না পিচ্চি - না বুড়ো

জগদীশ বসু একটা গল্পের ফ্যাক্টরি। প্রতিবছর একগাদা গল্পের জন্ম হয় এই ক্যাম্পে, আর জন্ম হয় কয়েকজন মানুষের। গত জগদীশ ক্যাম্পে যাদের জন্ম হয়েছে তাদের একজন আজরা। মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই, তাই পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষের কেউ বলতে পারে না আজরার বয়স কত। তবে মেয়েটার সাথে পাঁচ মিনিট কাটালেই যে কেউ বলে ফেলতে পারবে, আজরার বয়স কমবেশি একশো বছর, কিংবা তারও বেশি। ক্যাম্পের এমন কোন বুড়ো নেই যে আজরার কাছে বকা খায়নি। বকা খাওয়ার কারণগুলোও বড় গুরুতর। শাফিন ভাই বকা খেয়েছে, কারণ সে জলের গান শোনে না। আমি খেয়েছি, কারণ মেকানিক্সের লেকচারটা কঠিন হয়ে গেছে। ইবরাহিম ভাই খেয়েছে, কারণ সে আজরার খাতা লুকিয়ে রেখেছিল।

আমার এই বুড়ো বোনটা অবশ্য পড়ে ক্লাস সেভেনে। গার্লস ক্যাম্পের শেষদিনের লেকচারগুলো যখন আধ্যাত্মিক পর্যায়ে চলে যেতে শুরু করল, তখন বুড়োটা হতাশ হয়ে ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে পড়ল। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম, জগদীশ বসুর কল্যাণেই কিনা কে জানে, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম কী ভাবছে পিচ্চিটা। তার পাশে বসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ক্লাস কি কিছুই বুঝতেসিশ না? পিচ্চিটা বিশাল চশমার ভেতর দিয়ে বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, না ভাইয়া! আমি তৃপ্তির একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললাম, তবে আয়, আড্ডা দেই। তানভীর ভাইয়ের বাকি ক্লাসটুকু আর আমাদের শোনা হয়নি, কীভাবে যেন গল্পটা জমে গেল। পিচ্চির আগের কাকাতুয়াটা তার নানাভাইকে দেখে ভয়ে উড়ে গিয়েছিল, এবার জন্মদিনে নতুন দুটো কাকাতুয়া এসেছে। আজরার ইচ্ছে, কাকাতুয়াকে শেখাবে কীভাবে এ্যারিস্টটলকে পচাতে হয়। বড় পুণ্যের কাজ হবে সেটা।

আমি জানতাম না আজরার জন্মদিন। রিয়া বাঁদরটার জানানোর কথা, ঘৃতকুমারীর প্রভাবে বুদ্ধির ঢেঁকিটা দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। কাজেই রাত সাড়ে ন'টায় আবির ভাই যখন জিজ্ঞেস করল আজ আজরার জন্মদিন কিনা—তখন যথেষ্টই আশ্চর্য হয়েছিলাম। কী আর করা, ফোনেই খানিকক্ষণ আড্ডা দিলাম আমার বুড়ো বোনটার সাথে।

প্রখ্যাত ছোটগল্পকার ও আবেগে ভারাক্রান্ত লেখক ওমর ফারুক বলেছিলেন, মেয়েদের বয়স হয় না, ক্লাস হয়। যেহেতু ক্লাসের হিসেবে আজরা এখনও পিচ্চি, সে বাসা থেকে বেরিয়ে আমাদের আড্ডায় যোগ দিতে পারে না। আর যেহেতু সে আড্ডায় আসে না, জগদীশ ক্যাম্পের পর বহুদিন তার দেখা পাইনি। এবার যখন দেখা হল, ততদিনে কয়েকটা মাস পেরিয়ে গেছে।

ততদিনে....
ততদিনে আমি একটা বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছি, ইবরাহিম অন্ধকার টানেলের শেষপ্রান্তে এসে আলোর রেখা দেখতে শুরু করেছে, যারা অলিম্পাসের কাছাকাছি পৌঁছেছে তারা মুগ্ধ হয়ে আবিষ্কার করছে—জুনায়েদ ভাই প্রায় জিউসের কাছাকাছি চলে গেছে, আর ওদিকে আরিফ-আকিব-রিয়া-তটিনী শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে, বিশাল একটা ঝড় আসার আগে সবকিছু যেমন শান্ত হয়ে যায়—অমন চুপচাপ হয়ে আছে ওদের চারদিক, জগদীশ বসু থেকে কাটছাঁট করে গল্পের মূল চরিত্রগুলো দাঁড়িয়ে গেছে, তাই কয়েকজন মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখছে, কী হয়, কী হয়, আর ঠিক এমন সময়, এক বিকেলে ঝড় আসার আগমুহূর্তে আমি হুড়মুড় করে একটা ঘরে ঢুকলাম, আর আমাকে দেখে আজরা ফিক করে হেসে বলল, ভাইয়া কেমন আছো?

আমিও হেসে ফেললাম। বললাম, ভালো আছি।