আদ্যিকালের বদ্যি বুড়ো
আমি বুড়ো। আদ্যিকালের বদ্যি বুড়ো।
এই কথাটা অবশ্য আমি প্রায়ই বলি। মজা করেই মানুষজনকে বলি, আমি কিন্তু বুড়ো হয়ে গেছি। তার বেশ কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে বটে। আজকাল বুড়োদের সাথে বড় বকবক করি। আগে যখন দেখা হত, নদীর সাথে দুষ্টুমি করতাম, চাচী বসে বসে হাসতো। আর এখন চাচীর সাথে তুমুল আড্ডা দেই, নদী বেচারা হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে।
কী আর করা, আমি আদ্যিকালে ফিরে যাচ্ছি।
ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে ফেলাটা বড় কাজে দিয়েছে। কয়েকশো মানুষের খোঁজ রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না, ওটা মহামানবেরা পারেন। আমি নিতান্তই সাদাসিধে একটা মানুষ। আমি যেটা পারি সেটা হল, আমার আশেপাশের মানুষগুলোর খোঁজ রাখা।
এই তো, অনিমেষ স্যার কেমন আছে সেটা একটু দেখা।
তামান্নার সাথে একটা আইসক্রিম খাওয়া।
আবির ভাইয়ের মাথার পোকাগুলো আবারও নড়েচড়ে বসলো কিনা, একটু খেয়াল রাখা।
তটিনী পিচ্চিটাকে একটু বকা দেয়া, পড়াশোনার জন্য।
পাশের বাসায় গিয়ে অলিন্দর সাথে গম্ভীর ফিজিক্সের তত্ত্ব আলোচনা করা।
আর....
হুম, আর একটু মন খারাপ করা। বেশি না, অল্প কয়েকজনের কথা ভেবেই।
যাকগে, একটু আগে এক পিচ্চির সাথে কথা বলছিলাম। আমাদের পিচ্চিগুলো তো আমাদের মতই পাগল, কাজেই কথা বলতে বড় ভালো লাগে। সবকিছু মুখে বলতেও হয় না, বঙ্কিম যেমন বলেছিলেন, কিছু কথা মুখে, কিছু চোখে, এবং কিছু কথা একেবারেই না বলেও যে সব কথা বলে ফেলা যায়, ওভাবে কথা বলি আমরা।
পিচ্চিটা ফোনে অনেক্ষণ এলোমেলো কথা বলার চেষ্টা করলো। এরপর হতাশ হয়ে বললো, ভাইয়া আমি বোধহয় তোমাকে বুঝাইতে পারি নাই কী বলতে চাইসি!
আমি এদিকে নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছি। হাসছি, কারণ আমি প্রতিটা কথা বুঝেছি, এবং পিচ্চিটার চেয়েও ভালোমতই বুঝেছি। এবং কথাগুলোর একটাও আমার কাছে নতুন না। এটা আমার জীবনের গল্প, এটা খিলগাঁওয়ের গল্প, এটা বরিশালের গল্প, এটা টাঙ্গাইলের গল্প, এমনকি এটা খোদ ময়মনসিংহেরও গল্প। অসংখ্যবার করে গল্পগুলো শুনেছি, এর অর্থ আমি না বুঝলে আর কে বুঝবে?
অথবা সেদিনের কথা, যেদিন মোকাররমের সামনে লাইটপোস্টের নিচে বসে ছিলাম। আমি, আর আমার সাথে একজন বৃশ্চিক। দুজন মিলেই চুপ করে বসে আছি। গালে হাত দিয়ে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে। ফাঁকা রাস্তা, শুধু একটু পরপর চোখের সামনে দিয়ে সাঁই করে একেকটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। আমরা চুপ করে আছি, এবং আমরা কথা বলছি।
দুজন মিলে চুপ করে বসে থেকেও অসংখ্য কথা বলে ফেলা যায়, এবং ঠিক এজন্যই আমার মুখোমুখি কথা বলতে অসম্ভব ভালো লাগে। আমার চেহারা দেখতে ভালো লাগে, প্রোফাইল পিকচারের চেহারা না, সত্যিকারের চেহারা। যেই চেহারায় একশোরকম খেলা দেখা যায়। মানুষটাকে পড়ে ফেলা যায়।
আদ্যিকালে এমন হত। মানুষেরা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কথা বলত। চোখের দিকে তাকিয়ে।
সেই সময়ে চিঠি লিখতে হত। আমাকেও এখন লিখতে হয় বটে। কখনো চিঠি প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেই। কখনো দেই না। কুচিকুচি করে ছিঁড়ে মোকাররমের সামনের রাস্তায় ফেলে দেই। রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আকাশে উড়িয়ে দেই, কাগজের টুকরোগুলো ভাসতে ভাসতে নিচে এসে পড়ে!
বদ্যি বুড়োদের সময়ে মানুষজন একজন অন্যজনের বাসায় যেত। আমি যাই। আগে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে যেতাম, লাইক-লাইক খেলতাম। এখন প্রায়ই পদ্মদের বাসায় একবার ঢুঁ মেরে যাই। আমার ভোক্কস বোনটার সাথে মারামারি করতে হবে না? একটু মারামারি করি, এরপর আন্টির সাথে আড্ডা দেই। কখনো ওরা কেউই বাসায় থাকে না—তাতেও খুব একটা সমস্যা হয় না। পদ্মর নানুর সাথেই আমি বকবক করে চলে আসি। নানুর বয়স বোধহয় সত্তর-পঁচাত্তর হবে, আমারও তো কম হল না, বিশ পার করে ফেলেছি। দুই বুড়োবুড়ি মিলে কুটুরকুটুর করে গল্প করি।
ভালো লাগে বকবক করতে।
ঘুরতেও ভালো লাগে। আগেকার মত, যখন মানুষ চোখ বড় বড় করে দেখার জন্যই ঘুরতো। সেলফির জন্য ঘোরা না, কেবল দেখতে ভালো লাগে দেখেই ঘোরা।
একটা অন্ধকার রাস্তা।
শীতের রাত।
রেললাইন।
গোরস্থান।
আকাশভরা নক্ষত্র।
নানাভাই-নানুর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কালপুরুষকে আকাশে উঠতে দেখা।
সবই ভালো লাগে।
এবং আমার আদ্যিকালে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।
যখন মেয়েরা শাড়ি পরে কপালে ছোট্ট একটা টিপ দিতো।
আর ছেলেরা আমলকি গাছের ছায়ায় বসে থাকতো, আনমনা হয়ে।