এলোকথন (ভাদ্রপদ ১)

গোল্লায় যাক সব কাজকর্ম!

এই কাজগুলোকে আকিব ঠাট্টা করে ‘বানাবিস’—বা এমন কোনো একটা নামে ডাকে। তা, দিনরাত ‘বানাবিস’-এর কাজ করলে মাথা গরম হবে না কেন। ওহ, মাথাটা যেন বনবন করে ঘুরছে, ভীষ্মলোচন শর্মা গান গেলে বোধ করি এমনটাই হত।

আজ রাতের মত কাজকর্মকে গোল্লায় যেতে বলার কারণটা ছোট এবং খানিকটা অদ্ভুত। ঘরের সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে হঠাতই একটা পুরনো গান মনে পড়ে গেল। আম্মু ছোটবেলায় অনেক গান শুনতো। মানে, আমি যখন ছোট, তখন। আমাদের বাসায় একটা উদ্ভট যন্ত্র ছিল। বিশাল দেহ, আর দুপাশে দুটো বিশাল সাউন্ডবক্স। রেডিও থেকে শুরু করে ক্যাসেট—সবই শোনা যেত সেটাতে।

আমার সকালে ঘুম ভাঙতো ওটার রেডিও শুনে। আব্বু সকাল সাতটায় বিবিসি বাংলার খবর শুনতো। খবরগুলো তো মনে নেই, তবে প্রতিটা খবরের মাঝে ছোট্ট একটা সলো বাজতো—বেশ মনে আছে!

আর সন্ধ্যেবেলা আম্মু ওখানে ক্যাসেট বাজিয়ে গান শুনতো। খুব সুন্দর কিছু ক্যাসেট ছিল আমাদের—ওসব কোথায় যে গেছে, কে জানে। আমার ছোটবেলার যত স্মৃতি মনে পড়ে, তার অর্ধেকেই আম্মু গান গাচ্ছে বা শুনছে—এমন একটা দৃশ্য চোখে ভাসে। আম্মু গানটান কখনো শিখেছে বলে জানি না, তবে গুনগুন করে যখন গাইতো, শুনতে বেশ লাগতো। কে জানে, গান নিয়ে আমার অবসেশনের ভিত্তিটা আম্মুই তৈরি করে দিয়েছে কিনা!

Ah, music, music. A magic beyond all we do here.

আম্মু হেমন্তের একটা গান গাইতো, ‘শোনো, কোনো একদিন আকাশ বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়!’ তখন এই গানগুলোর মর্ম তেমন একটা বুঝতাম না। মনে হত, দূর কীসব গান শুনছে আম্মু!

একুশটা বছর পার করে যখন হিসেব মেলানোর চেষ্টা করি, তখন মনে হয়, আম্মু যদি ওভাবে আমাকে তৈরি না করতো, আজ কোন আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকতাম কে জানে!

আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একজন শিল্পী বাস করে। বাস করে বলেই পৃথিবীর যা কিছু ‘সুন্দর’—তা আমাদের টানে। ক্লাসের সবচেয়ে নার্ড ছেলেটাও বৃষ্টির দিনে মুগ্ধ হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, সবচেয়ে বেশি সেজেগুজে থাকা মেয়েটাও কোনো এক রাতে জোছনা দেখে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।

আমাদের সমাজ অবশ্য এই শিল্পীটাকে গলা টিপে হত্যা করতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটা জন্তুর সাথে মানুষের পার্থক্যই তো এই জায়গায়, একটা কুকুর কখনই সমুদ্র দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলে না, ‘ঘেউ!’ মানুষ হয়, যা কিছু সুন্দর তা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়। কাজেই শিল্পীসত্ত্বাটা মরে গেলে মানুষের সাথে জন্তুর তেমন কোনো প্রভেদ থাকে না।

এই সমাজ নির্ঘাত আমাকে জন্তু বানিয়ে ছাড়তো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যা কিছু সুন্দর—তা দিয়ে যদি আম্মু আমাকে ঘিরে না রাখতো, এই ধরো, ওপাশে রবি, একদিকে হেমন্ত, অন্যদিকে সুনীল—এদের দিয়ে আম্মু যদি ঘিরে না রাখতো, নির্ঘাত আমি ঘেউ হয়ে যেতাম।

আমি কিন্তু ঘেউ দেখেছি আমার চারপাশে। বিশ্বাস কর, আমি অনেক ঘেউ দেখেছি। কুকুরের ঘেউ না, মানুষের ঘেউ। সুন্দর কিছুই তাদের টানে না। আলী আকবরের সরোদ শোনাও ওদের, মুখ বাঁকিয়ে চলে যাবে। বিকেলবেলার আকাশ দেখাও, চোখ নামিয়ে ফেসবুক গুঁতোবে। আকাশ নীল, ফেসবুকও নীল, তা ঠিক বটে, ছেলেটার নাকি ফেসবুক চালাতে ভালো লাগে, আমাকে বলেছিল, আমার কী যায় আসে, কিন্তু…

নাহ, থাক। আর বলে কাজ কী! আকাশ আর ফেসবুকের নীলের পার্থক্য কি আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বোঝানো যায়!

deep inside, আমাদের সমগ্র সত্ত্বা, পুরো বিজ্ঞান শাস্ত্রই তো দাঁড়িয়ে আছে দর্শনের ওপর, কিছু স্বীকার্য, স্বতঃসিদ্ধ, কী আর বলব, শেষপর্যন্ত অনেককিছুই থাকবে হোরাশিও, তোমার কল্পনার বাইরে স্বর্গ ও মর্তে অনেককিছুই থাকবে, কাজেই সবকিছু তুমি যুক্তি দিয়ে উদ্ধার করতে পারবে না, কিছু জিনিস থাকবেই তোমার যুক্তির উর্ধ্বে।

সবকিছু যুক্তিগ্রাহ্য না, তবে কি ওসব হৃদয়গ্রাহ্য?

উমম, তার প্রায় সবই হৃদয়গ্রাহ্য, কিন্তু…না, এই ফিলোসফিতে আজ পুরোপুরি ঢুকবো না, কারণ আমার হেমন্তকে নিয়ে দু-চারটে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।

কী অবস্থা, স্মৃতি থেকে গান, গান থেকে দর্শনে ঢুকে সেখান থেকে আবার গানে ফেরত আসছি। লেখার মাথামুণ্ডু কিছুই আস্ত আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ভরসা এই যে, আমি পাগল, এবং যারা এই লেখাটা পড়ছে, যদি না দুর্ঘটনাক্রমে আমার ব্লগে এসে থাকে, তবে তারাও পাগল। কাজেই সমস্যা হবার কথা না।

যাকগে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা বলছিলাম। এই মানুষটা একাই নাকি বাংলা গানের জগতে একটা বড় ওলটপালট করে দিয়েছিলেন। আগে কখনো খেয়াল করে দেখিনি, সেদিন কবীর সুমন চট্টোপাধ্যায় বলার পর আলাদা করে খেয়াল করলাম। একটা সময় ছিল, যখন বাংলা গানের উচ্চারণ অনেকটা আদিমযুগে পড়েছিল (ঐ যে, নজরুল যে ভাঙা-ভাঙা গলায় ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ গেলেন—অনেকটা সেই উচ্চারণ)। হেমন্ত এসে নাকি পুরো ব্যাপারটা এলোমেলো করে দিলেন। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ব্যাপারটা সেদিন, আর সাথে সাথে হেমন্তের প্রতি শ্রদ্ধাটা অনেকখানিই বেড়ে গেল।

সেদিন আমি আর সুরভী আন্টি হেমন্তকে নিয়ে এক জ্ঞানগম্ভীর আলোচনায় অবতীর্ণ হয়েছি, তাই শুনে পদ্মও উল্টে পড়ে গেল। ওসব নাকি বুড়ো মানুষের গান। তারপর অবশ্য পিচ্চিটা একটা ভুল করে ফেলল। আমাকে বলল, ডেসপাসিটো শুনবা।

আহ, এরপরের ঘটনা আর কী বলব। বলতে গেলেও হৃদয়ে শিহরণ জাগে, আমি আর আন্টি মিলে কী পচানিটাই না দিলাম পদ্মকে।

কিন্তু, একটা বয়সে কি সবারই এমন হয়? ছোটবেলায় আমিও বসে বসে এসব পপ গান শুনতাম। আব্বু আমাকে বলেছিল, ‘যেদিন রবীন্দ্র ভালো লাগবে সেদিন বুঝবি!’ তখন আসলেই বিশ্বাস করিনি কথাটা, কিন্তু কী অদ্ভুতভাবে সবকিছু ফলে গেল।

যাকগে। পদ্ম পিচ্চিটার উন্নতি হোক, মানুষ হোক। আন্টি তার গুরুদায়িত্ব এবং আমরা লঘুদায়িত্বগুলো সার্থকভাবে পালন করি।

আর কিছু? এটা সার্থক একটা এলোকথন হয়েছে বটে, কথা যে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে—আমি নিজেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না।

এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে ফেলতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু আরিফ-আকিব বেচারা দুটো সোফির জগৎ পড়েনি এখনো। বেচারাদের আপাতত স্পয়লার না দেই।

(বিশ্বাস কর আর নাই কর, এই দুই উজবুকের জন্য গত দুইদিন ধরে আমার লেখা ছেঁটে ফেলা লাগছে। কারণ উজবুক দুটো সোফির জগৎ পড়েনি এবং তাদেরকে স্পয়লার দেয়াটা এথিক্‌সের মধ্যে পড়ে না।

বড় যন্ত্রণায় পড়লাম তো?)