এলোকথন (অশ্বিনী ২৪:১)

এক.

আমার একটা ফ্যান্টাসি আছে। আমি মানুষজনকে পকেটে করে ঘুরি। মানে, আক্ষরিক অর্থে তো আর একটা মানুষকে পকেটে পুরে ফেলা যায় না, তবে কেউ যখন ফোনে খুদেবার্তা/মেইল দেয়, সেটা না পড়েই পকেটে নিয়ে ঘুরতে থাকি।

ধর, সকালবেলা এ্যানি একটা মেইল দিল। ফোনের পর্দায় ওর একটা ছবি আসবে, মেইলের খানিকটা অংশ আসবে। আমি মেইলটা আর খুলি না, ওভাবেই ভার্সিটি চলে যাই। দু-এক ক্লাস পরে হয়তো কোন কাজে ফোনটা পকেট থেকে বের করি। আবার এ্যানির মুখ দেখা যায়, সেটাকে আনমনে একটু ঝাড়ি দিয়ে আবার পকেটে রেখে দেই। দুপুরে খাবার সময় হয়তো অকারণেই ফোনটা বের করি, এবং আবার অবাক হয়ে যাই, আরে, এ যে এ্যানির মুখ দেখা যাচ্ছে, মেইল এসেছে। আবার ফোনটা পকেটে রেখে দেই, মেইল না খুলেই। সে নাহয় খোলা যাবে এক সময়—অত তাড়াহুড়োর কী আছে।

গত দুদিন ধরে রিয়াকে পকেটে নিয়ে ঘুরছি। এই উত্তর দিবো-দিবো করে খেয়াল করলাম, এখনও দেইনি। থাকগে। তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই, একসময় ফোন দিয়ে বকে দিলেই হয়ে যাবে।

অবশ্য, ছেলেদের সাথে এই ফ্যান্টাসিটুকু করা কঠিন। মেইল দেয়ার সাথে সাথে উত্তর না পেলে আরিফ-আকিবের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, বুক ধড়ফড় করতে থাকে। পানির পিপাসা পায়। মনে হয়, নোবেল ভাইয়া আমাদেরকে ছেড়ে নির্ঘাত রিয়া কিংবা তটিনীর সাথে কথা বলছে। আজ ছেলে বলে…ইত্যাদি ইত্যাদি।

[উল্লেখ্য, আরিফ আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছে। কেন করেছে সেটা কেউ যদি জানিস/জানেন, তাহলে একটু আমাকে জানিয়ে বাধিত করবেন।]

যাকগে…

দুই.

আপাতত ভার্সিটি আর আমাদের পাগলামোগুলো নিয়ে অনেকখানিই ব্যস্ততা যাচ্ছে। ভার্সিটিও কি দিনে দিনে পাগলামোর অংশ হয়ে যাচ্ছে না? আমাদের এই টার্মে এক স্যার পেয়েছি, অনিন্দ্য স্যার। উনি নিজেও আমাদের মত খ্যাপা ধরনের। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই বললেন, ‘তোমরা যদি হাজার-হাজার বছর ধরে চলে আসা সফটওয়্যারগুলো বানাতে থাকো, তাহলে আর লাভ কী। নতুন কিছু—’

এই শুনে তো আমার আর নিলয়ের দুজনেরই মাথা নষ্ট। এমনিতেই আমরা যথেষ্ট পাগল, তার ওপরে ঢাকের বাদ্য বাজলে তো নাচ শুরু হতে বাধ্য। কাজেই ধিন-ধিন-তা, আমি নিলয়ের দিকে তাকালাম, নিলয় আমার দিকে তাকাল, এবং গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, ‘বের কর তোর মার্ক্সিস্ট আইডিয়া!’

আমি বললাম, ‘যেটা কেউ আগে বানায়নি—’

‘একদম রেভোলিউশনারি—’

‘দেখে স্যারদের মাথা নষ্ট হয়ে যাবে—’

‘আমরা থিসিসেও কনটিনিউ করব—’

‘তথাস্তু!’

দেখা যাক, খাটাখাটনি করে কী হয়। নিলয় প্রতিদিন বকে যাচ্ছে আমাকে ধুমধাম মেশিন লার্নিং শিখে ফেলার জন্য। ওর একটা আইডিয়া ছিল যে, আমরা…

তিন.

কিন্তু খুব বেশি কাজ করার সমস্যা সম্ভবত এই যে, মনের যুক্তির অংশটুকু জোরালো হতে শুরু করে। যুক্তি আর আবেগ—এই দুটোকে মোটামুটি সম্পূরক হিসেবে ধরা যায়, কাজেই আমি যত বেশি যৌক্তিক কাজ করা শুরু করি, আবেগের পরিমাণ সেই অনুপাতেই কমতে থাকে।

এখন সমস্যা হল, যুক্তি দিয়ে তো সবকিছু আনা যায় না। এই যেমন, আমাকে যেই কয়টা মানুষ ভালোবাসে তারা তো খুবই অযৌক্তিক একটা কাজ করে। কারণ আমি সিদ্ধার্থ না, আমি রবিশঙ্কর না, আমি কার্ল সাগান না, আমি জয়নুল না, আমি একটা কিছুই না, কাজেই আমার সাথে উল্লেখযোগ্য একটা দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। তা আর রাখে কই। স্ফুলিঙ্গ হোক, নক্ষত্র হোক, ঘুরেফিরে সবাই চারপাশে আলো ছড়াতে থাকে।

এবং এই আলোকেই বা মিথ্যে বলি কী করে। এও তো সত্যি, এখনো যে ব্রহ্মপুত্রে ঝাঁপ দেইনি, দেইনি কীর্তনখোলায়—তার পেছনে কি আলোটুকুর অনেকখানি ভূমিকা ছিল না?

কাজেই, যুক্তির উপরে সবসময়ই হৃদয় বাস করেছে, এবং…

চার.

কিন্তু, আমি ফিরে পেতে চাই।

যদিও ভালো লাগছে কাজকর্ম করতে, কিন্তু তবু, আমি সেই অকাজের দিনগুলো ফিরে পেতে চাই। আমি ইচ্ছে করেই মন খারাপ করতে চাই—মেলানকলিটুকু বাধ্য করুক আমাকে আরেকটা ছবি আঁকতে, আমি চাই। পুরো বছরটা চলে গেল, একটাও ডিটেইল্‌ড স্কেচ করিনি। আমি সমুদ্রে ডুবে যেতে চাই, আমি দিনরাত পাগলের মত লিখতে চাই। প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝে আমি লিখতে চাই, গরমে পুড়ে যাওয়ার রাতগুলোতে আমি লিখতে চাই। আমি আরও একবার ধাক্কাটুকু খেতে চাই, আমি এক রাতে টুকরো টুকরো হয়ে পরের রাতে আবিরের সাথে আড্ডা দিতে চাই, অফিসের কোণে বসে। ক্যাম্পের শেষদিনে গলা ছেড়ে ‘তোমার কথা বলা যেন মধুবালা, তোমার হাঁটাচলা সোফিয়া লরেন’ গাইতে চাই। শীতের রাতে ছাদে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তটিনীর সাথে বকবক করতে চাই। পনেরো সালের সেই বিকেলটার মত আমি শাহবাগের রৌদ্রোজ্জ্বল রাস্তায় হাঁটতে চাই, তিনজন মিলে।

যদি কোনোদিন, যদি কোনোদিন…