অন্তর্গত বিস্ময় – ২

“God is a concept—by which we measure our pain.”

কথাটা জন লেনন বলেছিলেন, কোন এক গানে। থুড়ি, ঠিক ‘কোন এক গানে’ বলাটাও ঠিক হচ্ছে না, কারণ এটা যথেষ্ট বিখ্যাত একটা গান। সত্যি বলতে কী, এই গানের কথা যে আমি কতবার করে মানুষজনকে বলেছি, বলতে বলতে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছি—কতবার এমন হয়েছে—আমি নিজেও জানি না।

এবং ঠিক এই কথাটাই আমার লেখার কথা সপ্তাহদুয়েক আগে।

আবারও রিয়ার বকা খেয়ে লিখতে বসলাম—এদ্দিন বাদে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত, কারণ যুক্তি বলে, রিয়ার বকায় কাজ হওয়ার কথা না। বিশেষ করে, নভেম্বরের এই ভুতুড়ে রাতে কোনক্রমেই হওয়ার কথা না।

তবে কিনা, যুক্তির উপরে আরও কিছু একটা বাস করে, কাজেই যখন লিখতে বসার কথা না—ঠিক তখনই আমার মনে হয়, ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে আরিফের অমর উক্তি—‘দামি লেখা পড়তে গেলে আমি নিশ্চয়ই পাবলিক লাইব্রেরিতেই যেতাম? আপনার কাছে সস্তা লেখাই পড়তে চাইসি, সুতরাং প্লিজ, লেখেন।’

আমি যে একেবারেই লিখছি না—ব্যাপারটা এমনও না। বছরের মাঝখানে ডায়েরি লেখা প্রায় ছেড়ে দিয়েও এই বছর প্রায় বিয়াল্লিশ হাজার শব্দের ডায়েরি লিখে ফেলেছি, ডিসেম্বর শেষ হতে হতে বোধকরি তা পঞ্চাশে গিয়েই ঠেকবে—এটাই বা কম কী।

অর্থাৎ, লিখছি তো। কিন্তু, সেই যে, অর্থ নয়, বিত্ত নয়, আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে…

সেই বিস্ময়টুকু ইদানিং বেশ ভালোমতই টের পাচ্ছি।

বিস্ময় একেকজনের কাছে একেক রূপ নিয়ে আসে। এবং অবধারিতভাবেই, প্রতিবার নতুন রূপ নিয়েই আসে।

বিশ্বাস কর, এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, ভার্সিটিতে ওঠার পর একটা বছরও যায়নি—যে বছর আমি নতুন করে নিজেকে চিনিনি। এবং, ভাই রে ভাই, একেকবার চেনার পর আমি নিজেই বিস্ময়ে রীতিমত খাবি খেয়েছি—এটাও কি আমি?

এবার কথার একটা শাখা বের হবে। এবং হাত এতখানিই নিশপিশ করছে যে, প্রশাখার সাড়াও টের পাচ্ছি। শুরু করতে হবে প্রশাখা দিয়েই।

কী আর করা। লিখি। নাচতে নেমে ঘোমটা টানার কোন মানে হয়?

জর্জ হ্যারিসনের বিট্‌লস যুগের শ্রেষ্ঠ গানগুলোর মধ্যে একটা হল while my guitar gently weeps. তো, এই গানটার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। জর্জ একদিন চীনের দর্শনবিদ্যা ঘেঁটে দেখছিল। প্রাচ্যের দর্শনে নাকি ধরে নেয়া হয়—পৃথিবীর সবকিছুই সবকিছুর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই শুনে জর্জের মনে হল, সে যেকোন বই খুলে প্রথম যেই শব্দগুলো দেখবে—সেটা নিয়েই গান লিখে ফেলবে। তারই ফলাফল এই ‘gently weeps’.

প্রাচ্যের দর্শন নিয়ে আমার জ্ঞান শূন্যের কাছাকাছি, কাজেই মতামত প্রকাশ করাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিন্তু তবু, আমার কেন যেন মনে হয়, হলেও হতে পারে যে, পৃথিবীর সবকিছুই সবকিছুর সাথে সম্পর্কযুক্ত।

একটা ছোট্ট উদাহরণ হিসেবে আজকের ঘটনাটা বলা যায়। সত্যি বলতে কী, এটাই শাখা—যেই শাখার কথা বলতে গিয়ে জর্জ হ্যারিসনের প্রশাখাটা বেরিয়ে এল।

আমি যেই মুহূর্তে লিখলাম, ‘এটাও কি আমি’—ঠিক সেই মুহূর্তেই আবিষ্কার করলাম, লেখার সাথে ল্যাপটপে চলতে থাকা ওয়াটসন ব্রাদার্সের গানটা অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে। গানের নাম, ‘আমার নতুন আমি’।

অথচ, এমনটা হওয়ার কথা না। আজ বিকেলে দাদুকে দেখতে যাবার আগে এমনিই গানটার কথা মনে পড়েছিল। কোন কারণ ছাড়াই শুনছিলাম। এত ভালো লাগছিল যে, রিফাত পাগলটাকেও রীতিমত মেইল করে গানটা শোনালাম।

“কাগজের পাখা হাতে করে আমি
আকাশ ছুঁতে চাই,
ছায়ার মাঝে আমি হন্যে হয়ে
সত্য খুঁজে বেড়াই—”

কী আর বলব!

প্রতিনিয়ত এই আকাশ ছুঁতে গিয়ে, আর সত্য খুঁজতে গিয়েই কী পরিমাণ বিস্ময়, আর ক্লান্তি ভর করছে আমাদের একেকজনের ভেতরে!

দেখ, আমার যখন জন্ম হয়নি, এই সেদিনও, দু হাজার চৌদ্দ সালেও আমি এমন ছিলাম না। পনেরোতে আমার একবার জন্ম হল, আমি পাগলের মত দিনরাত ছবি আঁকলাম। সেই পনেরোতেই রাস্তার ঘোরার নেশাটা পেয়ে বসলো। ষোল সালের শেষদিকে এসে খেপে গেলাম লেখার জন্য—কী দিন গেছে একেকটা! শীতের রাতে রীতিমত একটা ঘোরের মধ্যে ছাদে হেঁটে বেড়াতাম, আর বাসায় ফিরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে লিখতে বসতাম! এবং তেমন কিছুই করা লাগত না—চারপাশে যত হইচই হচ্ছে হোক, আমার আঙুল দিয়ে ঝড়ের বেগে কথাবার্তা বেরিয়ে আসত। এবং ভালো লাগত তখন ডায়েরি লিখে। ভালো লাগত মানে, আসলেই ভালো লাগত। এমনও দিন গেছে—যেদিন সকাল-মধ্যসকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত—সবসময় ডায়েরি খুলে বসে ছিলাম, টুকটাক করে লিখছিলাম।

কিন্তু, সতেরোতে এসে…

সতেরো সালকে বিচার করার জন্য এটা সম্ভবত শ্রেষ্ট সময় না, কারণ একটা বৃত্তে আটকে থেকে কখনই সেই বৃত্তটাকে বোঝা যায় না। বোঝার উপায় একটাই—পেছনে ফিরে তাকানো। জব্‌সের ভাষায়—ডট কানেক্ট করা। সুতরাং, এই বছরের ডটগুলো জোড়া লাগাতে আমার আরও অনেকখানি সময়ই প্রয়োজন, কিন্তু তবু…

তবু, আমি জোর গলায় উচ্চারণ করছি, এই বছর আমার ভেতর থেকে আরেকটা নতুন সত্ত্বা যে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, যাকে ‘অন্তর্গত বিপন্ন বিস্ময়’ নামে ডাকতে জীবনবাবু বড় পছন্দ করতেন, যার ভয়ে শিকলদেবী থরথর করে কাঁপতে থাকে, যাকে এই সমাজ কখনই প্রশ্রয় দিতে চায় না—সেই সত্ত্বাটাই সম্ভবত খুব দ্রুত আমাকে অধিকার করে নিবে।

আমার ভালো লাগছে। আমার কোন সত্ত্বাই মরে যায় না। আমার এখনও ছবি আঁকতে ভালো লাগে, ভালো লাগে রাস্তায় ঘুরতে, এ্যানিকে বেদম পেটাতে, হেমন্ত থেকে শুরু করে গান্‌স এ্যান্ড রোজেস—সবই ভালো লাগে। কেউই তো মরেনি।

কাজেই, জন্ম নিক, পুরনোদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও একবার, আরও অসংখ্যবার করে এই সুন্দরতম অনুভূতিগুলো জন্ম নিক।

এবং বিস্মিত করুক, পুরনোদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও একবার, আরও অসংখ্যবার করে এই অন্তর্গত অনুভূতিগুলো আমাদের বিস্মিত করুক!