক্ত আছে। অল্পায়াসেই দু-তিনটা ঘর গড়ে নেয়া যায়। 

কিন্তু আমি আম্মু-আব্বুকে ফেলে যেতে পারবো না। 

এই একটা পিছুটান, এই এক পিছুটান…

[গত রাতে, ঘুমাবার আগমুহূর্তে, ঘুম ঘুম চোখে, ডায়েরিতে]