অথৈ সমুদ্র


এক.

আঠারোই মার্চ নিয়ে যে লিখতে পারে—সে হয় দুঃসাহসী, নাহয় গাধা। নিঃসন্দেহে আমি দ্বিতীয় দলে।

মেয়েটাকে আমি প্রথম দেখি বছর দুয়েক আগে। জগদীশ বসু ক্যাম্পে। তেমন কোন বিশেষভাবে না, যে মুহূর্তে সবাই প্রথমবারের মত তাকে খেয়াল করল, আমিও করলাম। (মুদ্দাসসেরকে কি এজন্য একটা সাধুবাদ জানানো উচিত? উচিত বোধহয়।)

পনেরোর সেই সেপ্টেম্বরে আমি সমুদ্রের অনেক, অনেক উপর দিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, সমুদ্রের গভীরে যে কিছু আছে—এই নিয়ে আমার ধারণা ছিল না। কাজেই আমার বিশ্বাস, মেয়েটার সাথে যদি প্রথমবার পরিচয় না হত, কখনই দ্বিতীয় পরিচয়টা হত না।

এবং অবশ্যই তৃতীয়, চতুর্থ এবং অসংখ্যবারের মত পরিচয় হত না, অবশ্যই না।

অনেক ওপর দিয়ে যারা উড়ে বেড়ায়, তাদের পক্ষে সমুদ্রের গভীরে থাকা মানুষগুলোর সাথে যোগাযোগ করা কঠিন। কাজেই মেয়েটার সাথে আমার কখনই কথা হয়নি। কেবল ক্যাম্পের শেষদিন, সেই ঘোরলাগা সকালে চলে আসার আগে বলে এসেছিলাম, ভালো থাকিস। এমনিই বলেছিলাম, সাদাসিধে ভদ্রতা যেটাকে বলে।

সমস্যাটা শুরু হল…

আগস্টে? সম্ভবত। পুরো একটা বছর পার করে, আগস্টের এক সকালে আমরা ক’জন একটা স্কুলের গেট পার করে ভেতরে ঢুকলাম, আর গেটের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে প্রথমে চোখ বড় বড় করে তাকাল, চাপা একটা চিৎকার দিল, এরপর মুখে দুই হাত চেপে হেসে ফেলল!

আমি আর আবির ভাই চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটাকে আমরা চিনি। বছরখানেক আগে এক ঘোরলাগা সকালে বলে এসেছিলাম, ভালো থাকিস।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অথৈকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছিস?

দুই.

অথৈ হল সেই মানুষদের একজন, পুরো পৃথিবী উলটে গেলেও যারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে।

অবশ্যই, সেটা কেবল ক্ষেত্রবিশেষে সত্যি।

কেননা, তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আমি যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, দুইশো পিচ্চির মধ্যে একজনই পেছন থেকে ডেকেছে। ‘ভাইয়া ছাতা নিয়ে যাও, বৃষ্টি’!

আহা, এতদিন পর কথাগুলো কেন মনে পড়ছে?

সেবার, ক্যাম্পের মাঝখানে চুপচাপ বসে ছিলাম। আমাকে বসে থাকতে দেখে পিচ্চিটা খাতা খুলে একটা সাদা পৃষ্ঠা বের করল। ওখানে নাকি আমাকে হিজিবিজি আঁকতে হবে। কী আঁকতে হবে জানি না, তবে পুরো পৃষ্ঠাটা ভরে ফেলতে হবে।

শেষ পর্যন্ত কী কী এঁকেছিলাম, ঠিক মনে নেই। তবে Across The Universe-এর প্রথম চারটা লাইন লিখেছিলাম কোন এক জায়গায়—বেশ মনে পড়ছে। আর বুড়ো আঙ্গুলের একটা ছাপ দিয়েছিলাম।

খুব অদ্ভুত লেগেছিল, যখন ক্যাম্পের শেষদিন সন্ধ্যা নামতে শুরু করল। টাঙ্গাইলের এক গার্জিয়ানের ব্যবহারে সবাই যথেষ্টই কষ্ট পেয়েছিলাম, ক্যাম্পটা শেষ করে স্কুলের মাঠে বসে ছিলাম। আমরা বসে আছি, আমাদের সাথে অথৈও বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, বাসায় যাবি না? বলল, যাব। এবং কথাটা বলেও সে স্কুলেই দাঁড়িয়ে থাকল।

বের হল, ঠিক যখন আমরা বের হলাম। চোখমুখে রাজ্যের আঁধার নিয়ে পিচ্চিটা একটা রিকশায় উঠে বসল।

ঢাকায় ফেরার তাড়া, কাজেই খুব বেশি কথা না বলেই আমরা ফিরে এলাম।


তিন.

“দর্শনেও সবকিছু আপেক্ষিক ধরে নিলে হয়তো ব্যাপারটা সহজে ব্যাখ্যা করা যায়— কেন ঐ পিচ্চিটার সামনে মাঝেমধ্যে নিজেকে রোবট মনে হয়। জীবনে মাত্র দুইবার যেই মানুষগুলোকে তুমি দেখেছো, তাদের জন্য যদি তোমাকে লুকিয়ে কান্নাকাটি করা লাগে— তাহলে তোমার সাপেক্ষে বাকি মানুষেরা নিতান্তই সাদাসিধে একেকটা রোবট। আমি রোবট, আমরা রোবট।

পিচ্চিটা গতকাল থেকে সমানে ফোনে টেক্সট দিয়ে যাচ্ছে, কী উত্তর দিবো জানি না। এতটা ভালোবাসার ক্ষমতা নিয়ে জন্মাতে পারলে বর্তে যেতাম।”

(১৫ আগস্ট, ২০১৬)


চার.

খুব দ্রুতই আমি সমুদ্রের গভীরে ডোবা শুরু করলাম।

সেবার আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আমি নিজেও অদ্ভুতুড়ে একটা সময় পার করছিলাম। আমার বিশ্বাস, ঠিক সেই সময়টা থেকেই আমার কাছে কয়েকটা শব্দের অর্থ পরিষ্কার হতে শুরু করল। একের পর এক মেইল, ফোন, পুরো একটা ঝড়ের মত সবকিছু ওলটপালট করে দিল!

সেটা নিয়ে হয়তো একটা উপন্যাস লিখে ফেলা যাবে।

কিন্তু সেই ঝড়টার সাথে হুড়মুড় করে যে কয়জন মানুষ আমার ইউনিভার্সে ঢুকে পড়েছিল, তাদের একজন অবশ্যই অথৈ। আমার গাধা পিচ্চিটা। যার অনেক দায়িত্বের মধ্যে একটা হল, বুড়ো ভাইয়াটার কথা মনে করে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্নাকাটি করা। ওমর অবশ্য টেনেটুনে এটাকে ঢঙ বলার চেষ্টা করে। আমি বলি, অভিমান।

গাধাটার সাথে কতদিন দেখা হয় না, আমি নিজেও জানি না। ভাইয়ার কাছে দুদিন পরপর বকা খাওয়ার ইচ্ছেটা আদৌ পূরণ হবে কিনা—সেটাও জানি না। তবে, একুশ বছরের জীবনে একটা জিনিস খুব ভালোমতই দেখেছি—যেই মানুষগুলো বেহিসাবীর মত ভালোবাসা বিলিয়েছে, তারা বেহিসাবীর মত ভালোবাসা ফিরেও পেয়েছে। ওটা বোধহয় সুখের ডেফিনিশন, যদি না ভুল করে থাকি।

শুভ জন্মদিন অথৈ। চিন্তা করিস না, একদিন ঠিকই গানটা গেয়ে চমকে দিব!

পরিশিষ্ট (যাদের জন্য প্রযোজ্য).

অথৈকে নিয়ে জানতে চাইলে ওমরের অথৈ কড়চা এবং শুভ জন্মদিন পড়তে পারিস।