পেত্নী


১০ ডিসেম্বর, ২০১৬
ঢাকা, বাংলাদেশ।

প্রিয় নিঝুম,

থাপ্পড় দেয়া দরকার তোকে।

চিঠিটা আরেকটু নরমভাবে শুরু করা যেত, স্বীকার করছি। সত্যি বলতে কী, প্রথমে ভেবেছিলাম তোকে কিছুই বলব না জন্মদিনে। রাত সাড়ে এগারোটায় এসে মনে হল, নাহ, কিছু বলে ফেলা যায়। মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ার এটা একটা অসুবিধা। তুই নিজেও নিশ্চিতভাবে বলতে পারবি না তুই কী চাস।

আচ্ছা, তুই কী চাস?

মাসকয়েক আগে একটা কথা বলেছিলি। খুব সম্ভবত আর্ট সামিটের সময়। তুই নাকি সলিচিউডের ভেতরে পরম শান্তি খুঁজে পেয়েছিস, এবং শাফিন ভাই নাকি এই নিয়ে যথেষ্ট মনটন খারাপ করছে। কথাটা যদি সত্যি হয়, শাফিন ভাইকে ঠিক দোষ দিতে পারবো না। আবার তোকেও দোষ দিতে পারবো না। তুই যেমন টুইস্ট করে সলিচিউডে গেছিস, আমি ঠিক তেমনই টুইস্ট করে সলিচিউড থেকে বের হয়ে এসেছি। এটাকে তুই কী নামে ডাকিস? আমি এটাকে জন্ম বলি। আমার অসংখ্যবার জন্ম হয়েছে। জন্মের প্রক্রিয়াটা কখনই খুব একটা আনন্দদায়ক কোনো ব্যাপার না। অসম্ভব কষ্টের ভেতর দিয়ে একেকটা জন্ম হয় এই পৃথিবীতে—সেটা যে ধরনের জন্মের কথাই বলিস না কেন। কাজেই আমার প্রতিটা জন্মই হয়েছে একেকটা ধাক্কার মধ্য দিয়ে। সেই ধাক্কায় চারপাশের মানুষগুলো কেউ ছিটকে ওদিকে চলে গেছে, আবার কেউ ছিটকে এদিকে চলে এসেছে।

কাজেই তুই যদি এমন একটা ধাক্কা খেয়ে জন্ম নিস, তোকে দোষ দেই কী করে?

তবে তোর উপর আমার মেজাজ খারাপ। যথেষ্ট মেজাজ খারাপ।

আচ্ছা ঐ কথা পরে বলি। হাজার হোক, বেচারা তোর জন্মদিন আজকে। ভালো ভালো কথা বলে শুরু করি।

তোর সাথে আমি প্রথম কথা বলেছিলাম কী একটা কাজ নিয়ে যেন। খুব সম্ভবত সায়েন্স কার্নিভালের প্রশ্ন বানাতে হচ্ছিল আমাদের। তোকে খুবই ভদ্র ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম, তুই প্রশ্ন বানিয়ে দিবি কিনা। এবং তুই ততোধিক ভদ্র ভাষায় জানালি, বানাবি। সেদিনই সম্পর্কটা তুমি থেকে তুই-তে নিয়ে কথা শেষ করেছিলাম। সমবয়সী মেয়েদেরকে তুমি করে ডাকতে আমার রীতিমত আতঙ্ক হয়।

তোর মাথায় যেহেতু যথেষ্ট সমস্যা আছে, বন্ধুত্ব হতেও খুব একটা সময় লাগে নি। একটা মানুষকে চেনা খুব সস্তা কোনো ঘটনা না। তবু, তোকে অনেকখানি চিনলাম। পনেরোর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে, অল্প অল্প করে। প্রচুর বকবক করতি তুই। সেন্ট যোসেফে দুটো সেশন নিয়ে বের হলাম আমরা, এরপর একটা রিকশায় বসে টানা দেড় ঘন্টা বকবক করতে করতে রিকশাওয়ালার কান ধরিয়ে দিলাম।

ঠিক সেই দিনে, ঠিক সেই দিনটাতেই আমার জীবনে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছিল। আলাদা-আলাদা অসংখ্য ঘটনা।

ওটা ছিল ১০ অক্টোবর, ২০১৫।

আমি তোদের কাছে কৃতজ্ঞ, তোদের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের জন্য। আমার সেই জন্মের পেছনে যেই কয়জন মানুষের অবদান আছে, তুই তাদের একজন।

এবং আমি কৃতজ্ঞ, তোর গল্পগুলোর জন্য। গোটা একটা স্কুলজীবন, গোটা একটা কলেজজীবন, জীবনের পুরো আঠারোটা বছর আমি পার করেছি গল্প না শুনে। প্রতিটা মানুষের ভেতরে যে এত আশ্চর্যের একেকটা গল্প থাকে—কে জানতো! আমি মুগ্ধ হয়ে একেকটা গল্প শুনলাম। তখন বলতাম না, শুধু শুনে যেতাম।

এখন কেন যেন গল্প বলি, জানিস। কিছুদিন আগে শিল্পকলার ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলাম। সেখানে বসে পাশের মানুষটাকে টানা একের পর এক গল্প বলে গেলাম, অসংখ্য গল্প।

মানুষের গল্প।

গল্প বলতে বলতে এমন আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম, শিল্পকলায় প্রদর্শনী যে বন্ধ হয়ে যাবে—খেয়াল ছিল না। যখন ছাদ থেকে নিচে নেমেছি, শিল্পকলা একাডেমি অন্ধকার, শুধু দুজন কর্মচারী হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাদের। ভাগ্যিস আমার ব্যাগটা গেটে রেখে গিয়েছিলাম!

আচ্ছা, তোর সাথে ঝগড়া হল না কেন? একটা ঝগড়া করা বাকি ছিল না?

সেদিন প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে ক্যাম্পাস থেকে চলে গিয়েছিলাম। আমি সচরাচর মানুষের উপর এভাবে রাগ দেখাই না। তোর উপর দেখিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, তুই বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে জানিস না।

তোর মত একজন মেয়ের পক্ষে রাত দেড়টার সময় ফোন দিয়ে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করা খুবই অস্বাভাবিক। তবু তুই সেটা করলি। আমার রাগ ভাঙলো না। তিন-চারমাস ধরে যেই ক্ষোভটা জমে উঠেছে—সেটা যদি হঠাৎ করে বেরিয়ে আসে, তাহলে তাকে সামলানো একটু কঠিন হয়ে যায়। আমি সেই কঠিন কাজটা করতে পারি নি।

যেহেতু ঝগড়া হয় নি, সারাবছর তোকে যথেষ্ট ঝাড়ি দিয়েছি। হয়তো এতখানি ঝাড়ি তোর প্রাপ্য না।

ভাবছিস এখন ক্ষমা চাবো ঝাড়ি দেয়ার জন্য? Nope! ঝাড়ি দেয়ার সম্পর্ক আছে এখনো। কাজেই অধিকারও আছে। ভবিষ্যতে যদি আবার মেজাজ খারাপ হয়, আবারও ফোন দিয়ে চেঁচামেচি করতে পারি। জাস্ট মেইক ইট আউট অফ কাউন্ট।

মানুষ বড় অদ্ভুত একটা জিনিস। মানুষের পক্ষেই সম্ভব একইসাথে একজন মানুষকে পছন্দ করা, ঘৃণা করা, শ্রদ্ধা করা এবং চেহারা দেখলে মেজাজ খারাপ করা।

আমি তোকে পছন্দ করি, তোকে ঘৃণা করি, তোকে শ্রদ্ধা করি, এবং তোর চেহারা দেখলে আমার প্রচণ্ড মেজাজ গরম হয়।

আশা করি তোর স্বপ্নগুলো পূরণ হবে। তুই কি জানিস, প্রায় সব মেয়েরই স্বপ্ন পুরো পৃথিবীটা দেখে ফেলা?

সুখী হ, নিঝুম।
ইতি—
নোবেল।

পরিশিষ্ট: দেখেছিস, আসল কথাই তো শেষ হয় নি। ঝড়ের বেগে চিঠিটা লিখলাম। খুবই অদ্ভুত, আমি এমনিতে এত দ্রুত লিখি না। তোর বাসায় যেবার গিয়েছিলাম, তোকে বলেছিলাম, আন্টির সাথে আমার আম্মুর মিল আছে। কথাটা তুই মনে রেখেছিলি, এবং আমার কোনো একটা লেখা পড়ে বলেছিলি, মিল খুঁজে পাচ্ছিস।

কেন যেন ইচ্ছে করে, আন্টিকে নিয়ে তুই একদিন কিছু একটা লিখবি। আমি পড়ব।

এবং আমার ধারণা, তুই পুরো গল্পটুকু লিখতে পারবি না। আমি যে কারণে পারি নি। কিন্তু ওটা আবার অন্য ইতিহাস, আজ এ পর্যন্তই থাক!