মিত্রশ্রীর তৃতীয় দিন

আমার যে রাতে হার্ট ভেঙে গিয়েছিল তার পরেরদিন আমি সারাদিন ছবি এঁকেছিলাম।

তার পরেরদিনও আমি সারাদিন ছবি এঁকেছিলাম।

এবং তার পরেরদিনও আমি সারাদিন শুধু ছবিই এঁকেছিলাম।

ভালো লাগছিল আঁকতে।

স্কুলে যেতাম বটে, ক্লাস করতাম না। কী হবে ক্লাস করে?

আমাদের স্কুলে খুব চমৎকার একটা জায়গা আছে। যেই ভবনে আমাদের ক্লাস হয়—সেটার ছাদ। ছাদের দরজা সবসময় বন্ধ থাকে তো, এখানে কেউ আসে না। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে একদিন আবিষ্কার করলাম, দরজার একটা পাল্লা ভাঙা! সেটা সরিয়ে ছাদে উঠে আবার দরজাটা জায়গামত লাগিয়ে দেই, কাজেই বাইরে থেকে বোঝা যায় না ছাদে কেউ আছে।

ছাদের ওপর উঠলে বিশাল একটা মাঠ দেখা যায়। আমাদের স্কুলের মাঠ।

সবাই যখন ক্লাস করত, সেই ছাদটাতে উঠে আমি বসে থাকতাম। একাই। ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগত। ছাদের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আমি একশোরকম চিন্তা করতাম।

আর কী অদ্ভুত, আমি টানা তিনদিন ক্লাস না করে ছাদে বসে থাকলাম, আর সেই তিনদিন টানা বৃষ্টি হল। একটানা না অবশ্য, থেমে থেমে। যখন বৃষ্টি থামত, আমি ছাদের ঠিক মাঝখানটায় বসে ছবি আঁকা শুরু করতাম। আকাশ অবশ্য গুমগুম করে হুমকি দিত, যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামিয়ে দিবে। এবং একসময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেও যেত। আমি কাগজ-পেনসিল ব্যাগে ঢুকিয়ে ছাদের কোণে চলে যেতাম। টিনের চালাটার নিচে দাঁড়িয়ে চুপ করে বৃষ্টি দেখতাম। অর্ণবের মত লাগত, সেই গুনগুন মনের গান বৃষ্টি নামায়, টপটপ ফোঁটা পড়ে অনেক্ষণ।

আমার নাম মিত্রশ্রী। ক্লাস নাইনে পড়ি। স্কুলের নাম বলব না, তবে উত্তরার একটা স্কুল। আমার বাসা কিন্তু উত্তরায় না! আমার মা-বাবা অন্য শহরে থাকেন। আর আমি থাকি স্কুলের হোস্টেলে। খুব যে খারাপ লাগে থাকতে, তা অবশ্য না। আমার একারই বোধহয় খারাপ লাগে না, অন্যদের কিন্তু লাগে। আমি যখন হোস্টেলে আসি, প্রথম রাতে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। আমার রুমে যারা ছিল, তারাও আমার মতই নতুন ভর্তি হয়েছে। সারাদিন মেয়েগুলো বেশ হাসিঠাট্টা করল, একজন অন্যজনের সাথে পরিচিত হল। কিন্তু রাতেরবেলা বাতি বন্ধ করে ঘুমুতে যাওয়া মাত্রই সবাই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করল! প্রথমে দু-চারজনের ফোঁস ফোঁস শোনা গেল, এরপর একজন রীতিমত হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সেই কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে মিথিলা আপুকে ছুটে আসতে হল, উপরতলা থেকে প্রিফেক্ট আপুকে নেমে আসতে হল। এরপর তাদের কান্না থামল।

দোষ দিচ্ছি না ওদের। হঠাৎ আম্মু-আব্বুর কথা মনে পড়লে কেঁদে ফেলা যায়, ওতে পাপ হয় না।

আমি অবশ্য কেঁদে ফেলি না, বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি শুধু।

আম্মু থাকেন ময়মনসিংহে, আর আব্বু কোথায় থাকেন আমি নিজেও জানি না। শুধু জানি, আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন আম্মু-আব্বুর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অবশ্য তার আগে আব্বু একদিন…

আচ্ছা থাক। সে কথা থাক।

আমি স্কুলের ছাদে উঠে বৃষ্টি দেখতাম, এবং ভালো লাগত বৃষ্টি দেখতে, স্বীকার করছি।

আর অসংখ্য কথা এক এক করে মনে পড়া শুরু করত।

ছোটবেলার কথা।

তেমন কোন বিশাল ঘটনা না, একেবারেই সাধারণ একেকটা ঘটনা মনে পড়তো। কী যে ভালো লাগতো সেগুলো মনে পড়লে! অনেক আগে, আমি ক্লাস টু-তে পড়ি বোধহয় তখন, একদিন এভাবেই বৃষ্টি হচ্ছিল। ময়মনসিংহে থাকতাম। তখনও ময়মনসিংহের রাস্তাগুলো ফাঁকা ছিল, রাস্তার আশেপাশে বাড়িঘরও কম ছিল। বৃষ্টির সময় মানুষজন আরও কমে যায়। আমি স্কুল থেকে যখন বাসায় ফিরছি, চারপাশ দেখে মনে হচ্ছিল পুরো শহরে আমি একাই আছি। আর, সেদিন শহরটা কেমন যেন বাদামি ছিল। বৃষ্টির দিনে একটা শহর সোনালি হয়ে যেতে পারে, রূপালি হতে পারে, কিন্তু বাদামি কীভাবে হল? ঠিক মনে পড়ে না এতদিন পরে। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন শহরটা খুব হালকা বাদামি রঙের ছিল। তখন এত ছোট ছিলাম, বাসায় ফিরে আম্মুকে জড়িয়ে ধরতে হত। আ-ম-মু বলে বিশাল একটা চিৎকার দিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরতাম, যেন এইমাত্র অনেক বড় একটা কাজ করে এসেছি। সেদিন বাসায় ফিরে দেখি, আম্মু একটা গাঢ় বাদামি রঙের জামা পরে আছে। আর চুলটা পেছনে টেনে পনিটেল করে বেঁধেছে—কী যে সুন্দর লাগছিল আম্মুকে!

স্কুলের ছাদে দাঁড়িয়ে আমি এসব চিন্তা করতাম।

এবং আশ্চর্য, জীবনে প্রথমবারের মত আমি সবকিছুর অর্থ বোঝা শুরু করলাম। প্রতিটা গানের প্রতিটা শব্দ আমার বিশ্বাস হতে শুরু করল। ছোটবেলায় অসংখ্যবার শুনেছি, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব, সেই ভুলে ভরা গল্প’! ভুলে ভরা গল্পের অর্থ কী, সেটা আমি স্কুলের ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মত বুঝলাম।

এবং আশ্চর্য, জীবনে প্রথমবারের মত আমার মনে হল, আমি একটা ছবি আঁকতে পেরেছি। শুধু পেনসিল না, আমি মনপ্রাণ দিয়ে, সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে একটা ছবি আঁকলাম।

তৃতীয়দিন ছবিটা যখন শেষ হল, তখন বিকেল। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে, কাজেই আকাশ অন্ধকার। ডে শিফটের ক্লাস শেষ হয়ে গেছে বেশ অনেক আগেই, ক্যাম্পাসে তেমন কেউ নেই। বৃষ্টি আসার আগে আগে শোঁ শোঁ করে এক ধরনের বাতাস আসতে থাকে, সেই বাতাসের শব্দেই টের পাওয়া যায় বৃষ্টিটা আসছে।

ছাদের কিনারে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। হাতে আঁকা ছবিটার দিকে তাকালাম।

মনে হল, এই ছবিটা আঁকার পর আমার আর তেমন কিছু চাওয়া থাকার কথা না।

আমি ঠিক করলাম, বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাটা আমাকে স্পর্শ করা মাত্রই আমি খেলাটুকু শেষ করব। ছাদটা উঁচু, যথেষ্টই উঁচু। সাহস করে কাজটা করে ফেলতে পারলে সমস্যা হওয়ার কথা না।

— মিত্রশ্রী
চরপাড়া, ময়মনসিংহ।

পরিশিষ্ট.

মিত্রশ্রীর সাথে আমার দেখা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। লেখাটা পড়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সাহস করে লাফটা দেয় নি কেন। লাফটা দিয়ে দিলে আমি অন্তত তার প্যানপ্যান-পিনপিন আর সারাক্ষণ ভাইয়া-ভাইয়া থেকে মুক্তি পেতাম।

বলেছে, লাফ দেয়ার আগে নাকি গোটা চারেক মানুষের চেহারা মনে পড়েছিল। তার একজন আমি।

অন্য তিনজন যে কারা, কে জানে!