বৃত্তের ভেতরে


“কোথাও নেই ঝুম ঝুম অন্ধকার, তক্ষক ডাকা নিশুতি
রূপকথা শুনে শিউরে ওঠে না গা
স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলী ফুল
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল;
গোটা শহর বাতি জ্বেলে সতর্ক
পায়ে পায়ে হারাবার জায়গা খুঁজে মরি…”

আচ্ছা, এই শহরে কি হারানোর জায়গার সত্যিই অভাব?

বেশ কিছুদিন হল, অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে আমি হারিয়ে গেছি। এবং অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, রাস্তা পাওয়ারও চেষ্টা করছি না আমি। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হারিয়ে যাওয়াই বরং কঠিন, আমি রাস্তা খুঁজে না পেলেও রাস্তা ঠিকই আমাকে খুঁজে নেবে।

কাজেই সোডিয়াম আলোকে আড়ালে রেখে, একটা অন্ধকার গলিতে চুপ করে বসে আছি। মানুষের কণ্ঠ কানে এলে পালিয়ে অন্য একটা গলিতে ঢুকে পড়ছি।

জানি, এভাবে খুব বেশিদিন চলবে না। কারো না কারো হাতে তো ধরা পড়তেই হবে, প্রজ্ঞা তো তাই বলে।

দু-চারদিন আগে রিয়ার ব্লগে ঢুকে দেখি, পুঁচকে মেয়েটার বেশ উন্নতি হয়েছে। এদ্দিন আমিই কেবল একচেটিয়া নিষেধাজ্ঞা জারি করে যেতাম, আজকাল মেয়েটা উল্টো আমার জন্য লেখা নিষিদ্ধ করতে শুরু করেছে।

কী আর করা। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ শিরোনামটা দেখে চলে এলাম। “বৃত্তের বাইরে”। মনে মনে বললাম, সেদিনের শিশু, তুই ব্যাটা বৃত্তের কী বুঝিস।

তবে, কথাটা বড্ড মনে ধরেছে। বৃত্তের বাইরে, বৃত্তের অনেক অনেক বাইরে, কোথাও…আমি হারিয়ে গিয়েছি। কেন হারিয়েছি, কখন হারিয়েছি—এটার চেয়েও জরুরি খবর হল, হারিয়ে গিয়েছি।

উম, না, একটু ভুল বললাম। কেন হারিয়েছি, সেটা ইম্পর্টেন্ট। এখানে একটা সুবিধা নিতে পারি, গত কিছুদিন যে অসংখ্য এলোমেলো লেখা হয়েছে, সেখান থেকে উদ্ধৃতি মেরে দেই।

আমি লিখছিলাম,

“…এই পরাবাস্তব জগতটার জন্যই কিনা কে জানে, আমার খুব ইচ্ছে করছে একটা শুদ্ধ মানুষ খুঁজে বের করতে। শুদ্ধ বলতে কিন্তু অপাপবিদ্ধ মানুষের কথা বলছি না।
শুদ্ধ মানুষের অর্থ, একটা পূর্ণ মানুষ, যে মনে যেটা চিন্তা করছে মুখ দিয়েও ঠিক সেটাই বলবে।
একটা বাচ্চা মনে যা ভাবে, মুখ দিয়েও সেটাই বলে ফেলে। বড়রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলে না। সমাজে বেঁচে থাকতে চাইলে কি এই মুখোশটা পড়ে থাকতে হয়?
আমি মুখোশ পছন্দ করি না, কাজেই চারপাশে মুখোশপড়া মানুষ দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। সত্যি বলতে কী, শুধু ক্লান্ত না, আমি রীতিমত আতঙ্কিত।
… … … … …
কাজেই আমি খুঁজে বেড়াই, পরাবাস্তবতার ঘোরে, একটা শুদ্ধ মানুষ, কোথাও, একটা…”

একটা বৃত্তে বন্দী থাকলে বোঝা যায় না বৃত্তটা কেমন, কোন বিন্দুটা ঠিক কোথায় আছে। কাজেই যারা ‘খোঁজে’, তারা সবাই একটা সময় বৃত্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে।

তারা হারায়।

তারা হারায়, সিদ্ধার্থের মত। হারিয়ে বোঝার চেষ্টা করে বৃত্তগুলোকে। হারিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে বিন্দুগুলোকে।

সিরিয়াসলি, এই বৃত্তের সবার মুখেই একেকটা মুখোশ? তাই কি হয় কখনো?


পরিশিষ্ট ১
বৃত্ত থেকে বেরুবার আগে আমি কেবল দুটো ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চেয়েছি।

প্রথমত, এই বৃত্তে আমি দেবতা হতে চাই না, আমার খুব বেশি ইচ্ছে করে মানুষ হতে। ওদের সামনে। মানুষ হতে।

আর দ্বিতীয়ত, দেবতা, প্রমিথিউস কিংবা মানুষ—যা-ই বলি না কেন, সেটার প্রয়োজন এক সময় ফুরাতে হত। একটা সময় বেলা ফুরাতো, সন্ধ্যা ঠিকই নামতো।

সেই সন্ধ্যা নেমেছে।


পরিশিষ্ট ২
শেষ করার আগে একটা প্রশ্ন রেখে যাওয়াটা খুবই উচিত হবে বলে মনে হচ্ছে। ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে—আর তখন কী হয়, মনে আছে?

কারো যদি খুব বেশি বিভ্রান্ত লাগে, তাহলে আরেকটু বলি। রবিঠাকুর যে বলতেন, ‘তোমারে দাও, আশা পুরাও, তুমি এসো কাছে’—এখানে এই ‘তুমি’-টা কে? ইনিই কি স্রষ্টা, নাকি কোনো মানুষের উদ্দেশ্যে কথাটা বলা?

এই ব্যাপারে আমার সোজাসাপটা মত হল, এটা দুজনের প্রতিই ভালোবাসার প্রকাশ। এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই, কারণ স্রষ্টা ছাড়া যেমন মানুষ অসম্ভব, তেমনই, হয়তোবা, মানুষের সৃষ্টিতেই স্রষ্টার পূর্ণতা। কাজেই দুজনকেই যে একই ভাষায় ভালোবাসা যাবে—এতে আর আশ্চর্যের কী!

কাজেই, সন্ধ্যা নামে বটে, কিন্তু তখন…

যদি এখনো বিভ্রান্ত লাগে, তাহলে আরেকটু বলি। রবিঠাকুর তখন বললেন, ‘কাঁদে তখন আকুল মন, কাঁপে তরাসে।’ আমি এটার অর্থ করছি এভাবে যে, সবাই কাঁদে। কেউ কান্নার মুখোশ পড়ে কাঁদে, আর কেউ মুখোশের আড়ালে কাঁদে।

তবে কিনা, মুখোশের হাসিকান্নায় আমার কিছু যায় আসে না, আমার কনসার্ন মুখের হাসিকান্না নিয়ে…