তামান্নার কাছে চিঠি

৬ ডিসেম্বর, ২০১৬
ঢাকা, বাংলাদেশ।
ঐ,

​​বুঝছিস, আমার না, লিখতে অনেক ভালো লাগে। প্রতিটা দিন বসে বসে লিখতে ইচ্ছে করে। আর বই পড়তে ইচ্ছে করে।

অবশ্য, লেখাকে পেশা হিসেবে নেয়ার ইচ্ছে কোনোকালেই ছিল না, এখনও নেই।

তবু, যদি লিখতে পারতাম, মনে হয় ভালো হত। মানে, আমার ভালো লাগত আরকি।​

এবং আমার কাছে এখন মনে হয়, আমি কিছু ভুল করেছি। সবকিছু বাদ দিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে। সবকিছু বাদ দিয়েছিলাম। বন্ধু, প্রেম, জীবন, অভিজ্ঞতা—সবকিছুই। পড়াশোনাটা ছিল প্রথম প্রায়োরিটি।

তোদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, আমার মত একজন মানুষের বন্ধু থাকার কথা ছিল না। তবু, তোরা ছিলি। এসএসসির পরের সময়টা, পুরো কলেজ জীবনটাই তোরা আমাকে সাপোর্ট দিয়েছিলি। অদ্ভুত একটা সময় ছিল সেটা। মনে আছে, সারাক্ষণ তোদের সাথে কথা বলতাম? দিনের একবেলা কেউ কথা না বললেই রীতিমত ঝগড়া হয়ে যেত! যেকোন দুজনের মাঝে ঝগড়া হলে তখন অন্য দুজনকে এগিয়ে আসতে হত সেই ঝগড়া থামানোর জন্য।

একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। আমি দাদুবাড়ি যাচ্ছিলাম। আমার তো সবসময়ই মরবিড চিন্তাভাবনা। নানু মারা যাওয়ার পর থেকে সেটা আরও বেড়ে গিয়েছিল (অথবা শুরু হয়েছিল)। প্রতিবার দাদুবাড়ি যাওয়ার আগে তোদের কাছ থেকে রীতিমত বিদায় নিয়ে যেতাম! তো, সেবারও অমনই ‘বিদায়’ নিয়ে দাদুবাড়ি যাচ্ছি। রাতের বেলা, বাসে চড়ে। প্রায় ঘন্টা দশেকের রাস্তা, সারারাত ধরে বাসটা যায়। তোরা সারারাত আমার সাথে আড্ডা দিলি। রাত তিনটা-সাড়ে তিনটার দিকে বোধহয় আমি বাসে বসেই একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ওদিকে অনিক অস্থির হয়ে গেল। যখন আমার ঘুম ভাঙলো, আমার ফোনে অসংখ্য মিসকল, একগাদা মেসেজ!

ফোনের কথা বলতেই মনে পড়ে গেল ফোনগুলোর কথা। গুটগুট করে বোতামগুলো টিপে টাইপ করতে হত। এবং আমরা সেটা করতামও। আমার ফোনটাই ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল টাইপ করতে করতে।

প্রতিদিন সকালে উঠে সবাইকে সবাই সুপ্রভাত জানাতো। সারাদিন কে কী করল, কে কোথায় গেল, দুপুরে ভাত খেল কিনা, কার মন খারাপ, মন খারাপ থাকলে কেন মন খারাপ, এবং যার মন খারাপ তার মন ভালো করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন—তার সবকিছু নিয়েই আমরা বকবক করতাম।

আমি আবারও বলি, আমি কৃতজ্ঞ। এসএসসির পর আমার যেই মানসিক অবস্থা ছিল, আমার পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। শুধু মানসিক অবস্থার কারণেই না, চারপাশের পরিস্থিতির কারণেও। তোরা চারজন, ইনক্লুডিং এ্যালানা, তোরা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলি।

আচ্ছা, এত বকবক করতাম, তবু তুই অনেক কিছুই এড়িয়ে গেলি কী করে? আংকেলের কথা আমরা জানলাম তোর একটা লেখায় কারও মন্তব্য পড়তে গিয়ে। অনিক খেয়াল করেছিল। তোর স্বপ্ন কলাপ্‌স করার কথাও আমরা জানলাম অন্য কারও বলা কথা থেকে। সেটাও অনিক খেয়াল করেছিল। আমরা বলার আগ পর্যন্ত তুই শক্ত ছিলি, বলার পর ভেঙে পড়লি।

চার মাস ধরে কীভাবে শক্ত ছিলি, আমি জানি না। (আচ্ছা, লেখার পর খেয়াল করলাম, আসলেই চার মাস? আমার মনে নেই। অথবা অনেক কিছুই হয়তো অনেক গভীরে লেখা আছে। খোদাই করে লেখার মত, ওগুলো কখনই ভোলা সম্ভব না। আবার চট করে পড়াও সম্ভব না।)

তো, সেটা তো এইচএসসির আগের ঘটনা। তখন আমার মনে হল, মেয়েটাকে চিনতে আমার সময় লেগেছে। তার আগ পর্যন্ত সাদাসিধে একটা মেয়ে মনে হয়েছিল। যে বন্ধুদের ভালোবাসে, প্রচুর ফাজলামি করতে পারে এবং….খুব ভালো truth or dare খেলতে পারে! চৌদ্দ সালের শুরুতে সেই ঘটনার পর বুঝলাম, তুই আরও অনেক কিছুই পারিস।

এরপর, আমরা ভর্তিপরীক্ষা নামক ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে পড়লাম। অনেক কিছুই এলোমেলো হয়ে যাওয়া শুরু করল। জানিস, আমাকে একজন খুব ভালো একটা কথা বলেছিল। এই দিনরাত পড়াশোনা করা নিয়ে। বলেছিল, পড়াশোনা করছিস, কর, খুবই ভালো। কিন্তু বন্ধুগুলোকে যখন ইগনোর করা শুরু করবি, তখন আস্তে আস্তে দেখবি তারা দূরে সরে যাওয়া শুরু করেছে। একটা সময় দেখবি, তারা আর কেউ নেই।

এজন্যই মনে হয় রে, আরেকটু কম পড়াশোনা করতাম। মানুষলোর পেছনে আরেকটু সময় দিতাম। বুয়েটে চান্স পেতাম না হয়তো, না পেলেই বা কী হত?

আমাদের দেশের আসলে কী দরকার, জানিস? চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, বিজ্ঞান চিবিয়ে খেয়া ফেলা মানুষ যে খুবই দরকার—এমন কিন্তু না। এর চেয়ে বেশি দরকার ভালো মানুষ। খুব ভালো কিছু মানুষ। যে সবাইকে ভালোবাসবে। কারও প্রয়োজনে যে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসবে। তার চারপাশে দৌঁড়াতে থাকা মানুষগুলো যদি হোঁচট খায়, তাহলে নিজে দৌঁড় থামিয়ে মানুষগুলোকে হাত ধরে টেনে তুলবে।

আমাদের দেশের অনেক সমস্যা রে। তবু, আমি আমার চারপাশের মানুষগুলার কাছে কৃতজ্ঞ।

কৃতজ্ঞ অনিক আর নিরার চিন্তাভাবনার কারণে।

কৃতজ্ঞ আমাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলোর মানসিকতার কারণে।

জানিস, আমাদের ক্লাসে আমরা যখন খাই, মনে কর, হিন্দু ধর্মের ছেলেটা এক কামড় দিয়ে কেক খেল, এরপর খ্রিষ্ট ধর্মানুসারী মেয়েটা সেখানে আরেক কামড় বসাল, আর তারপর মুসলিম ছেলেটা বাকি টুকরোটুকু কপাত করে খেয়ে ফেলবে!

আমার খুব ইচ্ছা, পুরো দেশের মানুষগুলো এরকম চমৎকার মানুষ হয়ে বড় হবে। তাদের চিন্তাগুলো অনেক সুন্দর হবে। প্রচুর বই পড়বে তারা। আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞান পড়বে, আগ্রহ নিয়ে ধর্মও মানবে, কিন্তু কোনোটাতেই ডুবে যাবে না।

ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি। এজন্য অবশ্য দিনরাত ক্লাসের পড়ায় ডুবে থাকার অভ্যাসটা থেকে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে। তাতে আমার খুব বেশি আপত্তি নেই। আম্মু-আব্বুর অবশ্য ঘোর আপত্তি আছে—ওটা আবার অন্য গল্প। তোকে আর কী বলব, আদ্ধেক কাহিনী তো আগে থেকেই জানিস।

মানুষ বড় রহস্যময় একটা জিনিস, সে বহুদিন পর্যন্ত রহস্য ধরে রাখে। তুই মানুষ। আমিও মানুষ। আমরা কেউ কাউকে বুঝি না। দুজনের কাছেই দুজন রহস্যময়। কিন্তু বন্ধু হিসেবে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা—দুটোই আছে।

এবার আমি খুবই লেইম একটা কথা বলব। এতক্ষণ কী লিখলাম জানিস? রাতে ভাত খাওয়ার পর খাবার ডাইজেস্ট করার জন্য এসব ছাড়লাম। কালকে টার্ম প্রজেক্টের প্রোগ্রেস দেখাতে হবে স্যারকে, কাজেই আমার ম্যালা কাজ! চিঠি শেষ করতে হচ্ছে। কথা অবশ্য শেষ হয় নি, বুঝতেই পারছিস।

হাসতা লা ভিসতা।

ইতি—
পুরনো হয়ে যাওয়া মানুষ, নোবেল।