এ্যালানার গল্প এবং একটুখানি বরিশাল

আমার সমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে কেমন যেন একটা অভিভাবক-টাইপ ভাব থাকে।

অবশ্য, সমবয়সী বা আছে ক’জন। আঙুলে গুণে ফেলা যাবে, এবং সেটা হাতের আঙুল ছাড়িয়ে পা পর্যন্ত যাওয়ার কথা না। তাদের একজনের নাম এ্যালানা।

এবার বরিশালে গিয়ে এ্যালানার সাথে দেখা করেছিলাম, অনেকদিন পর।

এবং কোন এক অদ্ভুত কারণে, বরিশালের গল্প অনেকের কাছে করলেও এ্যালানা মেয়েটার প্রসঙ্গ আসেনি। ঘুরেফিরে আমরা বরিশালের স্কুলগুলো, সেখান থেকে কীর্তনখোলা, সেখান থেকে আবারও বরিশালের রাস্তা—এই গল্পগুলোতেই ফিরে এসেছি, কিন্তু এ্যালানার কথা বলার সময়টুকু হয়নি।

আমার খুব ইচ্ছে ছিল, ওদের শহরে গিয়ে মেয়েটাকে ভড়কে দিব। কাজেই আগে থেকে কিছু বলিনি। ভুলেও যাচ্ছিলাম অবশ্য ওর কথা।

আমরা যেই সকালে বরিশালের মাটিতে পা রাখলাম, সেদিন বড় বৃষ্টি হচ্ছিল। লঞ্চে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম সবাই। কাজকর্ম করছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল আরেকটু কাজ করানোর, কিন্তু রাত তিনটার দিকে বাকি তিনজন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এখন নাকি এক কাপ চা না হলে কোনভাবেই চলছে না। কাজেই আমরা কেবিন ছেড়ে বাইরে বের হলাম, এবং আবিষ্কার করলাম মোটামুটি সারা লঞ্চ চুপচাপ, শান্ত, সবাই গভীর ঘুমে। কাজেই চায়ের আশা ত্যাগ করে রিফাত ছেলেটা লঞ্চের ডেকে গিয়ে বসে পড়ল। অথবা সেটা আকিবও হতে পারে, আমার মনে পড়ে না এতদিন পরে, আদৌ কে ছিল ওটা। অথবা, সেটা আমি হলেও বা খুব বেশি কিছু এসে যায়? ঘুরেফিরে একই সত্ত্বার খানিকটা করে অংশ আমরা পেয়েছি, কাজেই রাত তিনটার সময় লঞ্চের একদম সামনে দাঁড়িয়ে যখন একজন দেখলো, মাথার ওপরে আকাশভরা নক্ষত্র, এবং আরেকজন তার পাশ থেকে বলল, মেঘনার এক পাশে মেঘটা ঘন হয়ে আসছে, তখন আরেকজন আবিষ্কার করল, ঝড়টা আসতে দেরি নেই, আমরা আমাদের চিন্তার সচেতন অংশটুকু ইচ্ছে করেই হারিয়ে ফেললাম, আমরা ভাবলাম, এই রাতটার জন্মই হয়েছে আমাদের ভেতরের পারত্রিক সত্ত্বাটুকুকে ওপরে তুলে আনার জন্য।

ঘুমোতে দেরি হয়েছিল বেশ, সে রাতে।

সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, লঞ্চটা কীর্তনখোলার তীরে দাঁড়িয়ে, আর নদীর বুকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি।

ঘাট থেকে বেরিয়ে দেখি, শহরজুড়েও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি।

কী আশ্চর্য, আমরা বের হলাম, শহরটা ওভাবেই আমাদের স্বাগত জানাল, স্কুলের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ ভিজলাম। শান্ত ভঙ্গিতে।

সে কথাও থাক। এক সময় হয়তোবা বৃষ্টি থেমেছিল। আমার ঠিক মনে নেই। সেদিন সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত আমি অন্য জগতে ছিলাম।

আমি, আমরা সবাই এই নেশায় আক্রান্ত হই, কারণ আমাদের আলো দেখাতে ভালো লাগে। একসাথে দুশো মানুষকে আলো দেখানোর সুযোগ সচরাচর পাওয়া যায় না। যখন যায়, আমরা শিহরিত হই, প্রথম প্রেমে মরে যাওয়া ক্লাস এইটের ছেলেটার মত আমরাও মুগ্ধ হই, এবং ক্লাস এইটের ছেলেটার মতই, খুব অকারণেই দ্রুতবেগে হাঁটা শুরু করি, হোঁচটের ভয় উপেক্ষা করে, একটু দ্রুতবেগে বলা শুরু করি, শব্দজটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।

আমার মনে আছে, সেই দুপুরে আমরা অনেক্ষণ মুগ্ধ হয়ে ছিলাম। বাকিদের মুগ্ধতার ধরনটুকু আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না, কারণ ওদেরকে ব্যাখ্যা করা আমার আঙুলের কাজ না, কিন্তু আমার কথাটা বলতে পারি। স্কুলটা থেকে বেরিয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম, আমি তখনও আকিবের সাথে বকবক করছি। ঘরে ঢুকে ধপাধপ তিনজন মিলে সোফায় এবং বিছানায় এলিয়ে পড়ল। এবং এলিয়ে পড়া অবস্থাতেই ওদের কাছ থেকে থেকে যেন ‘এই গোসল কর’, ‘ভাই খাবেন না’-জাতীয় হাঁকডাক শোনা গেল। আমি শুনলাম, এবং খেতে যাওয়ার আগে ভাবলাম, ঝুপুস করে গোসলটা করে নিলে মন্দ হয় না, নিজেকে অনেকখানি মানুষ মনে হবে তাহলে।

এবং, হুম, ব্যাপারটা চিন্তা করার মত যে, মাথায় অনেকখানি পানি ঢালার পর আমি শান্ত হয়ে গেলাম। ব্যাপার কিন্তু এমন না যে সেদিন অনেক গরম ছিল। সারাদিন ধরেই টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছিল। কিন্তু তবু, সারাদিন খাটুনির পর ঝপঝপ করে মাথায় পানি ঢেলে একটা পরিষ্কার জামা পড়লে, এবং পেটে খানিকটা খিদে থাকলে বোধহয় অনেককিছুই ভেবেচিন্তে দেখতে ইচ্ছে হয়।

কাজেই আমি গালে হাত দিয়েই ভাবতে বসলাম। সেই বিকেলে সবাই যখন দুপুরের খাবার খেতে বসেছে, আমি তখন মোটামুটি চুপ হয়ে গেছি। খাওয়া শেষ হলে ওরা বের হল, পুরো শহরটা নাকি ঘুরে দেখতে হবে। বিভ্রান্তের মত কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে আমরা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হাজির হলাম। আমি তখনও চুপ, একেবারেই।

রিফাত, কিংবা রিয়াদ—এই ছেলেটা বেশ ছবিটবি তুলছিল। ক্যামেরাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিজের ছবি তোলার চল শুরু হবার পর থেকে এটা এক যন্ত্রণারই নাম হয়েছে। তবু, মাঝেমধ্যে এসব ছবি তোলাটা বোধহয় ভালোই। নিজের ছবিটবি বিশেষ একটা তুলতে পারি না দেখে সময়ে-অসময়ে নিজেকেই ঝামেলায় পড়তে হয়। তবে কিনা, যারা দিনরাত ক্যামেরাটা নিজের মুখের দিকে…আচ্ছা থাক সে কথা। বলছিলাম যে, রিফাত বেশ ছবিটবি তুলছিল। ওসব ছবি দেখে পরেরদিন সুরভী আন্টি বকেই দিলেন—আমি নাকি মুখ ভার করে আছি ছবিগুলোতে।

এমনকি আকিবও, অথবা হতে পারে ওটা রিফাত, বলছিল যে, কোন এক কারণে আমি হঠাৎ চুপ হয়ে গেছি। রিফাত হাত দিয়ে শহরটার মাটি স্পর্শ করছিল, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছিল, আকিব-রিয়াদ ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছিল, অথচ ওদের সবাইকে একসাথে জোড়া লাগিয়ে আমি নিজেই মাঝখান থেকে উধাও হয়ে গেলাম।

কেন এমনটা হল এর ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন, কিন্তু আমার বিশ্বাস, এটা মুগ্ধতার একটা রূপ।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোবার সময় আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। একসময় দেখি, হাত বিশেক সামনে দাঁড়িয়ে বাকি তিনজন খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে আলোচনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয় আর শহরের মাঝে লম্বা একটা সেতু—সেটা হেঁটে পার হবে কিনা তাই নিয়ে সবাই বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। রিফাত পাগলটা হেঁটেই যেতে চায়, কিন্তু বাকিরা গাঁইগুঁই করছে। অনেকটা বিচার দেয়ার ভঙ্গিতেই আমাকে বলা হল, হেঁটে পার হবার পরিকল্পনা রিফাতের।

আমি রীতিমত চোখ কপালে তুলে ফেললাম! বললাম, এই বয়সে যদি হেঁটে পার না হই, তবে কি বুড়ো বয়সে এসে হাঁটবো?

রিফাতের মধ্যে নতুন করে প্রাণ আসলো, ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলে কৃতজ্ঞতা জানাল, এবং হনহন করে রওনা দিয়ে দিল! আমরা হাসতে হাসতে তার রাস্তা ধরলাম।

অনেক গল্প আসলে, অনেক অনেক গল্প।

এ্যালানার কথা লিখতে বসেছিলাম, ভাবলাম সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে অল্প কয়েকটা কথা বলে নেয়া যায়। সেই ‘অল্প কথা’-ই বলে শেষ করতে পারছি না। এতদিন পর, সিরিয়াসলি, এতদিন পর? এজন্য শহীদুল সাহেবকে কি হাত ধরে একটু ধন্যবাদ জানানো যায় না? বেঁচে থাকলে হয়তোবা সেই চেষ্টা করতাম আমি।

কিন্তু সমস্যা হল, গল্প। অনেক।

আমরা ব্রিজের ঠিক মাঝখানে বসে গলা ছেড়ে গান গেয়েছি, সেটা একটা গল্প।

কীর্তনখোলার ওপরের আকাশের এতগুলো রঙ, আকিবের মত একটা ছেলেকেও যার মায়া পাগল করে দিল, সেই রঙ আরেকটা গল্প।

আমার কাছে বেশ কিছু রেকর্ডিং আছে, আকিব আর রিফাত যখন খাঁটি দক্ষিণবঙ্গের ভাষায় কথা বলছিল—সেটার। হুম, আরেকটা গল্প।

কিংবা, সেই জাদুকরী ঘরটায় বসে আমরা একটা রাত কাটিয়ে দিলাম, এমনকি সকালে উঠেও আকিবের ইচ্ছে হল সারাদিন সেখানেই বসে থাকবার—সেই ঘরটাও কি একটা গল্প না?

বিছানার এক কোণে, জানালার ঠিক পাশে আমি বসে আছি, অন্যদিকের বিছানায় আধশোয়া হয়ে আকিব কাজ করছে, মাঝখানের সোফায় রিফাত বসে চা খাচ্ছে, ঘাড়ে গামছাটা জড়ানো, রিয়াদ চেয়ারে বসে ফোন ঘাঁটছে, আমি যদি লেখা শুরু করতাম, আহ, আমার খানিকটা আফসোস হয় এই ভেবে যে, বরিশালে বসে এই ঢলটুকু নামলো না, প্রায় দুটো সপ্তাহ পার করে আজ হঠাৎ কী হল কে জানে, সেদিন নিশ্চয়ই আরও অনেকখানি খুঁটিনাটি কিছু খেয়াল করতাম, জানালা দিয়ে যেই শহরটুকু দেখা যায়, আর দরজা দিয়ে সামনের বারান্দাটুকু, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল, কী সর্বনাশ, পুরো শহরকে কয়েকশো হাত পানির নিচে ডুবিয়ে দেয়া বৃষ্টি, আমাদের একটা অকারণ ইচ্ছা হচ্ছিল সারাদিন এখানেই বসে থাকার, চাইলে একটু পরপর এক কাপ চা দিয়ে যাচ্ছে, রিফাত হালকা সুরে হারমোনিকা বাজাচ্ছে, একটা গল্পের বই, দু-একটা এলোমেলো কথা…

আচ্ছা থাক ওসব। আমি আসলে এ্যালানার কথা বলার জন্য লেখা শুরু করছিলাম। বলি।

আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম যে, সেদিন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে আমি হুট করেই মেয়েটার সাথে দেখা করেছিলাম। এক কোটি বছর হয়, ওকে দেখি না। কোন এক বৃহস্পতিবার…আচ্ছা কী আশ্চর্য, লিখতে গিয়েই খেয়াল করলাম, সেদিন আসলেই বৃহস্পতিবার ছিল, মহাদেব সাহা কী ভেবে আদৌ বৃহস্পতিবারের কথা লিখেছিলেন? অদ্ভুত!

বিস্ময়টুকু কাটার অপেক্ষা না করেই লিখে ফেলি, সেদিন এ্যালানার সাথে আমি দেখা করলাম, এবং এক কাপ কফি নিয়ে খেতে যতটুকু সময় লাগে ঠিক ততক্ষণ বকবক করলাম। সে আমাকে বলল ঠিকমত পড়াশোনা করতে।

এই তো। এটা বলার জন্যই লিখতে বসেছিলাম।