আমাদের নক্ষত্রগুলো

এক.

বছরের এই সময়টা আমাদের বড় ভালো কাটে।

‘আমাদের’ বলতে, আমরা যারা পাগল সমিতিতে কাজ করি—তাদের। অফিসিয়ালি আমাদের নাম অবশ্য পাগল সমিতি না। একটা গালভরা নামও আছে, কিন্তু আমরা নিজেদের পাগল ডাকতেই ভালোবাসি।

এই পাগল অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ‘পাগল’। যে দশের বাইরে থাকে, এবং একসময় ফিরে এসে দশকে এগারো বানিয়ে দেয়।

আইজেএসও-র গল্পটা তাহলে এইবেলা বলে ফেলা যাক!

দুই.

গত বছর (২০১৫ সালে) আমরা যখন আইজেএসও-তে দল পাঠানো শুরু করি—খুবই যে বড় আশা নিয়ে ছিলাম—এমন কিন্তু না! ভেবেছিলাম, ম্যাথ অলিম্পিয়াডে একটা ব্রোঞ্জ পেতে অনেক বছর লেগেছে, ফিজিক্স অলিম্পিয়াডেও, কাজেই জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডেও একটু সময় লাগবে—এ আর এমন আশ্চর্য কী?

তবু, আমাদের মানুষগুলোর তো মাথায় সমস্যা। কাজেই তারা আইজেএসও দলটার পেছনে লেগে থাকলো। মনে করল, আজকে লেগে থাকলে হয়তো একদিন কিছু একটা হবে!

তো, এই আশায় পাগলগুলো চাঁদে পাওয়া মানুষের মতই খাটাখাটনি করা শুরু করল। কেউ টিউশনি বাদ দিয়ে দিল। কেউ শখের কাজগুলো করা ছেড়ে দিল। সকালবেলা পাগলগুলো ভার্সিটিতে যেত ক্লাস করতে। সারাদিন ক্লাস করে, ক্লান্ত হয়ে দৌঁড়ে যেত আইজেএসও ক্যাম্পে। ক্লাস নিতে।

আহা, দিনগুলো চমৎকার ছিল। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত ক্যাম্পে ক্লাস নিতাম। একসময় পিচ্চিদের আম্মু-আব্বুরা এসে চোখ বড় বড় করে বলত, ক্লাস এখনো শেষ হয় নাই? আমরা হাসতে হাসতে বলতাম, না আন্টি!

ভূমিকা বলত, উফফ আম্মু আমরা এখন SN1-SN2 শিখতেসি, পরে এসে আমাকে নিয়ে যেও! এরপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলত, ভাইয়া আরও দুই ঘন্টা পর আসতে বলি আম্মুকে?

অর্ণব ক্লাস করার জন্য বগুড়া থেকে আসত। ক্লাস টেনের ছেলেটা একাই ঢাকায় এসে ফার্মগেটের একটা হোটেলে থাকত। আমার মনে আছে, এক সকালে আমি ভার্সিটিতে বসে আছি। একটু পরে ক্লাস টেস্ট শুরু হবে। তখন অর্ণব ফোন দিল, সে নাকি সকালবেলাতেই চলে এসেছে, একা একা দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে জানে না। এই বিশাল শহরে ক্লাস টেনের একটা ছেলে একা একা দাঁড়িয়ে আছে, সারাদিন তার যাওয়ার মত জায়গা নেই—ব্যাপারটায় কোথায় যেন একটা দুঃখের চিহ্ন আছে।

জুনায়েদ ভাই বলে, অর্ণব যে ব্রোঞ্জ পেয়েছিল—সেটা তার এই ডেডিকেশনের কারণেই।

পিচ্চিগুলোর যথেষ্টই আগ্রহ ছিল। যতদূর মনে পড়ে, খালিদ ভাই আর আমি পরপর দুদিন ক্লাস নিয়েছিলাম, Entropy আর Simple Harmonic Motion নিয়ে। এরপর তাদের মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে গেল! পরের কয়েক সপ্তাহ তারা সবকিছুতে হয় এনট্রপি বাড়তে দেখে, নাহয় কোনো কিছু অসিলেট করতে দেখে! ইরাম এক চুল নড়াচড়া করলেও সবাই হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে ওঠে—ইরাম নড়লেই নাকি এনট্রপি বেড়ে থার্মাল ডেথ হয়ে যাবে!

আইজেএসও ক্যাম্পের রসবোধ পুরোই অন্য পর্যায়ের, বেশ লাগে আমার।

গতবার আইজেএসও টিমটাকে বিদায় দেয়ার সময় রীতিমত কনে বিদায় দেয়ার একটা অনুভূতি হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে টিমটার পেছনে সবাই খেটেছে। একটু একটু করে তৈরি করা টিমকে আইজেএসও-র মঞ্চে ছেড়ে দেয়ার সময় একইসাথে একটা হারানোর দুঃখ, আর কাজ শেষ করতে পারার একটা তৃপ্তি কাজ করছিল।

আমরা ভাবলাম, দেখা যাক কী হয়!

তা, দেখা গেল বটে। এমনইভাবে দেখা গেল যে, আমাদের চোখ রীতিমত ধাঁধিয়ে গেল। স্পষ্ট মনে পড়ে, গতবার ইবরাহিম ভাই যখন আমাকে ফোন দিয়ে উত্তেজিত গলায় বলল, আমাদের টিমটা ব্রোঞ্জ পাইসে, সাথে সাথে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। এরপরের ঘটনাটুকু স্পষ্ট মনে পড়ে না, কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি শিম্পাঞ্জির মত লাফঝাঁপ দিচ্ছি, নিঝুমকে ফোন দিয়ে হুংকার দিচ্ছি, অর্ণব ব্রোঞ্জ পাইসে—এটা বেশ মনে পড়ে!

এই বছর ফোনটা পেয়েছি খালিদ ভাইয়ের কাছ থেকে। তখন আমি ক্লাসে। খালিদ ভাই আমার লাফঝাঁপ সম্পর্কে যথেষ্টই জানে, কাজেই ফোন দিয়ে বলল, এই নোবেল তুমি কিন্তু ক্লাসের মাঝখানে চিৎকার-টিৎকার দিও না! একটা ভালো খবর আছে। তিনটা সিলভার আর তিনটা ব্রোঞ্জ!

ক্লাসের ছেলেপেলেদের কাছে শুনেছি, আমি নাকি তখন উদ্‌ভ্রান্তের মত দৌঁড়ে ক্লাসের পেছন থেকে সামনে ছুটে গেছি, এরপর ফুরিয়ার ম্যামকে কী একটা বলে লাফ দিয়ে বের হয়ে চলে গেছি।

তিন.

SSSBBB, seriously?! আমাদের পিচ্চিগুলো? এখনো স্বপ্নের মত লাগছে ঘটনাটা!

তাহমিদ। রুবাই। আবির। নাফিস। পরশ। সাদি।

শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগছে। নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করছে একেকটা নাম।

So, this is it! THIS is Bangladesh and THIS is how we roll!

তোমরা যারা এখনো বল, এই দেশটাকে দিয়ে কিছু হবে না—তোমাদের জন্য আমাদের অসম্ভব করুণা হয়।

এবং সত্যি বলি, সামনেরবার কেবল রৌপ্যপদকেও আমাদের মন ভরবে না। আমরা সারাটা বছর খাটবো, অমানুষিক খাটবো আইজেএসও টিমটার জন্য। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ব, আমরা নির্ঘুম রাত কাটাব। আমরা অট্টহাসি হাসবো—একের পর এক প্রবলেম সল্‌ভ করার যে পৈশাচিক আনন্দ আছে—সেই আনন্দে আমরা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসবো। মাহবুব মজুমদার স্যার যে বলেন, the great problem solvers are those who attack problems like mad dogs, আমরা হলাম সেই ম্যাড ডগ, we are mad indeed—মুনির স্যার বলেছিল—অমন পাগলের মত আমরা কাজ করে যাবো, আধমরাদের ঘা মেরে আমরা উঠে আসবো, তোতাপাখির পেটে খড়খড় করতে থাকা বিদ্যে দিয়ে যে কিছুই হয় না—ও জিনিস এতদিনে বেশ ভালোই বোঝা গেছে, এই যে ছেলেমেয়েগুলো, কখনো লুকিয়ে, কখনো বাসায় বকা খেয়ে দিনরাত বিজ্ঞানচর্চা করে, এবং শেষ পর্যন্ত একটা আন্তর্জাতিক মঞ্চে মাথা উঁচু করে নিজেদের প্রমাণ করে আসে—এরাই একদিন সবকিছু উলটে দেবে, সবকিছু পালটে দেবে! অন্ধকার একটা আকাশেও নক্ষত্রের মত জ্বলতে থাকে এই ছেলেমেয়েগুলো—অসম্ভব ভালো লাগে আমার।

গতবার আমরা দেখায় দিসি, এবার ফাটায় দিসি, আর সামনেরবার সবকিছু ধ্বংস করে দিবো।

ধন্যবাদ।