এলোকথন (ভাদ্রপদ ২)

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মানুষের সাথে আকাশের একটা সম্পর্ক আছে।

সারা দুপুর বসার ঘরে কাজ করছিলাম। যেই ঘরের জানালাটা বহুকাল আগে মরে গেছে, খালা হয়তো মাসে একবার সবাইকে মনে করানোর চেষ্টা করে, জানালা মরে নাই, খালার অসামান্য চেষ্টার পর ফাঁকফোঁকর দিয়ে সামান্য একটু আলো ঢোকে, সেই আলোতে ঘর আলো হয় না, বরং অন্ধকারের কথাটাই নতুন করে মনে পড়ে যায়, খালা জোর গলায় দাবি করে, দু হাত তুলে চিৎকার করে, জানালা মরে নাই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না, যে জানালা দিয়ে অন্ধকার আসে, সেটা আমার কাছে মরে গেছে, সেই বছর উনিশ আগে, সেই উনিশ বছর আগে যখন আপুর সাথে এই বাসায় ঢুকেছিলাম, তখন থেকেই…

এইসব জানালা, ওরাও তো প্রতীকী বটে, কেন বসার ঘরের জানালাটাই অকালে মরে যাবে, কেনই বা আমার ঘরের জানালাটা অকালে বেঁচে থাকবে, জ্যান্ত জানালা, মৃত জানালা, সবাই মিলে আমার চিন্তাকে আক্রমণ করবে, বারবার করে বলবে, ওরাও নাকি প্রতীক, কী যেন ছাই, মেটাফোর, জানালাগুলো একেকটা মেটাফোর, শিকলদেবীর পূজার বেদী ভাঙতে আলোটুকু তো লাগবেই, ও-ঘরে দেবী জন্ম নেবে, আমার ঘরে এসে অপঘাতে মরে যাবে…

কাজেই, চৌকো জানালার বাইরে যে চৌকো আকাশ, সেই আকাশের সাথে আমাদের সম্পর্ক না থেকে যায় কী করে? অন্তত, যদি খুব বেশি করে চাই যে, দেবীর কপালে অপবাদ না জুটলেও অপঘাতটুকু জুটুক?

আহ, সৌমিকের চিন্তাকে চৌকো কফিনে আটকানো যেতো, মামার হৃদয়কে আটকানো গেলো না, কাজেই সৌমিক নিজের অজান্তেই বের হল চৌকো কফিন থেকে, এবং ঠাঁই নিলো চৌকো ঘরে, অর্থাৎ আরেকটু আকাশ…

এবং আরও একটু আকাশ, অবশ্যই তোমার ঘরে, কারণ আমি আশ্চর্য হয়ে দেখি, সেটা কেবল আমার কল্পনার চেয়ে বড় না, সেটা আমার বাস্তবের চেয়েও বড়, এতখানি আকাশ, হোক না ঘরটা এলোমেলো, সেটা আকাশ, অনেকখানি আকাশ…

এবং একারণেই আমার বারবার করে বলতে ইচ্ছে হয়, এই যে দুটো সত্ত্বা নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি, একদিকে শতশত মানুষের সাথে জাগতিক কাজকর্ম, কংগ্রেস, ছুটছে মোটর ঘটর ঘটর, ইবরাহিম ভাইয়ের নিশ্চিত রাস্তা, ডানদিকের মোড়, যেই মোড় ঘুরলেও বাজার, না ঘুরলেও বাজার, অবশ্যম্ভাবী কোলাহল—ওসব একদিকে, আর অন্যদিকে আমি, তুমি, সে, অনেকগুলো সে, ওটা আরেকটা পৃথিবী, যে পৃথিবীতে আমরা হয়তো অদ্বিতীয় না, কিন্তু অতৃতীয়, আমরা অচতুর্থ, হয়তো অপঞ্চম…

অপঞ্চম?

আমার শান্ত পৃথিবী? সেই যে, চাঁদের আলোয় ক’টা মানুষ পাশে বসে জীবন পার করে দিবো—সেই তত্ত্ব?

নাকি ঠিক এখানেই ঘুরেফিরে পরাবাস্তবতা? পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে যাওয়ামাত্র যেই পরাবাস্তবতার ঘোর আমাদের আক্রান্ত করে, জীবনানন্দের ভাষায়, ক্লান্ত, ক্লান্ত করে…

কিন্তু তারপরেও, আকাশের সাথে মানুষের একটা সম্পর্ক আছে। যেকারণে তুমি এবং সে-এর পার্থক্যটা আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। সত্যি বলতে কী, ক্ষেত্রবিশেষে অনেক দৃষ্টিকটু হয়েই ধরা দেয়…

কী আর করব, প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই আকাশ খোঁজার চেষ্টা করি, বড় বাজে স্বভাব আমার…

হয়তো একারণেই, সজীব ভাই আজকে ভুতুড়ে একটা কথা বলার পর আমি ততোধিক ভুতুড়ে এক উত্তর দিলাম, বললাম যে, এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছি…

সজীব ভাই হয়তো বকে দিতো খুব, বলতো, মাটির দেয়ালে পানি দে…

বকেওছে। অনেকবারই বকেছে। কিন্তু কোন এক কারণে আমি পানি দেইনি…

কারণ, ধরো, তুমি আকাশ, তোমার ঘরটুকু আকাশ, রাত জেগে শোনা তোমার গানটুকু আকাশ, ঘুম ভেঙে শোনা গোটা পাঁচেক বাক্য আকাশ, এতে সন্দেহ নেই, কিন্তু যে মানুষটা আকাশ না, তার মধ্যে তো আমি জোর করে আকাশ আবিষ্কার করতে পারি না…

কারণ, মানুষের সাথে আকাশের…