অন্তর্গত বিস্ময় – ১
এক.
হতে পারে, নভেম্বরের এই সময়টা মানুষের মধ্যে খানিকটা হলেও সাইকিডেলিয়া এনে দেয়।
অবশ্য, ‘সাইকিডেলিয়া’ শব্দটা বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না, এটা অর্থ অনেকভাবেই করা যায়। এর চেয়ে অনুভূতিটাকে ‘পরাবাস্তব’ ডাকলেই বরং ভালো শোনায়।
হেমন্তকাল না এটা?
হেমন্তে যেই রহস্যময়তা আছে, এবং যেই রহস্যটুকু আছে হেমন্তকে পুনর্জন্ম দেয়া কবির ভেতরে—সেই রহস্য সম্ভবত আর কোথাও নেই।
আমি মাঝেমধ্যেই ভাবি, জীবনানন্দ যদি এভাবে হেমন্তকে নতুন করে জন্ম দিয়ে না যেতেন, আমরা কীভাবে নিজেদেরকে ব্যাখ্যা করতাম? একটা ফর্সা চাদর, ফর্সা বিছানা, জানালার পাশের টেবিলটায় বসে, ঠিক রাত আটটায় দ্বাদশীর আলো দেখে যেই অনুভূতিটা হত—সেটার কারণ আমরা কীভাবে খুঁজে পেতাম?
আমার ধারণা, আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম, স্ট্যাটের মাঠে দিশেহারা হয়ে বসে থাকতাম, আমাদের হাত-পা কাঁপতে থাকত, আরও একবার মহাখালী থেকে বাসে উঠতে গিয়ে আমরা কেবল শূন্যতাই দেখতাম (অর্থাৎ ঢেউটুকু দেখতাম না)।
এবং তিনি ছিলেন।
তিনি ছিলেন, তাঁর ট্রাঙ্কটুকু ছিল—বড় সৌভাগ্য আমাদের—হেমন্তের মধ্যিখানে এসে আমরা আবিষ্কার করতে পারি যে,
“জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত—ক্লান্ত করে…”
দুই.
আজ বাসায় ফেরার পথে এই কথাগুলোই ভাবছিলাম। সত্যি বলতে কী, রীতিমত বিড়বিড় করে শব্দগুলো বলেও ফেলছিলাম মুখ দিয়ে। গত কিছুদিন ধরেই কবিতাটা মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু আজ যেন খানিকটা মাত্রাই ছাড়িয়ে গেল।
সারাদিন কাজকর্ম করার পর বিকেলের দিকে আরিফের ফোন পেলাম। গাধাটার কয়েক মাস ধরে ঢঙ শেখা সার্থক হয়েছে, গাধা আজকাল অসাধারণ ঢঙ করতে পারে। আমাকে ফোন দিয়ে যা বলছিল সেটাকে সোজা বাংলায় অনুবাদ করলে অনেকটা এমন দাঁড়ায়—‘সুধী, আমি অত্র মুহূর্তে আপনার ক্যাম্পাসে আছি এবং বেশ কিছুক্ষণ ফ্রি আছি। আপনার দর্শনলাভের মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় সময়াতিপাত করছি।’
আমার যথেষ্টই মেজাজ খারাপ হল। বাসায় ছিলাম, বললাম বাসায় আছি। তাই শুনে গাধাটা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘ও আচ্ছা ভাইয়া, ঠিক আছে তাহলে।’ আমি দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলাম এবং আবারও কাজে মন দিলাম।
তারও খানিক্ষণ পর এ্যানি ফোন দিল। এবং আমি ‘বাসায় আছি’ বলতেই ধমক খেলাম!
এবং কেবল তখনই আমি বুঝলাম, এই পরাবাস্তব বিকেলে আরও একবার আমাকে জীবনানন্দের সেই বিপন্ন বিস্ময়ের খোঁজ করে বেড়াতে হবে।
আমার আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, একুশ শতকের ঢাকা শহরও জীবনানন্দের পরাবাস্তবতার ঘোর থেকে বের হতে পারে না। বিশেষ করে হেমন্তের এই সময়টাতে। ক্যাম্পাসে একাই হাঁটছিলাম আজ—শহীদুল্লাহর পুকুরপাড়ে হঠাৎ শিউলী ফুলের ঘ্রাণ এসে পাগল করে দিল। সে তো প্রায়ই পাই, কিন্তু কোনদিন তো এই ঘ্রাণ এত গাঢ় করে বাতাসে ছড়ায় না? কিংবা, আজ সারা সন্ধ্যা যেভাবে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ালাম, সেটাও তো বছরের অন্য সময়ে হয় না?
তিন.
যাকগে, এসব নিতান্ত বাজে কথা।
গত রাতে একজন জিজ্ঞেস করছিল, আমি ঠিক কখন খোলস ছেড়ে বের হই। আর আজ, স্ট্যাটের সামনের মাঠে বসে এ্যানি জিজ্ঞেস করল, সবচেয়ে পুরনো গল্পটা বলতে কেন আমি সবচেয়ে বেশি সময় নিলাম।
এর কোনোটারই উত্তর সম্ভবত আমার কাছে নেই।
তবে, সব প্রশ্নের জন্ম উত্তর দেবার জন্য হয় না। অনেক প্রশ্ন করাই হয় কেবল মানুষকে চিন্তা করানোর জন্য।
কাজেই, আজ সন্ধ্যার পর আমি বাধ্য হলাম বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে।